মিয়ানমার
ইউন সুন
প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:১১ এএম
ইউন সুন
২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর চীন জান্তা সরকারকে পূর্ণ সরকারের ক্ষমতা দেয়নি। বরং তারা এ ক্ষেত্রে তাদের অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকায় বিচার করেছে। ২০২৩ সালে চীন অপারেশন গ্রিনলাইটের মাধ্যমে তাদের সীমান্ত সুরক্ষায় মনোযোগী হয়ে ওঠে। মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে তারা বহু প্রচেষ্টায় সীমান্তে সাইবার স্ক্যাম প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে মিয়ানমারের জান্তা সরকার প্রধান প্রথমবারের মতো চীন সফর করায় মিয়ানমারের বিষয়ে চীনের ভাবনার পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমরা দেখছি, চীন মিয়ানমারের নির্বাচনকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু চীনের অভ্যন্তরে জান্তা সামরিক বাহিনী ও সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো এখনও সক্রিয় রয়েছে। তাদের সক্রিয়তাই প্রমাণ করে যে, এত সহজে নির্বাচনী আয়োজন সফল করা সম্ভব হবে না।
ইতোমধ্যে শুধু রাখাইন নয়, আরাকান আর্মির হামলার মুখে মিয়ানমারের বিভিন্ন
স্থানে একের পর এক ঘাঁটি হারাতে শুরু করে শক্তিশালী জান্তা বাহিনী। বিদ্রোহীদের হামলায়
এ পর্যন্ত অনেক জান্তা সেনা নিহত হয়েছেন। লড়াইয়ে টিকতে না পেরে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ
ও ভারতেও পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন অনেকে। বিশেষ করে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের
রাখাইন প্রদেশের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। সেখানে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক লড়াই
চলছে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির। বিভিন্ন সময় পরিচালিত সামরিক অভিযানে
আরাকান আর্মি যেসব অস্ত্র প্রদর্শন করেছে, তাতে স্বয়ং জান্তা বাহিনীও বিস্ময় প্রকাশ
করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর থেকেও অনেক অত্যাধুনিক অস্ত্র
ব্যবহার করেছে বলে জানা যায়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কাছে
এসব অস্ত্র কোথা থেকে আসছে? জানা যায়, আরাকান আর্মির বেশিরভাগ অস্ত্র ও গোলাবারুদের
জোগানদাতা কাচিন ইন্ডিপেন্ডেনস আর্মি (কেআইএ) ও তাদের মিত্র ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি। থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তের কালোবাজারিদের
কাছ থেকে তারা অস্ত্র-গোলাবারুদ কেনে বলেও জানা গেছে।
অনেকের দাবি, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অস্ত্রও আসে তাদের কাছে।
ইসরাইলি সীমান্তরক্ষী বাহিনী, নরওয়ে ও নেদারল্যান্ডসের সশস্ত্রবাহিনীর ব্যবহার করা
ব্যারেট এমআরটি স্নাইপার রাইফেলও আছে আরাকান আর্মির অস্ত্র ভাণ্ডারে। এক কথায় বড় ধরনের
সামরিক হামলা প্রতিহত করতে যেসব অস্ত্র প্রয়োজন, তার বেশিরভাগই আছে আরাকান আর্মির হাতে।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আরাকান আর্মি বেশিরভাগ অস্ত্র পায় চীন
থেকে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াভিত্তিক একটি সামরিক সূত্র বলছে, চীন আরাকান আর্মিকে ৯৫ শতাংশ
অর্থায়ন করছে। এ ছাড়া সংগঠনটির কাছে ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র
রয়েছে, যা চীনের দেওয়া। আরাকান আর্মির ভাণ্ডারে উন্নত অস্ত্র ছাড়াও তাদের সদস্যদের
জন্য ভালো পোশাক, খাবার ও রেশনের ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের পরিবারের সদস্যদের জীবনধারণ
ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ব্যয়ও নির্বাহ করে সংগঠনটি। পরিবারের অন্য সদস্যদের শিক্ষার জন্য
আর্থিক সাহায্যেরও জোগান দেয় আরাকান আর্মি। অর্থাৎ সাংগঠনিকভাবে অনেক দৃঢ় অবস্থানে
থাকা আরাকান আর্মি যে জান্তা সরকারের নিয়ম অনুসারে পরিচালিত হতে রাজি হবে না তা অনেকটা
স্পষ্ট।
রাখাইনে মিয়ানমার জান্তাবাহিনী আরও চার শহর হারানোর পথে বলে দাবি
করেছে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)। এর আগে রাজ্যটির ১৭টি শহরের মধ্যে
১১টিই দখল করে তারা। নতুন করে পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যটির আন, তাউংগুপ, মংডু ও গোয়া শহরের
পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে আরাকান আর্মি চাপ দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে। রাখাইনের
স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, মেজরসহ প্রায় ৩০০ জান্তা সেনা সম্প্রতি আরাকান
আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। লড়াইয়ের কারণে অ্যান শহরে প্রায় তিন হাজার বাসিন্দা
আটকা পড়ে আছে।
আরাকান আর্মির মুখপাত্র খাইং থুখা সংবাদমাধ্যম ইরাবতীকে বলেন, গত
রোববার একটি জান্তা হেলিকপ্টার ওয়েস্টার্ন কমান্ড সদর দপ্তরে শক্তি বৃদ্ধির রসদ পাঠানোর
সময় ভূপাতিত করা হয়েছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীটি আরও জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে
মংডু শহরেরও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। সর্বশেষ তাদের হামলায় জান্তা সরকার সমর্থিত
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও বিমান হামলার সহায়তা করা জান্তা সেনারা
বর্ডার গার্ড পুলিশের সদর দপ্তরে অবস্থান নিয়েছে। রাখাইনের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা
হয়েছে, রাখাইনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর আইয়ারওয়াদির সীমান্তবর্তী গোয়াও ঘিরে রেখেছে
আরাকান আর্মি সেনারা। প্রতিবেদন আরও বলছে, জাতিগত সশস্ত্রবাহিনীটি তাউংগুপের বাইরে
জান্তা ব্যাটালিয়নের ঘাঁটি দখল করেছে। আরাকান আর্মির আক্রমণ প্রতিহত করতে জান্তা সৈন্যরা
প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেওয়ায় শহরে এখন লড়াই চলছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে
আরও বলা হয়েছে, আন ও তাউংগুপকে রক্ষার জন্য জোরপূর্বক ৬০০ রোহিঙ্গা পুরুষকে ‘ঢাল হিসেবে
ব্যবহার’ করছে জান্তা সরকার। তবে এ তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি।
আরাকান আর্মি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সহযোগী সদস্য তাং ন্যাশনাল
লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির
(এমএনডিএএ) গত বছরের অক্টোবরে ‘অপারেশন ১০২৭’ শুরু করে। ২৫টি শহর এবং আরাকানের রাজধানী
লাশিওসহ উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের বেশিরভাগ অংশ দখল করে তারা। আরাকান আর্মি গত বছরের
নভেম্বরে তাদের নিজ রাজ্যে অভিযান সম্প্রসারণ করে এবং গত বুধবার রাখাইন থেকে জান্তাকে
বিতাড়িত করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে অভিযানের প্রথম বার্ষিকী পালন করে। রাখাইনের
১৭টি টাউনশিপের মধ্যে ১১টি এবং প্রতিবেশী চীন রাজ্যের পালেতওয়া টাউনশিপ দখল করে নিয়েছে
জাতিগত বাহিনী। অর্থাৎ জান্তা সামরিক বাহিনী অনেক নাজুক এক পরিস্থিতির মুখে রয়েছে।
এমন সময়ে জান্তা সরকার প্রধানের চীন সফরটি নিয়ে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছে।। কিন্তু
বাস্তবে চীন এখানে একটি বড় সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। কারণ মিন অং হ্লাইং জানিয়েছেন, নির্বাচনে
তিনি জয়ী হবেন। আর এই জয়ের জন্য তিনি তুমুল আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু যদি জোর করেই তিনি
জয়ী হতে চান, তাহলে দ্বিধাবিভক্ত মিয়ানমারকে কীভাবে একত্রিত করবেন সেটি একটি বড় প্রশ্ন
হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি এমনটিই হয় তাহলে মিয়ানমারে চীনের যে স্বার্থ তা পূরণ হওয়াও কঠিন
হবে। সংঘাত বাড়বে এবং বিশেষত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী পড়বে বিপাকে।
ইরাবতী থেকে অনুবাদ : আমিরুল আবেদিন