সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ১২:৫১ পিএম
ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক সরকারের শাসনামলে কিশোর গ্যাংয়ের দাপট বিস্তৃত হয়ে পড়ার খবর সংবাদমাধ্যমে বহুবার উঠে এসেছে। কিন্তু দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে কিশোর গ্যাংয়ের ফের উত্থানের বার্তা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। ২৯ নভেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর শীর্ষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার মিরপুরে অপরাধ সাম্রাজ্য কিশোর গ্যাংয়ের দখলে। ইতঃপূর্বে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনেই রাজধানীর মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, উত্তরাসহ কয়েকটি এলাকায় উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক খোলস পাল্টিয়ে আগের সমাজবিরোধীরাই ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়েছে। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে পুলিশি নজরদারি দুর্বল হয়ে পড়ায় সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
গত রাজনৈতিক সরকারের শাসনামল থেকেই মিরপুরের সাত থানার বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের চাঁদাবাজি, দখল, মাদক ব্যবসা, ছিনতাই ও টার্গেট কিলিংয়ে। আরও বলা হয়েছে, পুলিশের তালিকাভুক্ত কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী এই অপরাধ সাম্রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ কারণে তারা স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে সখ্য বজায় রেখে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। আরও গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, পর্দার আড়াল থেকে এসব গ্রুপকে আশকারা দিচ্ছেন যারা, তাদের মাধ্যমেই সন্ত্রাসীদের কয়েকজন স্থানীয় বিএনপির বিভিন্ন কমিটিতেও যুক্ত রয়েছেন। শুধু বিএনপি নয়, তাদের ইন্ধন জোগাচ্ছেন আওয়ামী লীগের পলাতক কতিপয় নেতাÑএই অভিযোগও উঠেছে। আমরা জানি, সমাজে অবক্ষয়ের ঢেউ একটা প্রজন্মকে ভাসিয়ে এমন জায়গায় নিয়েছে, যেখান থেকে তৈরি হচ্ছে সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডের নকশা। নিকট অতীতে এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা বলেছি, কিশোর গ্যাংয়ের মূলোৎপাটন করতে হলে নজর দিতে হবে উৎসে। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যারা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করছেন তারা যদি ধারাছোঁয়ার বাইরে থকেন, তাহলে কোনোভাবেই কিশোর গ্যাং নির্মূল করা সম্ভব নয়।
যেকোনো রাষ্ট্র কিংবা সমাজের বড় সম্পদ যৌবন তথা তারুণ্যের অপরিমেয় শক্তি। এই তারুণ্যর পূর্বভাগই কিশোর। তরুণ-কিশোরদের বৈশিষ্ট্য, পরিবর্তনের ধারা সৃষ্টি করা এবং তারুণ্যের শৌর্যদীপ্ত ভূমিকাই সমাজের অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই ভূখণ্ডের প্রতিটি গৌরবময় অর্জনের সার্থক রূপকার তরুণসমাজ। কবি হেলাল হাফিজ তার কবিতায় লিখেছেন, ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় …।’ এই যুদ্ধ মানে নিশ্চয়ই কারও ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নয়, এই যুদ্ধ অন্যায়-অসত্য ও অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। আজকের কিশোররাই আগামীর তারুণ্য এবং দেশ-জাতির স্বপ্ন বাস্তবায়নকারী শক্তি। এই শক্তির ক্ষয় আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। কিশোর গ্যাং ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এবং বিস্তৃত হচ্ছে অপরাধের পরিসর। কিশোর অপরাধীদের এখন মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজি, দখল ও টার্গেট কিলিংয়ে জড়িত হতে দেখা যাচ্ছে। এর বেশিরভাগ নেপথ্যেই রয়েছে রাজনৈতিক ‘বড়ভাই’দের মদদ।
ইতঃপূর্বে প্রতিদিনের বাংলাদেশসহ সহযোগী সংবাদমাধ্যমে এও বহুবার উঠে এসেছে, অপরাজনীতির ধারকবাহকদের পৃষ্ঠপোষকতায় সম্ভাবনাময় অনেক জীবন অপরাধীর কাতারভুক্ত হচ্ছে। বিভিন্ন মহল থেকে বহুবার আরও অভিযোগও উত্থাপিত হয়েছে, সমাজের এ বিবর্ণ চিত্র নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট অপসংস্কৃতির বিরূপ ফল। কিশোর চক্রগুলো গ্যাংয়ে রূপান্তরিত হওয়ার প্রেক্ষাপট কীভাবে তৈরি হয়েছে, ক্রমেই কীভাবে এর পরিসর বিস্তৃত হচ্ছে এবং কীভাবে কিশোরদের অনেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠছেÑএই তথ্যগুলো সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে স্পষ্টভাবে বারবার উঠে আসার পরও কেন অবক্ষয়ের স্রোত ঠেকানো যাচ্ছে না? আমরা এই প্রশ্নটি সরকার-প্রশাসন সমান্তরালে রাজনীতির নীতিনির্ধারকদের কাছে রাখতে চাই। আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে কারোরই দায় এড়ানোর অবকাশ নেই।
রাজনৈতিক অঙ্গন কিংবা সমাজে যেসব বলবান হীনস্বার্থবাদী নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থকরণে সম্ভাবনাময় জীবনগুলোকে অপব্যবহার করে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করা হোক। সর্বাগ্রে তাদের অপরাধের প্রতিবিধান নিশ্চিত করা জরুরি। আমরা এও মনে করি, শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদের পক্ষে এই অবক্ষয়ের স্রোত বন্ধ করা সম্ভব নয়, এর সঙ্গে সমাজের সচেতনদেরও ভূমিকা রাখতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের পাশাপাশি পরিবারকেও প্রতিষ্ঠান হিসেবে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর দায়িত্বশীলদেরও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। মানবিক মূল্যবোধের চর্চা ও সমাজের সৌহার্দ্য-সংস্কৃতি-ঐক্য ও শৃঙ্খলা বজায় রাখায়ও সম গুরুত্ব দিতে হবে।