জীববৈচিত্র্য-সংকট
শেখ ইউসুফ হারুন
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:২৫ এএম
শেখ ইউসুফ হারুন
কেউ বলে হুতুম প্যাঁচা আবার কেউ ভুতুম প্যাঁচা। নাম শুনলেই গায়ের মধ্যে এক ধরনের ছমছম করা ভাব চলে আসে। প্যাঁচা যখন রাতে গাছের উঁচু ডালে ডাকতে থাকে তখন অতিসাহসী ব্যক্তির মধ্যেও ভয় অনুভূত হয়। সাধারণত প্যাঁচাকে ‘অলক্ষ্মী’ মনে করে সবাই অপছন্দ করে। ছোটবেলা মা বলতেন, হুতুম প্যাঁচা ডাকলে ‘আয়াতুল কুরসি’ পড়ে পাখির অবস্থানের দিকে ফুঁ দিলে পাখির ডাক বন্ধ হয়ে যায়। তবে কখনও এটি অনুশীলন করে দেখা হয়নি। হাদিসে প্যাঁচাকে ‘কুলক্ষণ’ ভাবতে নিষেধ করা হয়েছে। প্যাঁচা সাধারণত নিশাচর প্রাণী। হুতুম প্যাঁচা অনেক ভাবে ডাকতে পারে। কালো প্যাঁচা, লক্ষ্মীপ্যাঁচা বা নিমপ্যাঁচাÑ প্রকারভেদে প্রত্যেকের ডাক আলাদা। কখনও কখনও প্যাঁচার ডাক বিড়ালের ডাক বলে ভ্রম হয়। তবে প্যাঁচা মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য ডাকে বলে মনে হয় না। পাখিরা সাধারণত স্ত্রী পাখিকে আকর্ষণ বা নিজের অবস্থান সমগ্রোত্রে জানান দেওয়ার জন্য ডেকে থাকে।
কবি জীবনানন্দ
দাশ তার কবিতায় অসংখ্যভাবে প্যাঁচাকে উপস্থিত করেছেন। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় তিনি
বলেন, ‘তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,/ থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে ব’সে
এসে/ চোখ পাল্টায়ে কয়: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?/ চমৎকার!/ ধরা যাক্ দু-একটা
ইঁদুর এবার—’। আবার তার বিখ্যাত ‘প্যাঁচা’
কবিতায় বলেন, ‘নদীটির শ্বাসে/ সে-রাতেও হিম হ’য়ে আসে/ বাঁশপাতা—মরা ঘাস—আকাশের তারা,/ বরফের মতো চাঁদ
ঢালিছে ফোয়ারা;/ ধানখেতে মাঠে/জমিছে ধোঁয়াটে/ধারালো কুয়াশা,/ ঘরে গেছে চাষা;/ ঝিমায়েছে
এ-পৃথিবী,/ তবু আমি পেয়েছি যে টের/কার যেন দুটো চোখে নাই এ-ঘুমের/কোনো সাধ।’ প্যাঁচার
এই জেগে থাকা, তার ত্রিকালদর্শীতার মধ্য দিয়ে বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির রূপ পাঠকের মনে
দোলা দেয়-রোমাঞ্চ সৃষ্টি করে। প্রকৃতির উপাদানে
চিত্রকল্পনির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে কবি জীবনানন্দ দাশ এঁকে দেন প্যাঁচার তিমিরভেদী দৃষ্টিও।
যেখানে তার অন্তর্নিহিত চোখের সঙ্গে রয়েছে বহির্দৃশ্যের ছবি।
হিন্দুধর্মে অর্থাৎ
সনাতন ধর্মে প্যাঁচা ধনসম্পদ ও ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মীর বাহন। সম্ভবত প্যাঁচা ইঁদুর
হতে ধান রক্ষা করে তাই লক্ষ্মী তাকে বাহন হিসেবে রেখেছেন। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীতে
প্যাঁচা লক্ষ্মীর বাহন হওয়ার এক চমকপ্রদ কাহিনী রয়েছে। পরমেশ্বর প্রকৃতি ও পশুপাখি
সৃষ্টির পর দেবদেবীরা তাদের বাহন হিসেবে পশুপাখি বেছে নিচ্ছিলেন। তখন দেবী লক্ষ্মী
বললেন, ‘আমি কার্তিকের অমাবস্যার রাতে মর্ত্যে আগমন করব। তখন যে প্রথমে আমার কাছে আসবে
তাকেই আমি আমার বাহন হিসেবে বেছে নেব।’ অমাবস্যার রাত খুবই অন্ধকার হয়। দেবী রাতে যখন
মর্ত্যে নেমে এলেন, তখন প্যাঁচাকে প্রথম দেখতে পাওয়ার কারণে তাকেই বাহন হিসেবে বেছে
নিলেন। প্রাচীন গ্রিসে প্যাঁচাকে ভাগ্যবিধাতা, রোমানরা দুঃখদুর্দশার প্রতীক, আমেরিকান
ইন্ডিয়ানরা অসুস্থতা ও মৃত্যুর প্রতীক হিসেবে দেখত। মালয় দ্বীপ (ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন)
ও আরবরা বিশ্বাস করত প্যাঁচার অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে এবং তারা বাচ্চাদের ধরে নিয়ে যায়।
ব্রিটিশরা মনে করত প্যাঁচার ডাক শুনলে অবিবাহিতরা সতীত্ব হারায়। বাংলাদেশে চারুকলা
ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ঢাকঢোল বাজিয়ে নেচে-গেয়ে যে মঙ্গল শোভাযাত্রাটি অনুষ্ঠিত হয়,
সেখানে শুরু থেকেই প্রতীক হিসেবে প্যাঁচা ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা
প্যাঁচার ফসিল গবেষণা করে জেনেছেন, প্যাঁচা ৬ কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে রয়েছে। তারা ডাইনোসরেরও
৩ হাজার ৫০০ বছর আগে পৃথিবীতে ছিল। পৃথিবীতে প্যাঁচাই মনে হয় একমাত্র প্রাণী যে তার
মাথা দুই দিকে
প্যাঁচার চোখে ‘রড’ সেল নামক এক ধরণের সেলের আধিক্য থাকায় রাতের বেলা এরা ভালো
দেখতে পায়। দিনের বেলা চোখে কম দেখতে পায় বলে এরা ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। প্যাঁচা
দেখতে একটু কিম্ভূতকিমাকার বিধায় দিনের বেলা অন্য পাখিরা বিশেষ করে কাক, ফিঙে, চিল, বুলবুলি
এদের দেখলেই তাড়া করে। এদের তাড়া থেকে বাঁচার জন্য দিনের বেলায় প্যাঁচা
গাছের উঁচু ডালে বা ঝোপ বা গাছের গর্তে পালিয়ে থাকে। প্যাঁচা
নিরীহ প্রাণী। পরিবেশের
ভারসাম্য রক্ষায় প্যাঁচার ভূমিকা অতুলনীয়। এর কোনো ক্ষতিকর দিক
নেই। প্যাঁচা ইঁদুর ও পোকামাকড়ের হাত থেকে আমাদের ফসল রক্ষা করে কৃষি অর্থনীতিতে বিরাট
অবদান রাখে। কিন্তু বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের ফলে প্যাঁচার আবাস দিনে দিনে সংকুচিত
হচ্ছে। গ্রামে রাতের বেলা এখন প্যাঁচার ডাক খুব কম শুনতে পাওয়া যায়। দিনে দিনে
প্যাঁচা বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হচ্ছে। আমাদের স্বার্থেই প্যাঁচাকে
বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
শুধু হুতুম প্যাঁচাই নয়, আরও অনেক প্রজাতির পাখি ও অন্য প্রাণীর অস্তিত্ব সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। এর পেছনে রয়েছে বহুবিধ কারণ। মনে রাখা বাঞ্ছনীয়, পরিবেশ কেন্দ্র করে উন্নয়ন হবে, উন্নয়ন কেন্দ্র করে পরিবেশ সাজানো যাবে না। জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতেই হবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত হলে জীববৈচিত্র্যেরও সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। জলাশয়, বনভূমি ইত্যাদির অস্তিত্ব সংকট কাটাতে হবে। প্রাণবৈচিত্র্যের সুরক্ষায় এসবই খুব জরুরি। গবেষণায় জানা গেছে, বাংলাদেশে এখন অন্তত ২১৯ প্রজাতির বন্য প্রাণী বিপন্ন। বন্য প্রাণীর যে প্রজাতিগুলো এখনও টিকে আছে সেগুলোও বর্তমানে বিপন্ন। এর বাইরে নয় প্যাঁচাও। কিন্তু প্রাণীদের মধ্যে রয়েছেÑহাতি, বাঘ, হনুমান, উল্লুক, শকুন, গেছো ব্যাঙ, মেছোবিড়াল, শুশুক, শজারু। এ তালিকায় আরও রয়েছে মাছ, উভচর সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণী। না, এখানেই শেষ নয়; এ তালিকা আরও দীর্ঘ নিশ্ছয়ই। বন বিভাগের হিসাবে মিঠা ও লোনা পানির ৭০৮ প্রজাতির মাছের মধ্যে বিপন্ন হয়ে পড়েছে ৫৪ প্রজাতি। এ ছাড়া ৪২ প্রজাতির উভচরের মধ্যে ২৩টি, ১৫৭ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে ৬৩টি, ৭৩৬ প্রজাতির পাখির মধ্যে ৪৭টির অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। এসব বিষয়েই বাড়ুক মনোযোগ, নিশ্চিত হোক প্রতিবিধান।