× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সমাজ

শিশুরা থাকুক দুধে-ভাতে

আব্দুল বায়েস

প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:৫৬ এএম

শিশুরা থাকুক দুধে-ভাতে

এক.

বলিউড তথা মুম্বাইয়ের বিখ্যাত একটা ছায়াছবির নাম ‘মুন্না ভাই এমবিবিএস’। কেবলমাত্র মারপিট আর হইহুল্লোড় মার্কা নয়, নিতান্তই নিতল তাৎপর্যপূর্ণ, নিটোল ও শিক্ষণীয় একটা ছায়াছবি। ছবিতে দেখা যায়, নায়ক পেশাগত ডাক্তার নন; ডাক্তার হওয়ার শখ আছে কিন্তু সাধ্য নেই। তিনি ভয়ভীতি দেখিয়ে নকল করে, পরীক্ষা দিয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, ডাক্তার না হয়েও শিশুসুলভ গান, হাসি-তামাশা ও সংবেদনশীল মনের জন্য হাসপাতালের রোগীরা মুন্না ভাইয়ের ভক্ত হয়ে ওঠে। কথায় আছেÑ এলেম না থাকলে কী হবে, হেলেম বা কাণ্ডজ্ঞান তো আছে। বিখ্যাত ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন যা করতে পারে না, মুন্না ভাইয়ের ‘ডেসক্রিপশন’ তাই করে দেয়। অর্থাৎ তার মানবিক আচরণে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। কলেজের প্রিন্সিপাল এই ‘অপদার্থটাকে’ অপবাদ দিতে ও অপমান করতে যত ব্যস্ত, তার আদরের কন্যা প্রেমে পড়তে ততই শশব্যস্ত। 

দুই. 

একই অর্থে প্রত্যেক শিশুই এক ধরনের ডাক্তার। ‘পটল কুমার গানওয়ালা’ সিরিয়ালে দেখেছি হাসপাতালে ভর্তিকৃত শিশু পটলের গান শোনার জন্য অন্যান্য রোগী বিছানা ছেড়ে ছুটে আসে। ক্ষণিকের জন্য হলেও ব্যথা-বেদনা ভুলে যায়। শিশু নাতি-নাতনি দেখলে খুব অসুস্থ দাদিমারও ঠোঁটের কোণে হাসি মেলে আর চোখের কোণে আনন্দাশ্রু জমা হয়। আন্তর্জাতিক খেলাগুলোয় প্লেয়ারদের সঙ্গে হাত ধরে শিশু মাঠে যাওয়ার তাৎপর্য অনেকটা এ রকমই। এসবই শিশুদের ঐশ্বরিক ক্ষমতার নির্দেশক। আমরা হয়তো খেয়াল করি না যে, আমাদের প্রত্যেকের বাসায় প্রত্যেকটি শিশু ‘মুন্না ভাই এমবিবিএস’ বা পটল কুমারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাদের গায়ের স্বর্গীয় গন্ধ, চোটপাট ও চটপটে স্বভাব, গলা জাপটে ধরে দুগালে চুমু খাওয়া, বুদ্ধিমত্তা, চৌকস চাহনি ইত্যাদির জন্য হলেও আমাদের সব দুঃখ-বেদনা ভুলিয়ে দেয়; ভুল বোঝাবুঝি দূর করে। কথায় বলেÑ যে গান শুনতে ভালোবাসে না, সে মানুষ খুন করতে পারে। কথাটা অন্যভাবেও বলা যেতে পারেÑ যে শিশুকে ভালোবাসে না, সে মানুষ মারতেও পারে। আর তাই বুঝি বলা হয়ে থাকে ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুর অন্তরে’; ‘শিশু ফেরেশতার মতো’, ‘আজকের শিশু কালকের নেতা’ ইত্যাদি ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, শিশুর জন্ম মানে বিধাতা মানুষের প্রতি বিরাগভাজন নন। 

তিন.

কবি বলেছেন, সব শিশুর অন্তরে শিশুর পিতা ঘুমিয়ে থাকে, আজকের শিশু কালকের নেতাÑ এসবই সত্যি কথা। তবে শর্ত থাকে যে, শিশু যাতে সুস্থ দেহে ও মনে বেড়ে ওঠার সব সুযোগ পায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। এই দায়িত্বটা পুরোপুরি রাষ্ট্রের, বাজারের নয়। যেসব দেশে শিশু তথা ভবিষ্যৎ নাগরিকের ওপর বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে, সেসব দেশ বেশি উন্নতি করেছে। আবার বৈষম্যমূলক বিনিয়োগ উন্নয়ন, বৈরী হতে পারেÑ যেমন বাংলাদেশে। এই দেশে কিছু শিশুর পেছনে যেমন প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকা খরচ করা হচ্ছে; তেমনি কয়েক টাকার জন্য শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিপুলসংখ্যক শিশু। বাংলাদেশের মতো একটা দেশে শিশুদের আগামী দিনের নেতা কিংবা শিশুর পিতা হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু, তা নানা কারণে হুট করে বলা সম্ভব নয়। কেননা, এই সমাজে শিশুর ওপর বিনিয়োগ তো করেই না বরং শিশুর খেলার মাঠ কিংবা পার্ক, চিড়িয়াখানা দখল করে বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করে। সদ্য প্রসবিত শিশু থেকে ১৪ বছর বয়সি জনগোষ্ঠী হচ্ছে শিশু। পত্রিকায় যখন পড়ি যে, মানব অঙ্গ বিক্রির জন্য দেশের আইনের ফাঁকফোকরে শিশু পাচার হচ্ছে, তখন ভাবি এই পৃথিবী কি বাসযোগ্য? বাংলাদেশে ওই বয়সি শিশুদের প্রায় বিশ শতাংশ (৪৭ লাখ) শ্রমবাজারে অর্থাৎ কৃষি ও কলকারখানায় হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে মানবেতর জীবনযাপন করে; স্কুলে ভর্তি হলেও অভাব-অনটনে খুব তাড়াতাড়ি ঝরে পড়ে।

চার.

শিশুশ্রমের কথা না হয় আপাতত থাক। অনুমান করা বোধহয় অসংগত হবে না যে, বাংলাদেশে হিসাবকৃত ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। অর্থাৎ এরা মোট জনসংখ্যার ১০-১২ ভাগ। অন্য কথায় ধনী-গরিব, গ্রাম-শহর কিংবা ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে শিশুর সংখ্যা দেড় কোটি। অবশ্য ঠিক ২ বছর বয়সি শিশু ৭০ লাখের মতো হতে পারে। মজার কথা, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের নানা-নানি (যাদের বয়স ৬০ বছর+) ও ওদের সংখ্যা কাছাকাছি। অর্থাৎ বাংলাদেশে যত নাতি-নাতনি আছে প্রায় তত নানা-নানি আছে! অবশ্য মনে রাখতে হবে যে, ৬০ বছরের অনেক নিচেও অনেকে নানা-নানি হয়ে গেছেন। এই তো আমার দুই বছরের বড় বোন ৬৮ বছরেই পুতির সঙ্গে খেলা করছেন।

কিছু কিছু শিশু এক অর্থে খুবই ভাগ্যবান। তাদের বাবা-মা উচ্চশিক্ষিত এবং সচ্ছল পরিবার থেকে আসা। ধানমন্ডি কিংবা গুলশানের মতো অভিজাত এলাকার ফ্ল্যাটে যেমন শিশু থাকে আলোর মধ্যে, তেমনি শিশু থাকে বস্তিতে অন্ধকারে। বয়স অনুযায়ী সচ্ছল পরিবার থেকে আসা শিশুদের ওজন, উচ্চতা, কগনিটিভ স্কিল, আইকিউ ও বুদ্ধিমত্তা ঠিক মাত্রায় আছে বলে ধারণা করি। কিন্তু পৃথিবীতে সব শিশুর অবস্থা এমন নয়। সারা পৃথিবীতে প্রতিদিন ৫ বছরের কম বয়সি ১৬ হাজার শিশু মৃত্যুবরণ করে। এর মধ্যে আবার বৈষম্য আছে যেমনÑ স্বল্প আয়ের দেশে প্রতি এক হাজারে ৭৫ জন ও উচ্চ আয়ের দেশে প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে সাতজন মারা যায়। একসময় ছিল যখন বাংলাদেশের শিশুমৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি। ১৯৬০ সালে প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে প্রায় ৩০০ জন মারা যেত। এমনকি ১৯৯০ সালে মরত প্রতি হাজারে ১৪৪ জন। ২০১৪ সালে সেটা কমে এসে দাঁড়িয়েছে প্রতি হাজারে ৩৮। তার পর তা বোধকরি অন্যতম সর্বোচ্চ। ৫ বছর বয়সি শিশুমৃত্যুর মোট সংখ্যা এখন ৬০ লাখ, যা ১৯৯০ সালের ১ কোটি ২৭ লাখের তীক্ষ্ম বিপরীতে। কিন্তু এখনও যে পঞ্চম জন্মদিনের আগেই শিশু মারা যায় তা নেহাত কম নয়। ৫ বছর বয়সি শিশুদের মোট মৃত্যুর প্রায় অর্ধেক ঘটে থাকে প্রথম ২৮ দিনের মধ্যে এবং বলাবাহুল্য শিশুমৃত্যু অবধারিতভাবে সম্পর্কিত অপুষ্টির সঙ্গে। এটা সত্যি যে, গেল ৪০ বছরে খাদ্য উৎপাদন তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, দারিদ্র্যের ব্যাপক হ্রাস ঘটেছে এবং বুভুক্ষার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য কমেছে। কিন্তু পুষ্টিতে কিছুটা উন্নতি হলেও বর্তমান অবস্থা সুখদায়ক নয়। 

পুষ্টিসংক্রান্ত কিছু দুঃখজনক পরিসংখ্যানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। জাতীয়ভাবে ৫ বছরের কম শিশুর মধ্যে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে উচ্চতার তুলনায় কম ওজন নিয়ে রয়েছে ১৭ শিশু। আবার প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৪১ জন হালকা থেকে ব্যাপকভাবে খর্বকায় অর্থাৎ বয়স অনুযায়ী উচ্চতা কম। ৬-২৩ মাস বয়সি শিশুদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অ্যানিমিয়া আক্রান্ত। এটা অবশ্য স্বীকার করতে হবে যে, বিগত দশকগুলোয় শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টিগত অবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। এর জন্য বিশেষ কৃতিত্ব দাবি করতে পারে ব্র্যাকের মতো এনজিও, যেটা ওরাল স্যালাইন বিপ্লবের মাধ্যমে বিশেষত শিশুমৃত্যু হার রোধে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। তা ছাড়া সরকারের ইতিবাচক নীতিমালা শিশুমৃত্যুর হার রোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।

পাঠক হয়তো ভাবছেন যে, যেসব শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে তাদের বাবা-মায়ের আয় কম। অথচ এর বিপরীতে শিশু অভিজাত এলাকার বাবা-মার আয় বেশি বলে পুষ্টির দিক থেকে সে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে আছে। কথাটা আংশিক সত্যি। আয় বেশি হলে পুষ্টিসংক্রান্ত উন্নতির সম্ভাবনা বেশি থাকে, তবে উন্নতির নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। আন্তর্জাতিক খাদ্য ও নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইফরি) এক গবেষণায় দেখিয়েছে যে, বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রামে শিশু অপুষ্টির হার অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি অথচ এ দুটো জায়গায় মাথাপিছু আয় অন্যদের চেয়ে বেশি। সাউথ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত বাঙালি অধ্যাপক ড. মাহমুদ খান বলছেন, আয়ের নিরিখে ওপরের ২০ শতাংশ ও নিচের ২০ শতাংশে অপুষ্টিজনিত প্রকট সমস্যা আছে। তবে ওপরের ২০ শতাংশের সমস্যা বেশি খেয়ে (ওবেসিটি) আর নিচের ২০ শতাংশের সমস্যা কম খেয়ে! অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়নে দরকারি শর্ত (যথেষ্ট শর্ত নয়) তেমনি আয় বৃদ্ধি পুষ্টি উন্নয়নে দরকারি কিন্তু যথেষ্ট শর্ত নয়। পুষ্টি উন্নয়নে আয় বৃদ্ধির সঙ্গে শিক্ষা, সচেতনতা, উৎপাদন ও ভোগ বহুমুখীকরণ ইত্যাদি জোরালোভাবে জড়িত। অর্থনীতিবিদরা দেখিয়েছেন যে, পুষ্টি উন্নয়নের জন্য এক টাকা বিনিয়োগ করলে তা থেকে লাভ হয় ১৮-১৯ টাকা। আর এই লাভটুকু আসে পুষ্টিতাড়িত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কারণে।

পাঁচ.

সুখ বা দুঃখ সবসময়ই সাময়িক। সুখের পর দুঃখ আসে, দুঃখের পর সুখÑ যেমন করে আলোর পর অন্ধকার আর অন্ধকারের পর আলো। আমরা সবাই খুব আনন্দে আছি আমাদের নাতি আইহিয়াদ ও আরহামকে নিয়ে। যদিও কালেভদ্রে দেখা পাই, তার পরও যখনই তারা আসে তাদের নিয়ে ব্যস্ততায় দিন কাটে। মুন্না ভাই এমবিবিএস কিংবা পটলকুমার গানওয়ালার মতো আমাদের মাতিয়ে রাখে এই দুই শিশু– কখনও হাসিতে, কখনও কান্নায়। বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর সব আইহিয়াদ আরহাম যাতে থাকে দুধেভাতে সে কামনাই করি।

অবশেষে সব কাজ সেরে/ আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে/ করে যাব আশীর্বাদ,/ তারপর হব ইতিহাস। (‘ছাড়পত্র’ সুকান্ত ভট্টাচার্য্য)।

  • অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক, সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা