পরিবেশ
মো. অহিদুর রহমান
প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৩৩ এএম
মো. অহিদুর রহমান
প্রকৃতি ধ্বংস করে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। অনেক উন্নয়নকাজ হয়েছে বা হচ্ছে, যা পরিবেশবান্ধব নয়। প্রকৃতি সংরক্ষণে বেশ পিছিয়ে বাংলাদেশ। ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৩তম। নদী, বন, পাহাড়, পুকুর, বিল, গাছ, হাওর, হিজলবন, সমুদ্র, ম্যানগ্রোভ, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ, পলিথিন বর্জন, দেশি প্রযুক্তি গ্রহণ, রাসায়নিকের ব্যবহার কমানো, টাঙ্গুয়ার হাওর, হালদা নদী, মাটিদূষণ রোধ, সুন্দরবন, কৃষিজমি সুরক্ষা করেই বাংলাদেশের মানুষকে টিকে থাকতে হবে। প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমাদের টিকে থাকার কোনো সুযোগ নেই। যে বাস্তুতন্ত্রের ওপর নির্ভর করে আমাদের জীবন গড়ে উঠেছে সে পরিবেশ-প্রতিবেশ উপেক্ষা করে অস্তিত্ব বাঁচানো সম্ভব নয়। বাংলাদেশে অধিকাংশ নদী ভরাট ও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অনেক খাল আজ আর নেই। নদী কেন্দ্র করে চলত কৃষকের কাজ। এ অঞ্চলের খাদ্যযোদ্ধারা বন্যা, খরা, বজ্রপাত, প্রতিকূল পরিবেশ, আফাল, ঢেউ, রোগবালাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে ঘরে তুলত সম্পদ। নদী থেকে পানি তুলে সেচ দিয়ে চলত কৃষিকাজ। বর্তমানে নদী শুকিয়ে যাওয়ায় নেত্রকোণা অঞ্চলের কৃষক সেচের জন্য সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে মাটির নিচের পানির ওপর।
বাংলাদেশের সর্বত্র আছে বিল। যে বিলের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে প্রান্তিক মানুষ। বিলগুলো ভরাট হয়ে গেছে। গ্রামে ও শহরে যেসব বড় পুকুর ছিল তা ভরাট করে আকাশচুম্বী স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। চলনবিল, বাইক্কার বিল, বিল আড়িয়ল খাঁ, বিলডাকাতিয়া, বড়বিল, তাগরাই, কেশপাথার বিল, নুরন্দিবিল, গোবিন্দচাতাল বিল, চকচকি, ঘুগরি, কাঞ্চন, মালদা, উতরাই, সানাবিল, কুমার, চাতলা, বালিঝুড়ি, চটানাইক্কা বিলসহ শত শত জলাধার দেশের মিঠাপানির মাছ প্রজননে কাজ করে যাচ্ছে। এসব রক্ষা করা জরুরি। পাহাড় কেটে পরিবেশ বিনষ্ট করা হয়েছে। পাহাড়ে আজ গাছ নেই, সবুজায়ন নেই, পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করা হয়েছে। বন্য প্রাণী আজ বিলুপ্ত। আদিবাসীদের অনেক খাদ্য পাহাড় থেকে সংগ্রহ করা হতো। আমাদের বড় বড় ৪২৩টি হাওরের পরিবেশ ভালো নেই। হাওরের ওপর এক ধরনের নির্যাতন চলছে। হাওরের মাছ কমছে। হাওরের জলজ খাবার বিলুপ্ত। হাওরের পানিতে রাসায়নিক প্লাস্টিক দিনদিন বাড়ছে। টাঙ্গুয়া, হাকালুকি, তলার হাওর, সনির হাওর, ডিঙ্গাপোতার হাওরসহ সব জলাভূমি কিডনির মতো কাজ করে।
নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত দুই দশকে বাংলাদেশের নদীগুলোয় ভারী ধাতুর কারণে দূষণের মাত্রা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। হাওরের ওপর উন্নয়নের নামে মহাসড়ক তৈরি করা হচ্ছে। পর্যটনের নামে দূষণ করা হচ্ছে। এসব দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষতিপূরণের জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। ২০২৪ সালের ১২ জুলাই এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলিউশন রিসার্চে প্রকাশিত গবেষণায় ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১০টি ভারী ধাতুর (এএস, পিবি, সিডি, সিআর, এফই, এমএন, সিইউ, সিও, এনআই, জেডএন) দূষণের প্রবণতা পরীক্ষা করে দেশের জলপথের ভয়াবতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। গবেষণায় দেখা যায়, ২০০১-২০১০ সালে যে পরিমাণ দূষণ হয়েছিল, সে তুলনায় পরের দশকের (২০১১-২০২০) দূষণের মাত্রা অনেক খারাপ ছিল। ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদী বাংলাদেশের সবচেয়ে দূষিত নদী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ১৮০ দেশের মধ্যে এ দেশের অবস্থান ১৭৩তম। তালিকায় শীর্ষে রয়েছে লুক্সেমবার্গ। এরপর যথাক্রমে এস্তোনিয়া ও ডেনমার্ক। সর্বশেষ অবস্থানে রয়েছে কিরিবাতি। নিজ নিজ দেশে প্রকৃতি রক্ষায় রাষ্ট্রগুলো কতটুকু ভূমিকা রাখছে তার ভিত্তিতে এ সূচক তৈরি করা হয়েছে।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা বায়ো ডিবি তৈরি করেছে সূচকটি। মূলত প্রকৃতি রক্ষায় গত এক যুগে দেশগুলোর নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ মূল্যায়নের ভিত্তিতে সূচকটি তৈরি করা হয়েছে। জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্যবিষয়ক সম্মেলন ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস টু দ্য কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি’ (সিবিডি কপ ১৬) উপলক্ষে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক বৈশ্বিক সূচকটি তৈরিতে পাঁচটি নির্দেশক ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো হলো প্রকৃতি সংরক্ষণে রাষ্ট্রের ভূমি ব্যবস্থাপনা, জীববৈচিত্র্যের ওপর হুমকি, সক্ষমতা, সুশাসন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো হলো ভূমি ও সাগরের সংরক্ষিত এলাকার পরিমাণ; সংরক্ষিত এলাকাগুলো একটির সঙ্গে অন্যটি কতটা যুক্ত; শহর, শিল্প ও কৃষিজমির পরিমাণ কত দ্রুত বাড়ছে এবং কৃষিতে কী পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে।
জীববৈচিত্র্যের ওপর হুমকির ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো দেশের মোট বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে কতটি লাল তালিকা বা নানাভাবে হুমকিতে রয়েছে। তালিকা তৈরিতে এগুলোর সংখ্যা ও পরিমাণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আছে সংরক্ষিত এলাকায় কত প্রাণীর বসবাস ও আগ্রাসি প্রজাতির প্রাণীর উপস্থিতির বিষয়টি। সূচকের অন্য নির্দেশকগুলোর মধ্যে আছে একটি দেশে জিডিপির কত শতাংশ প্রকৃতি সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়, প্রকৃতি সংরক্ষণে কতটি সংস্থা ও আইন আছে, আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য সনদের শর্তগুলো কতটা বাস্তবায়ন করা হয়; রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, সরকারের কার্যক্ষমতা এবং গণতান্ত্রিক অবস্থা। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার অন্যতম উপাদান গাছ। আমরা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে গাছ কর্তন করছি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আবাসন, কলকারখানা নির্মাণের নামে নির্বিচার বৃক্ষ কর্তন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে যেখানে ২৫ ভাগ বন থাকার কথা সেখানে আছে মাত্র ১৭ ভাগ। এর ফলে অক্সিজেনের সংকট হচ্ছে। বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে। বন্যপ্রাণী তাদের আবাসস্থলে থাকতে না পারলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। বন যেমন অক্সিজেন সরবরাহ করে, তেমন দূষিত কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে নেয়, যা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করে। গ্রিনহাউস গ্যাস কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে বাড়ছে। ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। বরফ গলে সমুদ্রের পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। সাগরের পানি বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় অঞ্চল প্রবাহিত হয়ে সমস্যার সৃষ্টি করছে। উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে।
বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, দাবানল, খরা, ধূলিঝড়, ভূমিধস, ভূমিকম্প ইত্যাদি জলবায়ু পরিবর্তনেরই ফল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে বিভিন্ন দেশে জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, দাবানল, ভূমিধস, ধূলিঝড়ের আবির্ভাব ঘটছে। প্রকৃতিকে ভালোবেসে তাকে সংরক্ষণ করতে হবে। প্রকৃতি ও মানুষ অবিচ্ছেদ্য। তাই প্রকৃতিকে ভালোবাসতে না জানলে কখনও প্রকৃতির সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যাবে না। আমাদের অনেকেরই পরিবেশবিষয়ক শিক্ষা নেই। সচেতনতার অভাব সর্বত্র। তরুণরাই ভবিষ্যৎ। আসুন প্রকৃতিকে বাঁচাই, প্রকৃতি আমাদের বাঁচাবে।