সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৩০ এএম
২১ নভেম্বর সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে এ এম এম নাসির উদ্দীনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং আরও চার কমিশনারকে নিয়োগ দিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে। সার্চ কমিটির তালিকা থেকে এই পাঁচজনকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এ এম এম নাসির উদ্দীন সরকারের সচিব হিসেবে দায়িত্বপালন করে অবসরে যাওয়ার পর দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি তাকে স্থানীয় সরকার কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিল। অন্য চার কমিশনার হলেনÑ সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাসুদ, সাবেক যুগ্ম সচিব তাহমিদা আহমদ ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। রোববার তাদের শপথ নেওয়ার কথা রয়েছে। আমরা প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য চার কমিশনারের সমন্বয়ে গঠিত নির্বাচন কমিশনকে স্বাগত-অভিনন্দন জানাই। নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের ওপর বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ইতোমধ্যে তাদের আস্থার কথা ব্যক্ত করেছে। ২২ নভেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে এবং সেই সংস্কার শেষে নতুন ইসির অধীনে হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
প্রধান নির্বাচন
কমিশনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের একটি দৃষ্টান্ত
স্থাপন করতে চাই। মানুষ যাতে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে, সেটা নিশ্চিত
করতে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে।’ আমরা তার এই প্রত্যয়ের জন্য সাধুবাদ
জানানোর পাশাপাশি বলতে চাই, যে প্রেক্ষাপটে দেশের চতুর্দশ প্রধান নির্বাচন কমিশনার
হিসেবে তিনি নিয়োগ পেয়েছেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তার সামনে নিশ্চয় অনেক চ্যালেঞ্জ
রয়েছে এবং সমান্তরালে রয়েছে জনপ্রত্যাশাও। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত
রাজনৈতিক সরকারের আমলে গঠিত কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ
করে ৫ সেপ্টেম্বর। সেই হিসেবে দেড় মাস শূন্য থাকার পর নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা
হলো। আমরা আশা করব, রাজনৈতিক প্রভাবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান অতীতের নির্বাচন কমিশনগুলোর
ওপর যে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নতুন নির্বাচন কমিশন সেই কলঙ্কিত অধ্যায়
তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মুছে দিতে সক্ষম হবে। আমরা আরও আশা করি, নতুন কমিশন অংশগ্রহণমূলক,
গ্রহণযোগ্য, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করে নন্দিত হবে এবং দৃষ্টান্ত স্থাপন
করবে। নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার এও বলেছেন, ‘এত মানুষের রক্তের সঙ্গে বেইমানি
করা সম্ভব নয়।’ আমরা তার এই বক্তব্যের জন্যও সাধুবাদ জানাই। নির্বাচন কমিশনের সামনে
যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সবাই নিশ্চয় স্পষ্টভাবে জ্ঞাত।
৫৩ বছরে স্বাধীন
বাংলাদেশে দৃষ্টান্তযোগ্য নির্বাচন যে হয়নি তা নয়। কিন্তু আমরা দেখলাম, যখনই সাংবিধানিক
প্রতিষ্ঠানটির ওপর রাজনৈতিক হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণের লক্ষ্যে ক্ষমতাসীনরা নানাভাবে
প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করে কমিশনের স্বতন্ত্র সত্তাকে ‘রাহুগ্রাস’ কবলিত করেন,
তখনই পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া গুরুতর প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ল। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট
সরকার যেমন এক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল না, তেমনি আওয়ামী নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের ভূমিকাও
চরম বিতর্কিত। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নির্বাচন অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ
অনুষঙ্গ এবং তা অনুষ্ঠানের নিয়ামক শক্তি মূলত নির্বাচন কমিশন। আমরা দেখছি, বিশ্বের
বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া ক্ষমতাসীনদের
শাসনকার্য পরিচালনা করা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন তার স্বাধীন সত্তা নিয়ে নির্বাচনযজ্ঞ
বরাবরই সম্পন্ন করে আসছে এবং এ নিয়ে অংশীজন কারোই তেমন কোনো আপত্তিও শোনা যায় না। কিন্তু
দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে সরকারের হস্তক্ষেপের ফলে সৃষ্ট আস্থার সংকট থেকে নির্বাচন
প্রক্রিয়া ক্রমেই কীভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে এবং গণতন্ত্র তার শ্রী হারায়Ñ তা সচেতন
মানুষ মাত্রেরই জানা। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান প্রেক্ষাপট সৃষ্টির পেছনে
কারণগুলো সচেতন কারোই অজানা নয়। আমরা আশা করব নবগঠিত নির্বাচন কমিশন ইতিহাসের পাতায়
দৃষ্টি রেখে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হবে, যার পরিপ্রেক্ষিতে অতীতে সৃষ্ট অনাচার-দুরাচার-কদাচারের
ছাপ পুরোপুরি অদৃশ্য হবে। আমরা প্রত্যাশা রাখতে চাই, এ এম এম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বাধীন
নির্বাচন কমিশন নির্বাচনব্যবস্থার সব ক্ষত উপশমে সক্ষম হবে।
সরকার ইতোমধ্যে
জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। ২১ নভেম্বর রাজধানীর
আগারগাঁওয়ে জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এই কমিশনের
প্রধান সংস্কারের বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের তরফেও কিছু
প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে। আমরা আশা করি, সব মহলের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন
সংস্কারের লক্ষ্যে দূরদর্শিতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হবে সংস্কার কমিশন। দেশের নির্বাচন
প্রক্রিয়া এক দিনে প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি কিংবা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা শ্রী হারায়নি।
এর জন্য ইতঃপূর্বের রাজনৈতিক সরকারগুলোর কমবেশি দায় ও হীনস্বার্থবাদিতা দৃশ্যমান হয়েছে।
আমরা চাই, এমন আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি যেন আর দৃশ্যমান না হয়। আগামী পাঁচ
বছরের জন্য দায়িত্ব পাওয়া এ এম এম নাসির উদ্দীন কমিশনের অধীনেই পরবর্তী জাতীয় সংসদ
নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার কাঠামোর বিভিন্ন স্তরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। শেষ তিনটি
জাতীয় নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনায় সাংবিধানিক
প্রতিষ্ঠানটিতে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে, এর উপশমে বহুমাত্রিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে
পড়েছে। আমরা আরও চাই, সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানের ওপর কোনো সরকারই যাতে কোনো প্রভাব
বিস্তার করতে না পারেÑ তাও নিশ্চিত হোক।
আমাদের প্রত্যাশা,
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি জোবায়ের রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ৬ সদস্যের
সার্চ কমিটির পক্ষ থেকে উপস্থাপিত দশজনের মধ্যে যে পাঁচজনকে বাছাই করা হয়েছে, তারা
তাদের নিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধের ব্যাপারে সজাগ থাকবেন। প্রথমত, তাদের সামনে রয়েছে পূর্বসূরিদের
বদনাম ঘোচানোর চ্যালেঞ্জ এবং এর পাশাপাশি সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সব দায়িত্ব যথাযথভাবে
পালনের অঙ্গীকার। দেশের মানুষ গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের জন্য ইতোমধ্যে কম
ত্যাগ করেনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কোনো রাজনৈতিক সরকারই জনগণের ত্যাগের
প্রতি শেষ পর্যন্ত যথাযথ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেনি। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনগণই
সর্বময় ক্ষমতার উৎস এবং প্রকৃতার্থেই জনগণ যাতে সব ক্ষমতার মালিক থাকতে পারে, সেই নিশ্চয়তা
বিধানও সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা নতুন নির্বাচন কমিশনের সবার সাফল্য কামনা করি।