কৃষি-শিল্প
এম আফজাল হোসেন
প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:০০ এএম
এম আফজাল হোসেন
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের অন্যতম উৎস কৃষি খাত নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক বিরূপ অভিঘাতের প্রভাব পড়েছে চা উৎপাদন ও আনুষাঙ্গিক ব্যয়ে।। চা বাগানগুলো ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে শুরু করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ অঞ্চলের আবহাওয়ার স্বাভাবিকতায় পরিবর্তন আসায় চা উৎপাদনের প্রচলিত কৌশল অনেকাংশেই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। দেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় এ খাতের তদারকি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চা বোর্ডকে (বিটিবি) দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ শিল্প খাতের নিরাপত্তা এবং খাতসংশ্লিষ্ট কর্মী ও শ্রমিকদের জীবিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রতিঘাত পড়বে। এ ক্ষেত্রে চা শিল্পকে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রথমত এ খাতের অর্থনৈতিক গতিশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি। দেশের চা বাগানগুলোয় নিলামের দর উৎপাদন খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় চা বাগানগুলো প্রত্যাশিত লাভ আদায় করতে পারছে না। বাংলাদেশ চা বোর্ডকে পণ্যের দামে সমন্বয়ের পাশাপাশি উৎপাদকদের সহযোগিতার জন্য নানা উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে দামের নীতিমালা, বিপণন প্রক্রিয়া উন্নত করার পাশাপাশি পণ্যের গুণগত মান পর্যবেক্ষণে বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে। দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশের বাজারে চায়ের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারক পর্যায়ের উদ্যোগ এ শিল্পকে নাজুক অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে।
আমরা
জানি, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ অভিঘাত লাগতে শুরু করেছে দেশের আবহাওয়ায়। আবহাওয়া আরও উষ্ণ এবং আর্দ্রতা কমতে শুরু করেছে।
মৌসুমে এ তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে। মাত্রাতিরিক্ত উত্তাপে
সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় বলে চায়ের চারা বেড়ে ওঠে দেরিতে। এ সমস্যা
সমাধানে প্রতিটি চা বাগানে ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। চা বাগানে সেচের
জন্য ভিন্ন পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হবে। তা ছাড়া চা বাগানে আর্দ্রতা বাড়ানোর জন্য
গগনশিরীষ কিংবা নিমের মতো লম্বা গাছের সারি দিইয়ে বাগানে বেষ্টনী তৈরি করতে হবে।
এভাবে চা বাগানে উষ্ণতা কমানো সম্ভব। চা বাগানের ভেতরেই মাইক্রোক্লাইম্যাট
প্রস্তুতের আধুনিক পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হবে। এভাবে চা বাগানে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস
তাপমাত্রা ধরে রাখা কঠিন কিছু নয়।
১৯৬০ সালে পাকিস্তান টি বোর্ড এক জরিপের মাধ্যমে চা উৎপাদনে সেচব্যবস্থা
গড়ে তোলার গুরুত্ব উত্থাপন করে। অবশ্য তাদের এ ব্যবস্থায় উৎপাদন মাত্র ১০ শতাংশ
বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ হার কৃত্রিম ব্যবস্থাপনায়
আরও বাড়ানো সম্ভব বলেই অনুমিত। এ ক্ষেত্রে দেশের কৃষিবিদ ও আবহাওয়াবিদদের সমন্বিত
গবেষণা জরুরি। পূর্ববর্তী গবেষণাগুলো বিবেচনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের
গবেষণার মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি নতুন কৌশল প্রণয়নের বিষয়টিতেও জোর দিতে হবে। আধুনিকায়নের
মাধ্যমে চা বাগানে উৎপাদন ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব। চা বাগানের উৎপাদন বাড়লে
তা আমাদের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে। বিটিআরআইকে পানি ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে
নতুন ব্যবস্থার প্রণয়ন করতে হবে। যদি দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়া যায় তাহলে এ
শিল্প খাত টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। দেশে চা বাগান দেশের মোট ভূমির ১ শতাংশ হলেও
সবুজের সমারোহ এ চা বাগান বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন নির্গতের ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখে। চা
বাগানের সুরক্ষা নিশ্চিত করা শুধু অর্থনীতি নয়, আমাদের বাস্তুতান্ত্রিক
স্বাস্থ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
চা বাগানে চারার গুণগত মান ও উচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ চা
গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিটিআরআই) উদ্ভাবিত ক্লোনাল প্লান্টের ব্যবহার বাড়ানো যেতে
পারে। বাই-ক্লোনাল বীজের মাধ্যমে অন্তত ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ক্লোনাল প্লান্ট বপন করা
গেলে উৎপাদন বাড়বে। চায়ের গুণগত মান বাড়লে ভালো মূল্যও পাওয়া যাবে। চা উৎপাদনে
সেচব্যবস্থা তৈরি করা গেলে মৌসুম নয় অর্থাৎ অক্টোবর-নভেম্বরেও নতুন চারা রোপণ করা
যাবে। ফলে ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যেই পূর্ণ চারা পাওয়া যাবে। এমনটি আমাদের
কৃষি খাতের জন্য বড় সাফল্য হবে এবং অর্থনীতিতেও বাড়তি সহযোগিতা নিশ্চিত করা যাবে।
এ ক্ষেত্রে বিটিআরআই যদি শীতকালীন চাষ এবং বর্ষাকালে চা চাষের ক্ষেত্রে তুলনামূলক
গবেষণার উদ্যোগ নেয় তাহলে এ খাত বছরব্যাপী উৎপাদনের সক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারবে।
পুরোনো চা বাগানগুলোর মাটির উর্বরাশক্তি ক্রমেই কমতে শুরু করেছে। এখন
উৎপাদন বাড়াতে বাগানগুলোয় ১ শতাংশ জৈবসার ব্যবহার করা হয়। রাসায়নিক সারের ব্যবহারই
হয় বেশি। কিন্তু মাটির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধির বিষয়টিকে জলবায়ু পরিবর্তনের
প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করে ভার্মিকম্পোস্ট এবং অন্যান্য জৈব উপাদান ব্যবহারে উৎসাহিত
করতে হবে। এ ধরনের সার উৎপাদনের কৌশলের প্রশিক্ষণ এবং সরবরাহও নিশ্চিত করতে হবে। এভাবে
রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরতা কমানো যাবে। এ ক্ষেত্রেও বিটিআরআইকেই উদ্যোগ নিতে
হবে। চা বাগানগুলোয় এ বিষয়ে সচেতনতা কার্যক্রম চালাতে হবে। বিশেষত অর্গানিক
ফার্মিংয়ের ধারণাগুলো বাস্তবায়ন করার বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে। বিশেষত সিলেটের
ভৌগোলিক অবস্থান এবং মাটির গুণাগুণ বিচার করলে এ উদ্যোগ সফল হওয়াই স্বাভাবিক।
বেশ কয়েকটি চা বাগানে ইতোমধ্যে বায়োগ্যাস প্লান্ট পাইলট প্রোগ্রাম আকারে স্থাপন
করা হয়েছে। প্রতিটি প্লান্টে ১০০ লেবার হাউসে বায়োগ্যাস ফ্যাসিলিটি সংযুক্ত করা
হয়েছে। এ আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের মাধ্যমে জ্বালানি
ও বিদ্যুৎ সরবরাহের পথ যেমন উন্মুক্ত হচ্ছে তেমন জৈবসারও উদ্বৃত্ত হিসেবে পাওয়া
যায়। এ ক্ষেত্রে গবাদি পশুর খামার স্থাপন করে বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরির পথও রয়েছে। চা
বাগানের কর্মীদের দুধ ও মাংসের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি গবাদি পশুর গোবরকে সার
হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। সফল পাইলট প্রকল্পগুলো অন্য চা বাগানে ছড়িয়ে দেওয়ার
জন্যও নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ কনসালট্যান্ট এবং গবেষণা
প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা বিশেষ উৎসাহদায়ক হয়ে উঠবে।
সম্প্রতি চা বাগানের জন্য ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নির্মূলে বিটিআরআই বিশেষায়িত
একটি শাখা খুলেছে। বিষয়টি ইতোমধ্যে এ খাতসংশ্লিষ্টদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাদের এ
অভিনব উদ্যোগের মাধ্যমে কীটনাশকের ব্যয় কমবে এবং পরিবেশ ও মাটি দূষণের হারও কমানো
সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু চা বাগানের পাইলট প্রকল্পগুলোর সঙ্গে এখনও তাদের এ
ব্যবস্থাপনার সমন্বয় করা যায়নি। যদি তা করা যায় তাহলে চা উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব
এবং উদ্ভাবনী প্রকল্পগুলোও ব্যয় কমিয়ে সফলতার মুখ দেখবে।
মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চা বাগান ব্যস্ত সময় পার করে। এ সময় নির্বিঘ্ন
বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে পাওয়ার সাপ্লাই একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।
উৎপাদনের গতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য তাই বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের বিকল্প নেই। দুঃখজনক
হলেও সত্য, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড এ ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সক্ষমতা
দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। এ বাস্তবতা শুধু চা বাগানের নয়, দেশের সামগ্রিক
কৃষিব্যবস্থার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পল্লী বিদ্যুৎ তাদের কার্যক্রম পরিচালনা এবং বিল
আদায়ের ক্ষেত্রেও আধুনিক ব্যবস্থার দ্বারস্থ হতে পারেনি। কিছুটা প্রত্যন্ত অঞ্চলের
চা বাগানের ব্যবস্থাপনায় থাকা অনেকেই তাই ভোগান্তির শিকার হন। এত বাধাবিপত্তি সহ্য
করেও চা বাগানগুলো সঠিক সময়ে বিদ্যুৎ বিল দিয়ে থাকে। তার পরও যদি নিরবচ্ছিন্ন
বিদ্যুৎ সরবরাহ না করা যায় তাহলে তা এক ধরনের বড় ব্যর্থতা।
চা বাগানগুলো এজন্যই আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহারে উৎসাহী হতে পারছে না। চা
বাগানের ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের বেতনভাতায় বড় খরচ বহন করতে হয়। উৎপাদনের স্বার্থে
শ্রমের চাহিদাও দিনদিন বাড়ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাড়তি শ্রমিক নিয়োগ দেওয়াও সম্ভব
হয় না। ফলে চা বাগানের কর্মীদের বাড়তি কাজও করতে হয় অনেক সময়। এ ক্ষেত্রে আধুনিক
যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো গেলে শ্রমিকদের ওপর যেমন চাপ কমে তেমন চা উৎপাদনের
গতিশীলতা নিশ্চিত হয়। এজন্য গবেষণা ও আধুনিক জ্ঞানের উপস্থাপনা জরুরি। স্থানীয়
বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে প্রচলিত বা গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ব্যবহারযোগ্যতা নির্ধারণ করতে
হবে। তারপর তা বাস্তবায়নের জন্য চা বাগানগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে।
চা উৎপাদনই চা বাগানের একমাত্র সম্ভাবনা নয়। দেশের পর্যটন খাতের অন্যতম
গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র চা বাগান। শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ ভারতে চা বাগানকে পর্যটন হাবে
পরিণত করা হয়েছে। এ অঞ্চলের দেশগুলো যদি এমনটি করতে পারে আমরা কেন পারব না? দেশের
চা বাগানগুলোর ভৌগোলিক বৈচিত্র্য বিচারে এ জায়গাগুলোকে পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত করার
সম্ভাবনা অনেক। কিন্তু শুধু চা নয়, যেসব স্থান খালি থাকে সেখানে অন্য শস্য চাষ
করতে পারলে বাড়তি কর্মসংস্থান ও আয় সম্ভব। মূলত
সম্ভাবনাগুলো ব্যবহার করতে হবে চা শ্রমিকদের জীবনযাপনের সামগ্রিক উন্নতিসাধনের
জন্য। চা শ্রমিকদের এখন পূর্ণ নাগরিক মর্যাদা অনুযায়ী শিক্ষা, স্যানিটেশন,
আবাসস্থল এমনকি অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হয়। এ সহযোগিতার মাত্রা আরও বাড়ানো সম্ভব
নানামুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে। তার পরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের কিছু দাবিদাওয়া আছে
এবং এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিশ্রুতিও রয়েছে। সরকারকে এ বিষয়ে গভীর মনোযোগ দিতে
হবে।
স্বাধীনতার পর দেশের অভ্যন্তরে চায়ের চাহিদা ৫০ লাখ কিলোগ্রাম থেকে ১০ কোটি কিলোগ্রামে পৌঁছেছে। গোটা বিশ্বে এর চাহিদা আরও বেশি। চাহিদার নিরিখে দেশের চা শিল্পের ভিত মজবুত করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে চায়ের গুণগত মান নিশ্চিত করা, উৎপাদনসহায়ক অর্থনৈতিক প্রবাহ এবং পরিবেশগত সংকটগুলো বিবেচনা করে একটি আধুনিক উৎপাদনব্যবস্থার দিকে এগোতে হবে। শুধু চারা রোপণ এবং উৎপাদনের মাধ্যমেই জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সামলে অর্থনীতি গতিশীল রাখা সম্ভব নয়। এ কথা সমগ্র কৃষি খাতের জন্যই প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি খাতের সহযোগিতামূলক অবস্থানই সহায়ক।