× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

জাতীয় নির্বাচনের হাওয়ায় রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতার ছায়া

ড. ফরিদুল আলম

প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২২ ২৩:৪২ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

রাজনীতিতে উত্তেজনা বাড়ছে। সাম্প্রতিক মাঠে সরকারের প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি’র তৎপরতা থেকে এমনটিই লক্ষ্যণীয়। অতিসম্প্রতি তারা দেশের প্রায় সকল বিভাগে বিভাগীয় সমাবেশ সম্পন্ন করে পূর্বঘোষিত ঢাকায় মহাসমাবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মধ্যে ঢাকার সমাবেশ নিয়ে সরকার এবং তাদের মধ্যে দরকষাকষি শুরু হয়েছে। তারা নয়াপল্টনে দলীয় অফিসের সামনের রাস্তায় সমাবেশ করতে অনড়, অপরদিকে সরকারের পক্ষ থেকে রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না ঘোষণা দিয়ে তাদের সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। গত ২৬ নভেম্বর কুমিল্লার সমাবেশ থেকে ঘোষণা দিয়ে মির্জা ফখরুল জানিয়েছেন তারা যেকোনো উপায়েই নয়াপল্টনে সমাবেশ করবেন। 

একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হয়, সেটি হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি ঘটেছে। রাজনীতিতে বিগত বছরগুলোতে তাদের যে দুরবস্থা, এ ধরনের লোকসমাগমে নেতাকর্মীরা অনেকটাই উজ্জীবিত। ইতঃপূর্বে এই সমাবেশগুলো আয়োজনের আগে তাদের তরফ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল যে, ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন ঘটবে এবং সেদিন থেকে তাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং নেতা তারেক রহমানের নির্দেশে দেশ চলবে। কিন্তু এমন ঘোষণা কতটা নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় বৈধÑএ নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে সরকারের তরফ থেকে এই ঘোষণা গ্রহণ করে পাল্টা বলা হয়েছেÑ‘খেলা হবে’। এরপরই বিভিন্ন বিভাগীয় সমাবেশ শুরু। সবকিছু মিলিয়ে সাধারণ জনগণ এক ধরনের অজানা শঙ্কার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। এ ধরনের হুমকি এবং পাল্টা হুমকি রাজনীতিতে অনেকদিন ধরে অনুপস্থিত ছিল। এই অজানা শঙ্কার প্রধান কারণ হলো রাজনৈতিক দলগুলোর এ ধরনের ভাষার সঙ্গে সবাই কমবেশি পরিচিত, যার মধ্য দিয়ে আমরা অতীতে জ¦ালাও-পোড়াও রাজনীতিকে মনে করতে পারি।

আজকের বিএনপিকে আমরা সর্বশেষ রাজনীতিতে সরব অবস্থানে দেখেছিলাম ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পূরণ না হওয়ায় সেই নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে তারা সরকারকে চাপে রাখার যে কৌশল নিয়েছিল, সে অনুযায়ী এগুতে না পারায় পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন তারা অনেকটাই নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর যে প্রচেষ্টা এবং অবস্থাদৃষ্টে এক্ষেত্রে অনেকটাই সফলতার পেছনে তাদের দিক থেকে কতটুকু তৎপরতার মাধ্যমে এখানে তারা পৌঁছতে পেরেছেÑএই বিবেচনায় যাবার আগে আমরা যারা কিছুটা রাজনীতিসচেতন, তারা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, সরকারের কিছু কর্মকাণ্ড তাদের জন্য আজকের রাজনীতিকে অনেকটা সহজ করে দিয়েছে। এটা কীভাবে হলো? এই আলোচনা অনেকটা দীর্ঘ হবে বিবেচনায় খুব সংক্ষেপে এটুকু বলতে চাই, বিএনপি’র নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে রাজনীতির খোলা মাঠ পেয়েছিল, সেখানে হয়তো উন্মুক্ত রাজনৈতিক চর্চা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের দিক থেকে কিছুটা স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দেওয়া হয়েছেÑএমন অভিযোগ আছে বিস্তর। এক্ষেত্রে সবার আগে বলতে চাই, ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে ত্যাগী নেতাকর্মীদের পরিবর্তে এই সময়ে অনেক বেশিসংখ্যক নবীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের উত্থান হয়েছে। যদিও নবীনদের আগমনকে ইতিবাচকভাবে দেখাই শ্রেয়। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা দেখেছি এবং দেখে চলছি যে, আওয়ামী লীগের রাজনীতির মসৃণ পথটি ধরে এমন অনেকেই দলের তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন, যা অনেক ত্যাগী নেতার মনোকষ্টের কারণ হয়েছে। এ নিয়ে আগামীতে আরও লেখার ইচ্ছা রইল। 

আমাদের দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন বলতে আমরা হয়তো এখনও বুঝে থাকি হরতাল, অবরোধ কিংবা জ¦ালাও-পোড়াও ইত্যাদিকে। সম্ভবত সরকারবিরোধী পক্ষগুলোর, বিশেষত বিএনপি এ ধরনের আন্দোলন পরিচালনার সমস্ত রসদ ফুরিয়ে  বিদেশিদের কাছে নালিশ করাকেই শ্রেয় মনে করছে। এতে বিদেশিরা আমাদের সম্পর্কে কী ভাবছেন অথবা তারা আদৌ এ ধরনের নালিশের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সরকারের ওপর কোনোপ্রকার চাপ প্রয়োগ করার এখতিয়ার রাখেন কি না সেটা ভেবে দেখা হচ্ছে না। এ কথা ঠিক, একটা সময় ছিল, যখন আমাদের সরকার পরিচালনায় বিদেশিদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনেক গুরুত্ব পেত। সেইসব দিন আমরা অনেক আগেই পেছনে ফেলে এসেছি। এসব বোঝার জন্য আসলে খুব একটা বিদ্যার প্রয়োজন হয় না। তাহলে যা দাঁড়াল, তা হচ্ছে আমাদের বর্তমান সরকারবিরোধী পক্ষগুলো আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে তা তারা নিজেরাই জানে না। তাদের এই অজ্ঞানতা কিংবা অক্ষমতা আসলে সরকারের জন্য তাদের ইচ্ছামাফিক রাষ্ট্র পরিচালনার একটা ব্ল্যাংক চেক দেওয়ার সামিল। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে সরকারেরই বা দোষ কীসের? তারা বিরোধী দলের পক্ষ থেকে দেওয়া যেরকম খোলা মাঠ পেয়েছে, সেখানেই ফ্রি স্টাইলে খেলে গেছে এবং যাচ্ছে।

ধারণা ছিল, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল বিপর্যয়কে সামলে নিয়ে পরাজিত শক্তি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট তাদের সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমে তাদের ভাষায় নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে যাবে। শুরুতে তারা বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাদের প্রতিবাদের ভাষা প্রকাশ করলেও এটা গিয়ে থেমেছে এদেশে অবস্থানরত কিছু বিদেশি কূটনীতিকের দরজা পর্যন্ত। তাতে আমরা অনেকেই হতাশ হলাম। তবে সরকার বিষয়টিকে ঠিক যেভাবে নেওয়ার সেভাবে না নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্বের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আর এর ফল হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি বিএনপি’র প্রতিটি বিভাগীয় সমাবেশের প্রাক্কালে পরিবহন ধর্মঘটের নামে সংশ্লিষ্ট জায়গায় যোগাযোগের সকল প্রকার যান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দুর্ভোগে পড়ছে সকল মানুষ। সরকারের দিক থেকে এ ধরনের কাজে যারা উৎসাহ যোগাচ্ছেন, তারা সত্যিকার অর্থে কতটুকু সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষি সেটা ভেবে দেখা জরুরি হয়ে পড়ছেÑএমন অভিমত আছে অনেকের। আমিও এর সঙ্গে সহমত পোষণ করি। এক কথায় এ ধরনের কর্মকাণ্ডে বিএনপি’র প্রতি নিঃসন্দেহে কিছু মানুষের সহানুভূতি বেড়ে গেছে, এক ধরনের অতিরিক্ত আগ্রহ তৈরি হয়েছে। মানুষের মধ্যে এখন এ ধরনের ভাবনার উদ্রেক হতে শুরু করেছে যে সরকার ভয় পেয়েছে এবং ভয়ের নিশ্চয়ই সঙ্গত কারণ রয়েছে। 

আমরা কোনোভাবেই এটা প্রত্যাশা করতে পারি না যে, রাজনৈতিক দলকেই সবসময় আমরা এভাবে ধরে রাখতে পারব। সেটা সম্ভব নয় এবং উচিত নয়। বরং সরকারের সকল ইতিবাচক কাজকে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। আর সেজন্য দরকার একটি সুস্থ ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ভয় হয় যখন ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকেও পথ হারাতে দেখি। আওয়ামী লীগ আজ কতটা আওয়ামী লীগের নিজস্ব সত্ত্বার ভেতর আছে সেটা ভেবে দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে সংগ্রাম করে আজ আওয়ামী লীগের ভেতর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সত্যিকার অর্থে ধারণ করে চলা লোকের কিন্তু অভাব হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে যখনই তৃণমূল পর্যায়ে কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের দিকটি চোখে পড়ে, অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি কীভাবে ত্যাগী নেতাদের পাশ কাটিয়ে তথাকথিত নেতৃত্বে ওর আবির্ভাব ঘটে, যাদের অর্থবিত্তই আছে, রাজনৈতিক চর্চা এবং বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ধারণাটি বেশ অপরিচিত। এমনটির হয়ত প্রয়োজন হয় না আমাদের রাজনীতির জন্য। আমাদের রাজনীতির এতো অর্জন, সেই রাজনীতির বিসর্জনতো কাম্য হতে পারে না। 

এখানে নিছক আওয়ামী লীগ বা বিএনপি রাজনীতির সমর্থক হিসেবে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। যে বিষয়টিকে একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করতে চাই, তা হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৈন্য। সরকারের নানা পদক্ষেপের ফলে দেশের যে উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে সেটি খাটো করে দেখতে চাই না। নির্দ্বিধায় এটা বলতে চাই, আজকের এই অর্জনের মূলে রয়েছে একজন শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা, সততা এবং নিষ্ঠা। আর সেজন্য দেশে অপরাপর রাজনৈতিক চর্চার অনুপস্থিতি থাকবে সেটার কোনো মানে নেই, বরং উন্নয়নের যে মিছিলে আজ আমরা সামিল হয়েছি তা অব্যাহত রাখতে একটি সুস্থ রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টির ভীষণ প্রয়োজন। উল্লেখ করা যেতে পারে, আজকের আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি বলা হয়ে থাকে মহাথির মোহাম্মদকে। প্রথম দফায় তিনি প্রায় দুই দশক সরকার পরিচালনার পর পরবর্তি সরকারগুলো তারই উন্নয়নের দর্শনের আলোকে মালয়েশিয়ার শাসনকাজ অব্যাহত রেখেছিলেন। আজ আমরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছিয়েছি এ কথা যেমন সত্যি, একইসঙ্গে এও অস্বীকার করার উপায় নেই-আজকের রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে দুরবস্থা, এর জন্য এককভাবে বিএনপি বা অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোই কেবল নয়, সরকারি দলের ব্যর্থতাও কম নয়। তারা যদি গঠনমূলক রাজনৈতিক চর্চা না করতে পারে, তাহলে সেটা তাদের ব্যর্থতা। এর প্রত্যুত্তরে আমরা সরকারি দলের কাছ থেকে যে রাজনৈতিক পাল্টা জবাব পাচ্ছি, সেটার অর্থ দাঁড়ায় আওয়ামী লীগের বাইরে দেশে আর কোনো রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন নেই। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এমনটি প্রত্যাশিত কিংবা কাম্য নয়। 


লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা