সংস্কার
আব্দুল বায়েস
প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:০১ পিএম
স্বাধীনতা একবারই এসেছিল, ১৯৭১ সালে। হ্যাঁ, সত্যি যে আমাদের সব স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি, তবে ‘ওগো যা পেয়েছি সেই টুকুতেই খুশি আমার মন’ বললে বোধ করি খুব একটা অন্যায় হবে না। প্রথমে দেখা যাক বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তানের তুলনা। পাকিস্তান আমলে বিচ্যুতি ছিল অগ্রগতিতেÑ পশ্চিম এগিয়ে ছিল আর পূর্ব অনেক পিছিয়ে। যার ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ। এখনও বিচ্যুতি লক্ষণীয়। বস্তুত বাড়ন্ত বিচ্যুতি। তবে এবার উল্টো দিকে অর্থাৎ বাংলাদেশ অগ্রগামী পাকিস্তানের চেয়ে নানান নির্দেশকে। স্বাধীনতার সময় প্রায় সব আর্থসামাজিক নির্দেশকে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে পিছিয়েছিল; এখন অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে টপকে গেছে।
বাংলাদেশ বনাম ভারতের তুলনাটা এ রকম : কিছু ক্ষেত্রে ছুঁইছুঁই, অন্য ক্ষেত্রে এগিয়ে। যেমন জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান, শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের হার, নগরায়ণের হার ইত্যাদিতে ভারতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ এবং অন্যান্য নির্দেশকে দ্রুত ধাবমান সেই দেশটির সমান হতে। ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের ক্রমবর্ধমান অবদান নিয়ে আগুয়ানের বিপরীতে ভারত ও পাকিস্তানে ওঠানামা নিয়ে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান বাংলাদেশের অর্ধেকের মতো। এটা ব্যাখ্যা করে কী করে বাংলাদেশ আর্থসামাজিক নির্দেশকে আঞ্চলিক সহগামীর নাগাল ধরল। আর ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের সফলতা প্রতিফলিত হতে দেখা যায় নগরায়ণের সফলতায়। নব্বইয়ের দশকে সবচেয়ে কম নগরায়ণ থেকে আঞ্চলিক অংশীদারদের ছাপিয়ে যাওয়া কম কৃতিত্বের কথা নয় (অপরিকল্পিত যদিও এবং অন্যান্য সমস্যা থাকা সত্ত্বেও)। দ্বিতীয়ত. আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের তুলনায় নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের সঙ্গতিপূর্ণ হার বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে জ্বালানি জুগিয়েছে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের সফলতা। তুলনীয় সময়ে বাংলাদেশে প্রায় ২৫ থেকে ৩৬ শতাংশ, ভারতে ৩০ থেকে ২১ এবং পাকিস্তানে ১৪ থেকে ২৩ শতাংশ।
সামাজিক নির্দেশকে সার্বিক পর্যবেক্ষণ অমর্ত্য সেনের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। অধিকাংশ সামাজিক নির্দেশকে পাকিস্তানের আগে অবস্থান বাংলাদেশের। বস্তুত যখন জ দ্রেজ এবং অমর্ত্য সেন মনে করেন, এসব নির্দেশকের ক্ষেত্রে ভারতসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য বাংলাদেশ পথপ্রদর্শক, তখন গর্বে বাংলাদেশির বুক ভরে ওঠে বইকি। এবার সামাজিক নির্দেশকের তুলনামূলক আলোচনায় একটু নির্দিষ্ট হওয়া যাক। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ভারতের তুলনায় শিশুমৃত্যু হার বাংলাদেশে বেশি থাকা সত্ত্বেও ২০০০-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের নিচে শিশুমৃত্যু হার নামাতে পেরেছে (বাংলাদেশ প্রতি হাজারে ১০০ থেকে ২৬, ভারত ৯৯ থেকে ২৮ এবং পাকিস্তান ১০৭ থেকে ৫৫)। পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যু হার হ্রাসে একই প্রবণতা লক্ষণীয় যেমনটি মোট প্রজননের ক্ষেত্রে। নব্বইয়ের শুরুতে প্রতিবেশী দুই দেশের তুলনায় বেশি থেকেও ইদানীং সবচেয়ে কম। খর্বকায় অনুপাত নব্বইয়ের দশকে প্রতিবেশী দেশ দুটি থেকে বেশি নিয়ে যাত্রা কিন্তু ইদানীং বাংলাদেশের অগ্রগতি অন্যদের চেয়ে ভালো। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে প্রত্যাশিত আয়ু সবচেয়ে কম ছিল বাংলাদেশে ৫৮ বছর, এখন প্রায় ৭৩ বছর। আর সে সময় পাকিস্তানে ছিল সবচেয়ে বেশি ৬০ বছর, এখন ৬৭ বছর; ভারত ৫৭ থেকে ৭০-এ তুলতে পেরেছে।
অর্থাৎ পাকিস্তান ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ বেশিদিন বাঁচে এখন। অন্যদিকে নারী বয়স্ক সাক্ষরতায় ভারতের পেছনে থেকেও এখন ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যেমন করে মেয়েদের প্রাথমিক স্কুলে অন্তর্ভুক্তিতে। তবে মাধ্যমিকে মধ্যখানে পা পিছলালেও আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ভারতকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। গেল তিন দশকে চিত্তাকর্ষক চিত্র দারিদ্র্য হ্রাসের বেলায়। চরম দারিদ্র্য প্রকোপ ভারতের চেয়ে কম বাংলাদেশে। স্ববিরোধী মনে হলেও সত্যি, আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে কম কৃতিত্ব নিয়েও পাকিস্তানে দারিদ্র্যের হার ৪-৮ শতাংশ, যা গবেষকদের ভাবায়।
দুই
সব আশাব্যঞ্জক গল্পের একটা অন্ধকার দিক থাকে। আশা এবং নিরাশার দোলাচলে আমরা প্রতিনিয়ত দোল খাই। বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রা তেমনই এক আলো-আঁধারির খেলা হিসেবে বোধ করি ভুল হবে না। একদিকে উন্নয়নের ফলে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে, অথচ ধনী-গরিব বৈষম্য ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনীতিবিদ হারসম্যান ও রথচাইল্ড বলেছেন টানেল প্রভাবের কথা : বিদ্যমান কাঠামোয় আয়বৈষম্যের প্রতি যদি সহনশীলতা কম থাকে, তাহলে ‘আগে বাড়া, পরে বিতরণ’ এমন তত্ত্ব বিপজ্জনক হতে পারে। বাংলাদেশের বিদ্যমান বৈষম্য সহগ (গিনি সহগ) বিপদসীমার কাছাকাছি। বৈষম্য বেশি হলে দারিদ্র্য নিরসনে প্রবৃদ্ধির প্রভাব খাটো থাকে অর্থাৎ একই প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে কম বৈষম্যের সমাজে দারিদ্র্য হ্রাসের হার বেশি হবে বেশি বৈষম্যের সমাজের চেয়ে। তা ছাড়া এ তীব্র বৈষম্য একটা অভ্যুত্থান/বিপ্লবের জন্ম দিতে পারে যেমন জুলাই-আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ।
আশা ছিল কুজনেটসের চুইয়ে পড়া প্রভাব তত্ত্ব (বা ট্রিকল ডাউন ইফেক্ট থিওরি) কাজ দেবে কিন্তু সে আশায় যেন গুড়ে বালি। ট্রিকল ডাউন ইফেক্ট বলতে চায়, প্রবৃদ্ধির প্রারম্ভিক স্তরে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, কিন্তু পরে চুইয়ে পড়া সুফলে বৈষম্য হ্রাস পায়। সেটা খুব একটা কাজ করছে বলে মনে হয় না কিংবা ভবিষ্যতে করবে এমন ইঙ্গিত আপাতত নেই বলে মনে হয়। আর যদি ঘটেও থাকে তা যে খুবই দুর্বল সে কথা বলা বাহুল্য। এদিকে আবার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে ঠিকই কিন্তু তা কাম্য স্তরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছে না; ব্যক্তি বিনিয়োগ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গায়।
গেল চার দশকের বেশি সময় ধরে ‘অবিশ্বাস্য’ তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধাঁধার আড়াল-আবডালে অভাবনীয় উত্থান ঘটেছে কালো এক অর্থনীতির (আন্ডারগ্রাউন্ড ইকোনমি)। মূলত প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে ‘অর্থনৈতিক শয়তানের’ অভাবনীয় আবির্ভাব ঘটেছে। অন্ধকারে থাকা এ অর্থনীতি সরকারকে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত রাখছে, রাজনীতি কলুষিত করছে, বিকৃত ভোগবাদী সমাজ সৃষ্টিতে জ্বালানি জোগাচ্ছে, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। লেখাপড়ার উদ্দেশ্য এখন দুই হাতে টাকা কামাই করা। মোটা দাগে, এটা একটা টেকসই উন্নয়নের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে।
ক্ষেত্রবিশেষ এর ভেতরে অথবা পাশাপাশি অবস্থান নিয়েছে সর্বব্যাপী চরম দুর্নীতি। যদিও এ দেশে দুর্নীতির ইতিহাস বেশ দীর্ঘ, তার পরও বিগত দশকগুলোয় রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে পুঁজিবাদ প্রসারণে উত্থান ঘটেছে একশ্রেণির দাপুটে, ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজের। বলা যায়, সমাজের অভিভাবক এখন তারাই। দুর্নীতি প্রতি বছর জিডিপির ২ শতাংশের মতো গিলে খায়। তা ছাড়া প্রতি বছর দেশ থেকে অবৈধ পথে পাচার হয় গড়ে ৭০০-৮০০ কোটি ডলার; ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত নাকি ৬ হাজার কোটি ডলার পাচার হয়েছে।
সারা অঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা? এমনকি রক্ষণশীল হিসেবেও ঋণ খেলাপের পরিমাণ দেড় থেকে দুই লাখ কোটি টাকা। এদের একটা অংশ বিদ্যমান আইনের ফাঁকফোকরে ইচ্ছাকৃত খেলাপ। শেয়ারবাজার লুট করে উত্থান ঘটেছে একশ্রেণির ধনী মানুষের। দিনদুপুরে ব্যাংক ডাকাতির কথা আপাতত না হয় থাক। তবে বলতেই হবে, ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী কিংবা ব্যাংক ডাকাতের বেশিরভাগ দেশে অথবা বিদেশে দাপটে ও সুখে আছেন। অবৈধ অর্থ আর সম্পদের জোরে তারা কিনে নিয়েছেন রাজনৈতিক নেতা এমনকি মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের।
অথচ নিয়তির নির্মম পরিহাস এই যে, তাদের কেউ কেউ দশ-বিশ বছর আগেও হিমশিম খেতেন সংসার চালাতে; কেউ ছিলেন পিয়ন, কেউ দিনমজুর। আনুক্রমিক সরকারগুলোর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এরা হয়ে উঠেছেন দানব; সমাজটা অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে তারা আজ আলোকিত, আলোচিত এমনকি মাঠে ময়দানে অভিভাবক হিসেবে অভিভূত করেন অভিভাষণে। অর্থনীতির গ্রেসামস ল অনুযায়ী, মন্দ টাকা ভালো টাকাকে বাজারছাড়া করে। তেমনি আজ এ সমাজে মন্দ লোক ভালো লোককে কোণঠাসা করে রাখছে। রাজনীতি কলুষিত হয়েছে কালো টাকায়; নীতিহীন রাজনীতিকদের অস্ত্রের ভাষা কেড়ে নিয়েছে আমজনতার ভাষার অস্ত্র। মানুষ বুঝে গেছে অর্থই সব সুখের মূল। মূল্যবোধ আঁকড়ে থাকা দুর্বলের ধর্ম।
সুতরাং ব্যাপক সংস্কারের বিকল্প নেই। আবার বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? অর্থাৎ সার্বিক সংস্কার কে করবে তারও সুরাহা হওয়া জরুরি। কেননা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে বড় বাধা। স্থিতিশীলতার কোনো বিকল্প নেই। সমৃদ্ধি-অগ্রগতি-নিরাপত্তাসহ অধিকারের সব ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। এসব ব্যাপারে দায়িত্বশীল সবার সমমনোযোগও জরুরি। আমাদের অস্থিরতার সুযোগে ভারত ও পাকিস্তান যেন অর্জিত সাফল্য ছিনিয়ে নিতে না পারে সে কামনা সবার।