× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ধর্ম ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পর্যবেক্ষণ

পাহাড়ে নজরদারি আরও বাড়ুক

ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:১৪ এএম

ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

আসছে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার ৫৩তম বার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ নানা ধরনের চড়াই-উতরাই ও ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশের যেকোনো সমতল ভূমি কিংবা পাহাড়ি বনাঞ্চলের তুলনায় আমাদের ভৌগোলিক সীমানার দক্ষিণ-পূর্বদিকে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিস্থিতি বিভিন্ন কারণে এবং নানাবিধ প্রেক্ষাপটে অনেকবারই উত্তপ্ত হয়েছে। তবে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থার সাথে সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামেরও এমন নাজুক পরিস্থিতি সম্ভবত আগে কখনও সামনে আসেনি। সার্বিকভাবে বাংলাদেশ এখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে এবং নাজুক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। যে যেভাবেই ব্যাখ্যা করুক না কেন, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এখন প্রজাদের দ্বারা নির্বাচিত কোনো সরকার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে না। এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশে একটি সফল ছাত্র-জনতার বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে এবং সেই বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় এবং এ সরকার বিগত সরকারের সৃষ্ট ক্ষতগুলো উপশমে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

সাংবিধানিকভাবে কোনো বৈপ্লবিক সরকারের যেমন ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ নেই, একইভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটা বিভিন্ন কারণে বিতর্কিত এবং একসময় বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে তথা কথিত আইনের দ্বারা অবৈধ। এমনি এক প্রেক্ষাপটে যে যেভাবেই ব্যাখ্যা করুক না কেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তার ১০০ দিন অতিক্রম করেছে। এই ১০০ দিনের মধ্যে বহু বিষয় নিয়ে নানাবিধ তর্ক-বিতর্ক, সমালোচনা, পর্যালোচনা এবং উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে। এসব বিষয়ে বারবার ফিরে এসেছে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অটুট রাখার প্রশ্নটি। আর এমন প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে বারবার উত্তাপ ছড়িয়েছে সেন্টমার্টিন, নাফ নদে বাংলাদেশি জেলেদের প্রতি তথাকথিত আরাকার আর্মির গুলিবর্ষণ ও দুই দেশের স্পর্শকাতর নৌ-সীমানায় মিয়ানমার নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজের অবস্থানকেন্দ্রিক আলোচনা, রোহিঙ্গা শিবিরে নিরীহ উদ্বাস্তু হত্যার করুণ উপেক্ষা উপাখ্যান।

এমনি এক প্রেক্ষাপটে প্রতিদিনের বাংলাদেশসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরে সচেতন মহল চমকে উঠেছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, সম্প্রতি যৌথ বাহিনী এক দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে পার্বত্য বান্দরবান জেলার মুনলাইপাড়ার নিকটবর্তী জঙ্গলে কেএনএফের আশ্রয়স্থলে বান্দরবান রিজিয়নের অন্তর্গত রুমা জোন কর্তৃক একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে বেশ ‍কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। এসব সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে একে-৪৭ অস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ।

একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সম্পূর্ণ ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে সেনাবাহিনী এবং তারই পাশাপাশি নৌ ও বিমানবাহিনীও যখন দেশের আনাচেকানাচে মোতায়েন রয়েছে, ঠিক সেই সময় দেশেরই একটি অংশে এমন অস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুদ তথা একটি সশস্ত্র যোদ্ধা দলের অবৈধ যুদ্ধ প্রস্তুতি অবশ্যই শঙ্কার বিষয়। সর্বোপরি এ কথাও বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, সমগ্র পার্বত্য অঞ্চলে আগে থেকেই যেখানে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম অব্যাহত ছিল এবং একপ্রকার নিয়ন্ত্রণ আরোপিত ছিল, সেখানে কী করে এ ধরনের একটি আস্তানা বা অস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলা সম্ভব হলো।

বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলে ইনসার্জেন্সি বা নিজ দেশের মানুষ যখন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়, তখন তাদের দমন একটি কঠিন প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায়। কারণ এসব ইনসার্জেন্ট বা বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সাধারণ জনগণেরই অংশ এবং তাদের ভাষা, চেহারা, শারীরিক গঠন, কাপড়চোপড় সবকিছুই থাকে স্থানীয় জনগণের মতো। তারা কোনো নির্দিষ্ট পোশাক পরে না এবং প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে হয়তো চলাচলও করে না। কিন্তু তাদের থাকে নির্দিষ্ট কিছু গুপ্ত আশ্রয়স্থল, যেখানে তারা পূর্বনির্ধারিত সময়ে বা পূর্বনির্ধারিত সংকেত পাওয়া মাত্র জমায়েত হয় এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি নাশকতা বা পরিকল্পনামাফিক অভিযান সমাপ্ত করে আবারও নতুন কোনো আস্তানায় ফিরে গিয়ে আশ্রয় নেয়, গোলাবারুদ লুকিয়ে ফেলে এবং সাথে সাথে পরবর্তীকালে সাধারণ জনগণের সাথে মিশে যায়। ভাষা ও আদর্শগত মিলের কারণে কিংবা ভয়ের কারণে এসব ইনসার্জেন্ট বা সন্ত্রাসীর বিষয়ে কোনো তথ্য সাধারণ জনগণ প্রকাশ করতে চায় না বা সরকারি বাহিনীর কাছে জানাতে চায় না। এই সুযোগ নিয়ে নিজেদের আধিপত্য ও সাংগঠনিক কাঠামো ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করতে থাকে ইনচার্জেন্ট বা জঙ্গিবাদী দল।

বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের অবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। ক্ষুদ্র একটি আঞ্চলিক সংগঠন থেকে ক্রমান্বয়ে একটি বড় সশস্ত্র দলে পরিণত হওয়া বিশেষত বিদেশি সহযোগিতায় পুষ্ট হয়ে সরকারি বাহিনীর ওপর ভিন্ন মতাবলম্বী বা সেখানে বসবাসকারী বাঙালিদের ওপর নৃশংসতা চালানোর করুণ ইতিহাস আমাদের সবারই কম-বেশি জানা। একসময় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিশেষত দুর্গম এলাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ জনবসতি, সরকারি ভবন ও গ্রোথসেন্টারগুলোতে সেনাবাহিনীর নিত্য উপস্থিতি এবং ক্যাম্প সবার নজরে পড়ত। পরবর্তীকালে ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর সেনাবাহিনীর কার্যক্রম এবং ক্যাম্পের সংখ্যা ক্রমেই গুটিয়ে আনা হয়। তখন প্রত্যাশা করা হয়েছিল যে, ধীরে ধীরে বিভ্রান্ত পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ন্যায় ও সত্যের পথে ফিরে আসবে এবং মূলধারার জনগণের সাথে মিশে দেশের উন্নয়নে একযোগে অবদান রাখবে। বাংলাদেশ সরকার পরবর্তীকালে শান্তি চুক্তির সব শর্ত পূরণ করতে না পারলেও পাহাড়িদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের জীবনের মান উন্নয়নে সচেষ্ট থেকেছে এবং সংখ্যার দিক থেকে উল্লেখ করার মতো অবকাঠামো নির্মাণ করেছে, যা আজও এগিয়ে চলেছে। পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষদের চাকরি, শিক্ষা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রাধিকার বা সংরক্ষিত আসনে আসীন হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। নানা দেশের একাধিক উন্নয়ন সংস্থাকে পাহাড়ি অঞ্চলে উন্নয়নমূলক কাজ হাতে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

এত কিছুর পরও পাহাড়িদের নিজেদের অবহেলিত ভাবা এবং সেই চেতনাকে ছড়িয়ে দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার অপচেষ্টা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। ইতঃপূর্বে সাইকেল চুরির ঘটনাসহ তুচ্ছ কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে একজন বাঙালিকে পিটিয়ে মারা এবং সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি করে পাহাড়িদের হতাহত করাসহ তাদের দোকানপাট ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা একটি বড় ধরনের ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা বলে প্রতীয়মান হয়। বর্তমান বা আসন্ন শীত মৌসুমে তিন পার্বত্য জেলা দেশ-বিদেশের পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হওয়ার কথা ছিল। পাহাড়ি পর্যটনকেও চরম ঝুঁকিতে ফেলেছে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো। এ কারণেই যারা জুলাই বিপ্লব ও বর্তমান সরকারকে সফল দেখতে চায় না, তারাই এমন কিছু ঘটাচ্ছে কিনাÑ তা খতিয়ে দেখতে হবে।

বাংলাদেশের নিরাপত্তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে আরও বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে, বিগত ১৬ বছরের শাসনামলে যারা যারা সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট হয়েছেন এবং নানাভাবে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি এবং ক্ষেত্রবিশেষে দেশ-বিদেশে অবৈধভাবে ধনসম্পদ অর্জন করেছেন, তাদের অনেকেই এখনও নানা পদ-পদবি অধিকার করে বিভিন্ন স্থানে কর্তব্যরত রয়েছেন। যখন কোথাও কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, তখনই সেখানকার শীর্ষস্থানীয় সেনা ও বেসামরিক আমলাদের নাম সামাজিক যোগাযোগমাধমের কল্যাণে সামনে চলে আসার প্রবণতা রাষ্ট্রযন্ত্রকে রীতিমতো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে। অতি সম্প্রতি ডাকাত ধরতে গিয়ে একজন তরুণ সেনা কর্মকর্তা প্রাণ হারানোর ঘটনার মধ্য দিয়ে নানা গুজব ডালপালা বিস্তার করেছিল। তখন তার ঊর্ধ্বতন সকল কর্মকর্তার এবং তাদের চৌদ্দগুষ্টির ইতিহাস নানাভাবে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে কিংবা বিকৃত করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, যা রীতিমতো আতঙ্কজনক। সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর বিশেষত সেনাবাহিনীপ্রধান তার বিভিন্ন বক্তৃতায় সকলকে গুজবে কান না দেওয়ার জন্য এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি তথ্য পাওয়া মাত্র তা চারদিকে না ছড়ানোর আহ্বান জানান। কারণ আমাদের সেনাবাহিনী দেশের ঐক্য ও সংহতির এক অনন্য প্রতীক, যা কোনো অবস্থায় বিনষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতি সম্প্রতি সেন্টমার্টিন দ্বীপ এমনকি সমগ্র চট্টগ্রাম বিদেশিদের হাতে চলে যাওয়ার জোর গুজব রটেছে। এ গুজবের উৎসে নজর দিয়ে কঠোর প্রতিবিধান নিশ্চিত করা জরুরি। একই সঙ্গে  পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন অস্ত্রের মজুদের বিষয়টিও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গোয়েন্দা নজরদারি বহুগুণে বৃদ্ধি করে ঘটনার প্রতিকারের বদলে ঘটনা ঘটার পথ রুদ্ধ করে দেওয়া।

  • গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। অবসরপ্রাপ্ত মেজর
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা