সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর ২০২৪ ১০:০৮ এএম
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবি ট্রাকে পণ্য বিক্রির কার্যক্রমের পরিসর সম্প্রতি বাড়িয়েছে বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে। মূল্যস্ফীতির পারদ যখন ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী তখন ভোক্তার কাছে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি করে স্বস্তি দেওয়ার জন্য সরকার দফায় দফায় টিসিবির ট্রাক সেলের পরিসর যেমন বাড়িয়েছে তেমনি পণ্যের তালিকাও দীর্ঘ করেছে। কিন্তু টিসিবির ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে নিত্যপণ্য বিক্রি নিয়ে ক্রমেই অভিযোগ বাড়ছেÑ এই বার্তা মিলেছে ২৮ নভেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে অনিয়ম ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে এই কার্যক্রমের উদ্দেশ্যে অভিঘাতের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো একজন ব্যক্তি হয়তো একাধিকবার পণ্য নিয়ে যাচ্ছেন আবার কেউ কেউ অন্যায়ভাবে বাড়তি লোক দাঁড় করিয়ে পণ্য নেওয়ার চেষ্টা করেন। এই পরিস্থিতিতে বাধা দিলে বিক্রেতাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
গত ২০ নভেম্বর থেকে ভোজ্য তেল, চাল ও ডালের সঙ্গে ভর্তুকি মূল্যে আলুও বিক্রি করছে টিসিবি। বাজারে নিত্যপণ্যের তাপে-চাপে টিসিবির ট্রাক সেল পয়েন্টগুলোতে সাধারণ ভোক্তার ভিড় বাড়ছে। আমরা দেখছি, এখন শুধু আর স্বল্প আয়ের মানুষই নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষজনও ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে টিসিবির ট্রাক সেলে লাইন দিচ্ছেন। ট্রাক সেলের পরিসর ও পণ্য বিক্রির তালিকা বাড়ালেও তা এখনও চাহিদার নিরিখে সিন্ধুর মাঝে বিন্দুর মতো। টিসিবি যে দামে কয়েক রকম নিত্যপণ্য ভোক্তাকে দিচ্ছে তা খোলা বাজারের চেয়ে দামে অনেক কম। এই প্রেক্ষাপটে সংগত কারণেই ভোক্তার দৃষ্টি টিসিবির ট্রাক সেলের দিকে বাড়ছে। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর সরেজমিন প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে, ক্রেতার সারি দীর্ঘ হলেও পণ্যের সরববরাহ কম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও অনেককে ফিরে যেতে হয় খালি হাতে। আরও অভিযোগ আছে, স্থানীয় অনেকে লাইনে না দাঁড়িয়ে বল প্রয়োগ করে পণ্য নিয়ে যেতে চান।
টিসিবির ট্রাক সেল কার্যক্রমে যে চিত্র দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে তাতে দেখা যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই বিক্রেতা ও ভোক্তার মধ্যে অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। তাছাড়া অনেক পয়েন্টেই দেখা যায়, ভোক্তার অনিশ্চিত অপেক্ষা কখন গাড়ি আসবে? অভিযোগ আছে, নির্দিষ্ট বিক্রয় পয়েন্টে কখনও কখনও টিসিবির পণ্যবাহী ট্রাক যায় না। তা ছাড়া পণ্য বিক্রির পয়েন্ট কোনো রকম আগাম বার্তা না দিয়েই স্থানান্তরিত হয়। প্রতিবেদনে টিসিবির ট্রাক সেলের বিভিন্ন কেন্দ্রের যে চিত্র উঠে এসেছে তা কোনোভাবেই স্বস্তির নয়। আগে থেকে বিক্রয় স্পট না জানানোর কারণ হিসেবে টিসিবির ব্যাখ্যা হলোÑ আগেভাগে জানলে দূর-দূরান্ত থেকেও ভোক্তারা এসে ভিড় করেন। টিসিবির দায়িত্বশীলদের বক্তব্য, ‘যেসব স্থানে গাড়ি পাঠানো হয়, সেখানকার স্থানীয় বা আশেপাশের লোকজন যাতে পণ্য কিনতে পারেন এজন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঢাকায় প্রতিদিন ১৭০টি স্থানে পণ্য বিক্রির কথা থাকলেও গড়ে ৫০টি স্থানের বেশি কেন্দ্রে পণ্য বিক্রি করা হয় না। হাঙ্গামা ও বিশৃঙ্খলা হওয়ায়ও অনেক সময় স্থান বদল করা হয়।’ আমরা মনে করি, টিসিবির ট্রাক সেল কার্যক্রমে শৃঙ্খলা ফেরানো জরুরি।
আমরা আরও মনে করি, পণ্যের মজুদ চাহিদার নিরিখে বাড়ানো প্রয়োজন এবং নির্ধারিত বিক্রয়কেন্দ্রগুলোর স্থানেই টিসিবির পণ্য বিক্রি করা উচিত। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে যে অভিঘাত লেগেছে তাতে কিছুটা হলেও মানুষ যাতে স্বস্তি পায় এই লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালিত করা জরুরি বলে আমরা মনে করি। আমরা জানি, ১৯৭২ সালে সরকারের এই সংস্থাটি গঠনকালে কথা ছিল বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে সারা দেশে তা বিক্রি করা হবে প্রয়োজনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা হবে। কিন্তু টিসিবি একপর্যায়ে তার উদ্দেশ্য সফল করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিতে থাকে এবং ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ে। নানা মহল থেকে বহুবার দাবি জানানো হয়েছে, টিসিবিকে ঢেলে সাজিয়ে জনস্বার্থে যাতে প্রতিষ্ঠানটিকে অধিকতর কার্যকর করা হয়। কিন্তু কার্যত তা তো হয়ইনি, উপরন্তু জনবল সংকটে টিসিবির পক্ষে সীমিত পরিসরেও কার্যক্রম পরিচালনা করা দুরূহ হয়ে পড়ে। আমরা মনে করি, বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে টিসিবিকে শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সরকার নানারকম পরিকল্পনা করেও বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখাতে পারেনি। একদিকে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দাম অন্যদিকে বাজার ব্যবস্থাপনায় অসঙ্গতি ভোক্তার নাভিশ্বাস তুলেছে। দৃশ্যত বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ইতোমধ্যে পদক্ষেপ কম নেয়নি বটে, কিন্তু এর সুফল কেন দৃশ্যমান হলো না এর উৎসে নজর দেওয়ার তাগিদ এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা বহুবার দিয়েছি।
ক্যাবের তরফে বলা হয়েছে, টিসিবি যদি তাদের সহযোগিতা চায় তাহলে তারা নাগরিক সহযোগিতার উদ্যোগ নেবে। আমরা মনে করি, নাগরিক সমাজ ও ক্যাবসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো সহযোগিতা নিয়ে টিসিবি তাদের পণ্য বিক্রি কার্যক্রম চালাতে পারে। তবে শৃঙ্খলার পাশাপাশি পণ্যের মানের ব্যাপারে টিসিবিকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। আমাদের স্মরণে আছে ইতঃপূর্বে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অত্যন্ত নিম্নমানের পণ্য ভোক্তার কাছে বিক্রির অভিযোগ উঠেছিল। এর সত্যতাও মেলে। আমরা রাষ্ট্রায়ত্ত একটি সংস্থার দায়িত্বশীলদের কাছে এমন আচরণ প্রত্যাশা করি না। আমরা আশা করব, মানহীন কিংবা মেয়াদ উত্তীর্ণ কোনো পণ্যই যাতে টিসিবির কার্যক্রমে না থাকে। সর্বত্র এই বিষয়টি নিশ্চিত করা টিসিবির দায় বলেও আমরা মনে করি। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে টিসিবি যে উদ্যোগ নেয় তা প্রশংসিত হলেও সংস্থাটি জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী তাদের কার্যক্রম নিশ্চিত করতে পারেনি। আমরা মনে করি, বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সারা দেশে টিসিবির ট্রাক সেল কার্যক্রম জোরদার করা জরুরি। বাজার অস্থিতিশীল করতে অসাধু চক্র সদা তৎপর। তারা সিন্ডিকেট গড়ে ভোক্তার পকেট কেটে নিজেদের উদর ভরতে সক্রিয়। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে তারা দাপটে অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেও তারা যে নিষ্ক্রিয় নয়, এরও অনেক নজির ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে মোট জনগোষ্ঠীর অন্তত উল্লেখযোগ্য একটি অংশ যাতে ন্যায্যমূল্যে টিসিবির পণ্য কিনতে পারে, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। আমাদের দাবি, টিসিবির কার্যক্রমে শৃঙ্খলা ফিরুক এবং ভোক্তার সঙ্গে তাদের নৈকট্য যাতে বজায় থাকে সেই প্রচেষ্টা থাকুক।