আইনশৃঙ্খলা-সামাজিক অস্থিরতা
ড. ফরিদুল আলম
প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৩৬ এএম
ড. ফরিদুল আলম
দেশ বর্তমানে একটি ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে রাষ্ট্রীয় কাজ সম্পাদন করতে হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বিভিন্ন দাবিতে রাজধানী উত্তাল ছিল। এ সরকারের মূল উদ্দেশ্য রাষ্ট্র সংস্কার এভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অসন্তোষ মেটাতে গিয়ে। এমন অবস্থায় সংস্কারের আগেই দ্রুত নির্বাচন নিয়ে যেমন দেশের ভেতরের একাংশের চাপ রয়েছে, আরেকাংশের চাপ রয়েছে সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পাদনের পর নির্বাচনের কাজটি সম্পন্ন হোক। এ উভয় চাপে বলা যায় সরকার দিশাহারা। ১/১১-এর পর অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য এ ধরনের সরকার ছিল না, যারা বেসামরিক উপায়ে এভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে।
২৭ নভেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশে ‘এত অস্থিরতার নেপথ্যে কারা’ শিরোনামে প্রতিবেদনের প্রথমাংশে বলা হয়েছে, যৌক্তিক-অযৌক্তিক নানা দাবি আর তুচ্ছ সব বিষয় নিয়ে আন্দোলনের নামে কথায় কথায় অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীসহ দেশের কোথাও-না কোথাও কিছু-না কিছু একটা ঘটেই চলেছে। শান্ত পরিবেশ হঠাৎ চরম অশান্ত হয়ে উঠছে। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, সংঘাত, ক্রোধ, আক্রোশ, প্রতিহিংসা সব যেন একযোগে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনের চিত্র একেবারেই করুণ। যেকোনো ইস্যু নিয়েই শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে তুলকালাম বাধিয়ে দিচ্ছে। বেশ কিছুদিন ধরে পোশাকশিল্পের শ্রমিকরা তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে যখন তখন রাস্তায় নেমে যাচ্ছে। আরও বলা হয়েছে, গত কয়েক দিন রাজধানীতে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে রাখে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। এ রকম আরও নানা ঘটনায় দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ছে।
অনস্বীকার্য বটে, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এখন খুব উদ্বেগজনক। নিয়মিত আন্দোলন, সড়ক অবরোধ, সচিবালয় ঘেরাও, নানা দাবিতে উত্তেজনা সৃষ্টি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর, মালামাল লুটের ঘটনায় প্রশ্নের তালিকা ক্রমাগত দীর্ঘ হচ্ছে। সংঘাতের জেরে ইতোমধ্যে বন্ধও হয়ে গেছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রাথমিক ভর্তি কার্যক্রমেও এর ধাক্কা লেগেছে। রাজধানীর কবি নজরুল সরকারি কলেজ এবং সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সর্বশেষ পুরান ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গত তিন মাসে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব ঘটনা ঘটেছে তা কোনোভাবেই স্বস্তির নয়। অথচ এমনটি কাম্য ছিল না। দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ প্রত্যাশা করেছিল, অন্ধকার ভেদ করে এবার সত্যিকার অর্থে শান্তি-স্বস্তির পথ সুগম হবে এবং অধিকারের পথে কোনো বাধা থাকবে না। রাষ্ট্র সংস্কারের সব কাজ গতিশীলতা পাবে। সমাজবিরোধী অপকাণ্ডের লাগাম টানা যাচ্ছে না। কেন? এ কেনর উত্তর সন্ধান সরকারকেই করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সবার আগে জননিরাপত্তা। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায় সরকারের।
যদ্দুর স্মরণে আছে এ ধরণের কিছু সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের পথে ১/১১ সরকারও হাঁটতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দ্রুত নির্বাচনের বিষয়ে সমন্বিত চাপ সৃষ্টির কারণে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সে সময় সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর ওপর আইনগত প্রক্রিয়া চলমান থাকার কারণে দ্রুতই সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন হারায়। এবারের বিষয়টি ভিন্ন। ১৫ বছর সাত মাস দেশ শাসন করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র এবং নির্বাচনব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ক্ষতি করা ছাড়াও বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের ওপর চরম দমনমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। এর ফলে এ মুহূর্তে দেশের রাজনীতিতে অন্য সব দল মিলে এখন অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। বলা যায়, এটি একটি কারণ, যার ফলে নির্বাচন নিয়ে অন্য দলগুলোর আওয়াজটা এতটা ব্যাপকভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে না। এর অর্থ এই নয় যে, দেশ খুব একটা ভালো চলছে। কয়েক মাস ধরেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে মানুষের অবস্থা যেমন নাকাল, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। দেশের পুলিশ বাহিনীর ওপর জনগণের অনাস্থা এবং পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়াÑ এ দুটি কারণেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সেনাবাহিনীকে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে।
চট্টগ্রামে উত্তেজনা বিরাজ করছে। বাংলাদেশ সনাতনী জগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে মামলা এবং তাকে গ্রেপ্তার কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে ২৬ নভেম্বর নজিরবিহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আদালত কর্তৃক জামিন নামঞ্জুর হওয়ার পর তাকে প্রিজনভ্যানে তোলা এবং তাকে কারাগার পর্যন্ত নিয়ে যেতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেশ বেগ পোহাতে হয়। এ সময় পাল্টাপাল্টি হামলায় একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবী নিহত হন। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। চিন্ময়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি জাতীয় পতাকার অবমাননা করেছেন, যার ফলে একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলা চলমান রয়েছে। বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এবং একই সঙ্গে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদও। তিনি আদৌ রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কোনো অপরাধ করেছেন কি না তা প্রমাণসাপেক্ষ বিষয়। আদালতের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলা আদালত অবমাননা, সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞ আদালতের আদেশ শিরোধার্য। তবে অপরাধীর অপরাধ যথাযথভাবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিলে অনভিপ্রেত অনেক কিছুই এড়িয়ে চলা যায়। বিগত সরকারের পতন এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের আগে-পরে এ ধরনের অনেক অপরাধের আলামত পাওয়া যাবে, যেগুলো রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে ফেলা যায়। আমরা কি এসব অপরাধ আমলে নিয়ে সব ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে দেখেছি? বরং এর উল্টো চিত্র অনেক দেখা গেছে। অপরাধীদের দল এবং মতাদর্শ বিবেচনা করে যখন ব্যবস্থা নেওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয় হয়, তখন সরকারের নিরপেক্ষতা ও আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ কাজ করে।
বললে অত্যুক্তি হবে না যে, দায়িত্ব গ্রহণের পর সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাবিধানে সরকার আন্তরিক প্রচেষ্টা দেখালেও মাঠ পর্যায়ে খুব একটা সুফল দেখা যায়নি। এর ফলে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্নভাবে মাঠে নেমে প্রতিবাদ জানাতে দেখা গেছে তাদের। বহির্বিশ্বেও বিষয়টি নিয়ে সরকারের প্রতি নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় যে, আমাদের নিজেদের অজান্তেই সংখ্যালঘুদের হয়তো একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শের ফ্রেমে বন্দি করে ফেলা হয়েছে। এর ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা কাজ করছে। মনে রাখতে হবে, ১৮ কোটি মানুষের এ দেশে যদি শতকরা ৮৮ শতাংশ মুসলিম হয়ে থাকে, তাহলে ২ কোটির অধিক মানুষ অন্য ধর্মাবলম্বী। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রেও সরকারকে সমান মনোযোগ দিতে হবে। এখানে চিন্ময় দোষী কি নির্দোষ, এ বিতর্ক ছাপিয়ে এখন বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের সংখ্যালঘুরা আসলেই নিরাপদ কি না। এমন প্রশ্নে আস্থার জায়গাটিতে বড় ধরনের চিড় ধরেছে। এটি মেরামতে আশু মনোযোগ দেওয়া অত্যাবশ্যক। কোনোকিছুই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
অস্থিরতার আরেক নাম ছাত্র আন্দোলন। মাত্র কমাস আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে এবং সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে একটি সরকারের ভিত ভেঙেচুরে গেল। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’Ñ এমন উক্তির যথার্থতা উপলব্ধি করেছি আমাদের জাতীয় জীবনে। বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে তাদের ছাত্র সংগঠনের ১৫ বছরাধিককালের অসংখ্য ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের সাক্ষী দেশের মানুষ। আবার এ ছাত্ররাই পরিবর্তন এনেছে, আমাদের চোখে নতুন স্বপ্ন এঁকে দিয়েছে। সামনে থেকে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। এর বিপরীত চিত্রও কি আমরা দেখছি না? কয়েক দিন ধরে মোল্লা কলেজের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী এবং কবি নজরুল কলেজের সংঘর্ষ যে ঘটনা ঘিরে, তা কি শুরুতেই থামানো যেত না? ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মোল্লা কলেজের একজন ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় যদি শুরুতেই ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে বিষয়টি এ পর্যায়ে এসে গড়াত না। বিষয়টি ঘিরে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার দৈন্যদশা এবং হাসপাতালে রোগীরা যে কত অসহায় এর একটি চিত্র আরেকবার ফুটে উঠল।
ছাত্রদের বিক্ষুব্ধ হওয়া দোষের কিছু নয়, বন্ধুর মৃত্যু কেন্দ্র করে আবেগের বশে একটি অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে গেল। তবে এখানে নিজেদের মধ্যে সংঘাত এবং সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়াও ভালো কিছুর নির্দেশ করে না। ব্যাপক ভাঙচুর এবং লুটপাটের মধ্য দিয়ে ছাত্রসমাজের গৌরব কি কলঙ্কিত হলো না? একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র হয়ে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো এবং ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে তারা খুব ভালো কোনো বার্তা দিল না। সেই সঙ্গে একে কেন্দ্র করে রাজধানীর আরও কিছু কলেজেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। ছাত্র রাজনীতি ভর করে নৈরাজ্যের লাগাম টানার কথা এতদিন ধরে অনেকেই বলে এসেছেন। সাম্প্রতিক ঘটনা সার্বিকভাবে ছাত্রদের দায়িত্বজ্ঞানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে। তারাও শুরুতেই আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারত। অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের আন্দোলন ঘিরে। এ ক্ষেত্রেও নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হয়। আজ থেকে ১০ বছরের অধিককাল ধরে আদালতের নির্দেশে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের রাস্তাগুলোয় এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুরুতে এটা কার্যকর করা নিয়ে বেশ বেগ পোহাতে হলেও এক পর্যায়ে এ সিদ্ধান্তটি কার্যকর করা সম্ভব হয়। হঠাৎ করে কোন যুক্তিতে এগুলো আবারও চলাচলের অনুমতি দেওয়া হলো, সেটা একটা প্রশ্ন।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বর্তমানে ভালো যাচ্ছে না। এ রিকশাগুলোর চালকরা কেউ নিজের পয়সায়, আবার কেউ বা জমার বিনিময়ে রিকশা চালিয়ে রোজগারের যে বন্দোবস্ত করেছিল, উচ্চ আদালত কর্তৃক তা বন্ধ করার নির্দেশনার পর রাজধানীতে কয়েক দিন ধরে এ রিকশাচালকরা সমাবেশ এবং আন্দোলনের নামে তাদের দাবি জানিয়ে আসছিল। বিষয়টি নিয়ে চেম্বার আদালত কর্তৃক এক মাসের স্থগিতাদেশ সমস্যার সাময়িক সমাধান দিলেও বাস্তবে এটি বন্ধ করা-না করা উভয়ই নগরের জন্য নতুন সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এ অবস্থার উত্তরণে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রেখে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারলে এ সমস্যার একটি কার্যকর সমাধান পাওয়া যেত। সর্বত্র বিরাজমান এসব অস্থিরতা একটি সরকারের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত করে। নতুন একটি সরকারের জন্য সহসা সব সমস্যার সমাধান দেওয়া সম্ভব নয়। অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যায় অল্পতেই ধৈর্যচ্যুতি সমস্যার পরিধি আরও বিস্তৃত করে।