× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আইনশৃঙ্খলা

জননিরাপত্তায় অভিঘাতে বহুমাত্রিক উপসর্গ

ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৩৮ এএম

ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

২৬ নভেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশসহ সহযোগী সংবাদমাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বেপরোয়া সংঘাত-সংঘর্ষের সংবাদ সচেতন মহলে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা দেখছি, যে কোনো ঘটনায় আন্দোলন কিংবা প্রতিবাদের দাবির ভাষা সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বাইরে সামাজিক এই অস্থিতিশীলতা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য যে বাড়তি চাপ তৈরি করেছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। গত ২৪ নভেম্বর ‘মেগা সানডে’ নামক একটি কর্মসূচিতে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজসহ আরও ৩৪ কলেজের শিক্ষার্থীরা ভাঙচুর চালায় সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে। এক দিন পর অর্থাৎ ২৫ নভেম্বর রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে ডেমরা এলাকা। একটি গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের এমন বেপরোয়া আচরণ সংগত কারণেই সাধারণ মানুষের কাছে নেতিবাচক বার্তা পৌঁছেছে। বিশেষত বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমরা দেখছি দেশব্যাপী প্রতিটি পক্ষেরই ভাবমূর্তির সংকট দেখা দিচ্ছে। 

পুলিশ কিংবা অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রশ্নবিদ্ধ এবং কার্যত সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে না পারায় তাদের ভাবমূর্তি চরমভাবে ভেঙে পড়েছে। এমনকি মাঠপর্যায়ে দীর্ঘদিন থাকায় সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এবার শিক্ষার্থীদের বিষয়ে সাধারণ মানুষের মনে নেতিবাচক ভাবনার উদয় ঘটেছে। দেশে ক্রমবর্ধমান হারে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। চুরি-ছিনতাই, ধর্ষণের হার উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। বাজারের তাপে-চাপে পিষ্ট সবাই। পাশাপাশি মব একত্রিত হয়ে প্রায়শই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে এবং এসব কিছুর প্রভাব পড়ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়। এক্ষেত্রে আমরা নানাবিধ তর্ক-বিতর্কও দেখতে পাচ্ছি। এসব কিছুই আমাদের সামাজিক নৈরাজ্যের একটি বড় সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। 

শিক্ষার্থী হোক কিংবা যেকোনো দাবি-দাওয়াই হোক, শেষ পর্যন্ত আমরা দেখছি একধরনের মবই একত্রিত হতে শুরু করেছে। এই মব একত্রিত হয়ে সড়ক অবরোধ করে রাখছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তা সংঘাতে রূপ নিচ্ছে। মূলত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে সংস্কারের দাবি কিংবা নিজ অধিকারের দাবিতে সড়কে নেমে যাওয়ার সূত্রপাতও এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই। বিগত পনেরো বছর দেশের মানুষের ওপর একধরনের চাপযুক্ত শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে রাখা হয়েছিল। এই পনেরো বছর মানুষের ভেতর জমে থাকা আকাঙ্ক্ষা ও দাবি-দাওয়ার স্ফূরণ ঘটছে। কিন্তু তা প্রকাশের ক্ষেত্রে এখনও সমাজ সেই পুরোনো জিম্মি কায়দা অনুসরণ করছে। এমনটি অস্বাভাবিক নয়, কারণ পনেরো বছর এমন সামাজিক পরিবেশেই যেহেতু তারা বেড়ে উঠেছে তাই অনেকটা অবচেতনভাবেই এমন আচরণ তাদের মননে প্রোথিত হয়ে রয়েছে। যেকোনো অভ্যুত্থান কিংবা সামাজিক পরিবর্তনের পর অরাজক পরিবেশ তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। যেহেতু নতুনভাবে সৃষ্ট প্রেক্ষাপটে একটি রাজনৈতিক সরকারের পতন ঘটেছে, তাই দেশের প্রশাসনিক কাঠামো থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পর্যন্ত কিছুটা উদাসীন পরিস্থিতিতে রয়েছে। দেশের এই নাজুক পরিস্থিতিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম অত্যন্ত প্রশাসনিক কিংবা ব্যবস্থাপনাগত আঙ্গিকে যোগ্য, দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সরকার গঠিত হয়েছে। কিন্তু জননিরাপত্তা প্রসঙ্গে যে ধরনের পূর্বপরিস্থিতি কিংবা অবস্থার প্রাক্কলন জরুরি তা সরকার নিতে পারেনি। অভ্যুত্থানের পর জননিরাপত্তা পরিস্থিতি নেতিবাচক হবেÑ এ বিষয়ে আগে থেকেই সতর্ক পূর্বপ্রস্তুতি কিংবা হোমওয়ার্ক করা জরুরি ছিল। তা করা হয়নি বলেই পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে এগিয়েছে। 

দেশে অরাজকতা কিংবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়টি পূর্বানুমান করা উচিত ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে ঘাটতির অভিযোগ উঠেছে। কারণ বিগত সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অর্থাৎ পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা এমনিতেই কমে গিয়েছিল। তা ছাড়া আন্দোলন চলাকালে পুলিশের ভূমিকা প্রবল জনরোষ জাগিয়েছিল। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা পটপরিবর্তনের পর পলাতক, কারণ তারা নিজেরা প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সাবেক পুলিশপ্রধান হত্যা মামলায় জেলে। আরও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও আইনি হেফাজতে বিচারাধীন। আগে পুলিশের উর্দির প্রতি মানুষের একধরনের আতঙ্ক ছিল। আর এখন তৈরি হয়েছে অবজ্ঞা। ফলে পুলিশে কর্মরত অনেকেই আত্মবিশ্বাসের অভাবে রয়েছে। বিশ্বের ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। কোনো রাষ্ট্রের রক্ষার দায়িত্বে নিযুক্ত পুলিশ বাহিনীর অনেকেই পলাতকÑ এমনটি আর কোথাও ঘটেছে বলে জানি না। শুধু তাই নয়, মাঠপর্যায়ে পুলিশ কার্যকরভাবে আইন প্রয়োগ করতে পারছে না। এক্ষেত্রে মব জাস্টিসকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই সাধারণ মানুষ পুলিশের প্রতি অবজ্ঞাবশত অনেক সময় পুলিশের কাজে বাধা দিচ্ছে। একই প্রভাব সেনাবাহিনীর প্রতিও লক্ষ করা যাচ্ছে। 

দেশের মানুষ সেনাবাহিনীকে সম্মান ও আস্থার দৃষ্টিতেই দেখে। পটপরিবর্তনের পর সেনাবাহিনীকে মানুষ সাদরে বরণ করেছে এবং সেনাবাহিনীও পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। কিন্তু আমরা দেখছি, সম্প্রতি সামরিক বাহিনীকেও অবজ্ঞা করতে শুরু করেছে অনেকে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগরীতে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকেরা সড়ক অবরোধ করে। সেখানে তারা তাদের দাবি উপস্থাপন করেছিল। তখন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা তাদের আশ্বস্ত করতে গেলে অনেকে আগ্রাসী আচরণ করে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, বনানীতে কোথাও থেকে একটি ঢিলও ছুড়ে মারা হয় বিধায় সেনাবাহিনী বলপ্রয়োগ করতে বাধ্য হয়। এই যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা না রাখা, এটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগের। আর আইনের প্রতি শ্রদ্ধা না রাখার ফলে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজটি ক্রমেই দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এর আগে গোপালগঞ্জে আমরা দেখেছিÑ সামরিক বাহিনীর গাড়ি ভাঙচুর করতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গাড়ির ওপর চড়ে বসার মতো কাজ করতেও। এমন কাজ হয়তো সবাই করে না, কিন্তু সামগ্রিকভাবে তা আন্দোলনকারীদের ওপরই বর্তায়। অর্থাৎ আমাদের চারপাশে এই সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। 

গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিচার করে দেশের মানুষ স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিল। সেই শিক্ষার্থীরা একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া সত্যিই দুঃখজনক। বরং বিষয়টি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভক্তির কালো রেখা বলেই বিবেচিত হচ্ছে। আবার দেশের মানুষ যেকোনো দাবিতে রাস্তায় নেমে পড়ছে। তারা সড়ক অবরোধ করায় সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে পড়ছে। এমনটি স্বাভাবিক জীবনে একটি বাড়তি দুশ্চিন্তা যা ক্রমেই ক্ষোভে রূপান্তরিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে যখন ন্যায্য দাবি উপস্থাপিত হবে তখন পূর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে অনেকে তাতে সমর্থন দেবে নাÑ এ বিষয়েও সমাজের প্রত্যেকটি অংশকে অনুধাবন করতে হবে। 

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে একটি দেশের মানুষের মধ্যে জাতীয় স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধার বিষয়ে যে মানসিক পরিপক্বতা দেখানো প্রয়োজন ছিল, তা এখনও গড়ে ওঠেনি। বরং এই অপরিপক্বতার দরুন সাংঘর্ষিক নানা বক্তব্যই তারা উপস্থাপন করছে। আমরা দেখছি, যেকোনো আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায়িত্ব পালন করতে গেলেই মানবাধিকারের প্রসঙ্গ চলে আসছে। ডেমরায় শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের পর যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অ্যাকশনে গেলে আরও রক্তপাত হতো। তার এই বক্তব্য অমূলক নয়। কারণ পুলিশ যদি বাধা দেয় তাহলে সমালোচনা আসছে মানবাধিকারে আঘাত। হাইওয়েতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে অটোরিকশা চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করাও মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে অনেকে অভিহিত করছে। 

সংগত কারণেই প্রশ্ন করতে হয়, মানবাধিকার কি নিজেও একধরনের আইন নয়? আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে মানবাধিকারে অভিঘাত লাগছে। দীর্ঘদিন ফুটপাত দখল করে সাধারণ মানুষের নিরাপদে হাঁটাচলার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। এখন যখন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে অবকাঠামোগত উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তখন তা মানবাধিকার লঙ্ঘন কীভাবে হয়Ñ এ প্রশ্নটিও সচেতন মহলের একাংশের প্রতি রাখতে হয়। দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ার ব্যর্থতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চাপিয়ে দিলেই সমাধান পাওয়া যাবে না। সরকার এক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ না নিয়ে কেন নমনীয় অবস্থান নিয়েছেÑ সেটিও ভাবনার বিষয়। অভ্যুত্থানের পর এইচএসসির শিক্ষার্থীরা পথে নেমে আসে। তাদের দাবি, অটোপাস দিতে হবে। সে দাবি সরকার মেনে নেওয়ার পর যারা অকৃতকার্য হলো, তারা আবার সচিবালয় ঘেরাও করলÑ ফলে বৈষম্য করা হয়েছে। তা ছাড়া স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের যেভাবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে তা-ও দৃষ্টিকটু ছিল। ওই সময় শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদের সহায়তায় পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি ছিল। তা ছাড়া সরকারের এই নমনীয় ভাবটিও অনেকাংশে বেপরোয়াকে উৎসাহিত করেছে। তারই বিরূপ প্রভাব আমরা দেখছি সমাজে। অথচ এই সরকারের দায়িত্বশীল প্রত্যেকেই অনেক যোগ্য। তাদের কাছে প্রত্যাশাও অনেক। আর প্রত্যাশা অনেক বিধায় তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নও স্বাভাবিকভাবেই বেশি হবে। বিষয়টি অনুধাবন করতে না পারলে আগামী দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। যেকোনো মূল্যে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির দায় সরকারের। নৈরাজ্য থামাতেই হবে। প্রতিবাদ কিংবা আন্দোলনের নামে সহিংসতা মেনে নেওয়া যায় না।

  • অবসরপ্রাপ্ত মেজর, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা