রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ
জেমস নিক্সি
প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৩ এএম
জেমস নিক্সি
এক হাজারেরও বেশি দিন ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেন। দীর্ঘসময়ে তাদের প্রতিরোধও গড়ে উঠেছে। কিন্তু গত অক্টোবর ইউক্রেনের জন্য আতঙ্কের মাস হয়েই থাকবে। রাশিয়ায় উত্তর কোরিয়ার সুপ্রশিক্ষিত ১১ হাজার সেনার পাশাপাশি ইয়েমেন থেকে ভাড়াটে সশস্ত্র বাহিনী যুক্ত হওয়ার পর ইউক্রেনের বিপর্যয় অনেকাংশেই যেন নিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে রাশিয়ার আক্রমণে ইউক্রেনের এনার্জি গ্রিড বিপর্যস্ত। শীতের এই সময়ে ভয়াবহ ঠান্ডার সঙ্গে লড়াই করার পাশাপাশি রয়েছে নিয়মিত হামলার আতঙ্ক। গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো মস্কোর পছন্দের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার হোয়াইট হাউসের চেয়ারে।
ট্রাম্প যুদ্ধ
বন্ধের দৃঢ় প্রত্যয় জানিয়েছেন। তবে এই প্রত্যয় অন্তত ইউক্রেনের জন্য সহায়ক হচ্ছে না।
এত কিছুর পর গোটা ইউরোপে এখন একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছেÑ এই যুদ্ধ কি পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণে
রয়েছে? প্রশ্নটির যুক্তিসংগত কারণÑ মূল রাশিয়া ভূখণ্ডে পশ্চিমা অনেক দেশের ক্ষেপণাস্ত্র
হামলার বিষয়ে কড়াকড়ি রয়েছে। বিশেষত এই যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে পশ্চিমারা যে পরিকল্পনা
নিয়েছে তা শুধু ইউক্রেনকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগাচ্ছে মাত্র। অস্ত্র সরবরাহ
করে যুদ্ধের অবসান ঘটানো সম্ভব না। আর এত অপ্রতুল সরবরাহে রাশিয়া নিশ্চিহ্ন হবেও না।
ইউক্রেনের জন্য
সমস্যা শেষ হয়নি। তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় ও অনুদানের অর্থ অস্ত্ররসদে খরচ হওয়ায় দেশটির
অর্থনীতি ও সামাজিকব্যবস্থায় প্রভাব ফেলবে। যেকোনো যুদ্ধই ব্যয়বহুল। তা ছাড়া পশ্চিমা
বিশ্ব ইউক্রেনকে এমন কোনো সহায়তা এখনও দেয়নি যাতে যুদ্ধের অবসান ঘটবে। রাশিয়া এদিকে
তাদের পরীক্ষামূলক ব্যালিস্টিক মিসাইলও নিক্ষেপ করেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে এখনও
দৃঢ় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। রাশিয়ার পরমাণু হামলার বিষয়ে হুঁশিয়ারি বাইডেন প্রশাসনের ওপর
প্রভাব ফেলেছে। এ থেকে বোঝা যায়Ñ পারমাণবিক হামলার হুমকি দিয়ে ভূরাজনৈতিক ব্ল্যাকমেইল
কঠিন কিছু নয়। এক্ষেত্রে ২০১৬ সালে ইউক্রেনের দনবাসে রাশিয়ার হামলার পরও পশ্চিমাদের
নীরব অবস্থানের কথা বলতে হয়। সেবারও তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়নি কিংবা রাশিয়ার
ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞাও দেয়নি।
ঠিক ৮ বছর পর
আবার বড় একটি যুদ্ধই শুরু হয়। এক্ষেত্রে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর ওপর যে নিষেধাজ্ঞা
তা বড় নয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জার্মানি ইউক্রেনকে শুধু হেলমেট সরবরাহের প্রতিশ্রুতি
দেয়। অন্তত এক বছর পর তারা ট্যাংক সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এমনকি এফ-১৬ জেটও
চলতি বছরের আগস্টের আগে দেওয়া যায়নি। এক সপ্তাহ আগেও যুক্তরাজ্যের স্টর্ম শ্যাডো মিসাইল
রুশ ভূখণ্ডে উৎক্ষেপণের অনুমতি ছিল না। এসব সামরিক রসদ যদি আগে দেওয়া যেত এবং হামলার
জন্য আগেই অনুমতি দেওয়া হতো, তাহলে আজ ইউক্রেন যুদ্ধে ভিন্ন অবস্থানে থাকত। যদিও আমরা
নিশ্চিতভাবে বলতে পারব না যে এসব সহযোগিতায় ইউক্রেন থেকে রাশিয়াকে সরিয়েও দেওয়া যেত।
কিন্তু অন্তত এমন বিপর্যয়ে পড়তে হতো না ইউক্রেনকে। ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো
এভাবে গুঁড়িয়ে যেত না। যুদ্ধের রক্ত রাশিয়ার হাতে যতটা, পশ্চিমা গোষ্ঠীর হাতেও ততটাই।
সময়ের পরিবর্তন
ঘটেছে। কিন্তু আমাদের পর্যবেক্ষণ ভাবনা বদলায়নি। ইউক্রেন এই যুদ্ধ জিততে পারবে না।
অবশ্য কিয়ের স্টার্মার, ওলাফ শুল্টজ ও জো বাইডেনও এমন কথা বলেননি। তারা বরং ইউক্রেনের
সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েই খালাস। ইউক্রেনকে পূর্ণ সামরিক সহযোগিতা দিতে না পারলে
এই যুদ্ধে জেতা অসম্ভব। ইউক্রেনকে এখন তাদের সার্বভৌমত্বের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে।
একটি গোটা রাষ্ট্র পরনির্ভর না হয়ে পেশাদারত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত হলেই সমাধান হবে।
এক্ষেত্রে ছোট রদবদলের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জয় ও সাফল্যকেই গুরুত্ব দিতে হবে। একসময়
এসবের সমন্বয় ঘটলে কিছুটা হলেও ক্ষতিপূরণ করে নেওয়া সম্ভব। এসব ছোট সাফল্য কী? রাশিয়ার
জব্দকৃত ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সদ্ব্যবহার, রাশিয়ার তেল সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা বাড়ানো,
ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগে যাতে ইউক্রেনে সামরিক রসদ আনা যায়,
রুশ সেনাদের ওপর যেসব অস্ত্র ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তা তুলে নেওয়া, রাশিয়ার মিসাইল
ধ্বংসের পদক্ষেপ, ন্যাটোর সেনাদের পশ্চিম ও মধ্য ইউক্রেনে নিয়ে আসা এবং ন্যাটো থেকে
নানাবিধ সহযোগিতা সংগ্রহ করার পাশাপাশি ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার রূপরেখা তৈরি করা।
ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমা সম্প্রদায় পর্যাপ্ত সহযোগিতা দিতে না পারার ক্ষেত্রে আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সমস্যা হলো, আমরা ইউক্রেনকে নিয়েই আলোচনা করছি। আজ পর্তুগাল কিংবা ফ্রান্সে যদি এমন পরিস্থিতি হতো তখন পশ্চিমা বিশ্ব কী পদক্ষেপ নিতো? পশ্চিমা বিশ্ব একত্রিত হয়ে আকাশ-পাতাল বিস্ফারিত করে হলেও তাদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করত। কিন্তু ইউক্রেনের ক্ষেত্রে বিষয়টি আলাদা। ইউক্রেন ঠিক ইউরোপের নয়। আর এজন্যই ইউক্রেনকে সহজেই এড়িয়ে যাওয়া চলে। এক্ষেত্রে নৈতিকভাবে একটি বড় সমস্যা রয়েছে। ইউক্রেন এখন একটি যুদ্ধক্ষেত্র। মোলডোভা একসময় ক্রেমলিন সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। তারাও রাশিয়া ছেড়ে দিচ্ছে। ফলে তারাও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বেÑ এমনটি নিশ্চিত বলা যায়। পোল্যান্ড ও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোকে রাশিয়া এখন খলনায়ক হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করছে। বিশেষত মস্কোর নিয়ন্ত্রণ থেকে রাষ্ট্রগুলো সরে যাওয়ার আশঙ্কাও কম নয়। এত কিছুর পর সংগতই প্রশ্ন রাখতে হয়Ñ পশ্চিমা বিশ্বের হাতে এই যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ আসলে কতটা। পশ্চিমা বিশ্ব কতটা হলে কার্যত খুশি হবে। কতটা ক্ষতি হলে তাদের মনে হবে যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। তারা কবে বুঝতে পারবে ইউরোপে একটি যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে একজন বিজেতা আবির্ভূত হতেই হবে। না হলে সমাধান পাওয়া কোনো দিনই সম্ভব হবে না।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ: আমিরুল আবেদিন