মধ্যপ্রাচ্য সংকট
রিক জান্ড
প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:২৪ এএম
রিক জান্ড
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত অপরাধের বিচার করার জন্য আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইন পশ্চিমা গণতান্ত্রিক আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত। ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস (ইউডিএইচআর) বর্তমানে কিছু মানবিক ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে। কারণ এই আইনই কীভাবে মানবিক ব্যবস্থা পরিচালিত হবে, তা নির্ধারণ করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন ডি রুজভেল্টের স্ত্রী ইলিয়নয়া রুজভেল্ট দেশটির গ্রেট ডিপ্রেশনের পরিস্থিতি দেখে সর্বপ্রথম সামাজিক নিরাপত্তার মতো বিষয় নিয়ে জাতিসংঘে কাজ করার উদ্যোগ নেন। তিনিই সর্বপ্রথম ৩০ আর্টিকেলের মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকারবিষয়ক প্রস্তাবনা জাতিসংঘে উপস্থাপন করেন। এটিকেই আমরা ইউএইচডিআর বলে চিনে থাকি। মূলত এই ব্যবস্থাপনাতেই জীবনযাপনের মৌলিক অনুষঙ্গ, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়াবলি নিয়ে আলোচনা করা হয়। ফিলিস্তিনের প্রথম নাকবা অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সর্বপ্রথম ইউএইচডিআর বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এই প্রস্তাবনা ফিলিস্তিনিদের ওপর কোনোদিন প্রয়োগ করা হয়নি।
মূলত আন্তর্জাতিক
আইন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নির্ধারিত এই আইন ফিলিস্তিনিদের কাজে আসেনি। জাতিসংঘের প্রস্তাবিত
দুই রাষ্ট্র সমাধান করার বিষয়টি জায়োনিস্ট নেতারা গ্রহণ করেননি। আরব লিগ কিংবা ফিলিস্তিনিদের
কথাও তারা পাত্তা দেয়নি। এই প্রস্তাবনা অনুযায়ী জায়োনিস্ট নেতাদের কাছে ৫২ শতাংশ জমির
মালিকানা যাওয়ার কথা। অপরদিকে আরব রাষ্ট্রের জন্য ৪৫ শতাংশ ভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাকি
তিন শতাংশ ভূমি জেরুজালেম ও বেথেলহেমকে নিয়ে গঠিত হবে; যা আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
ফিলিস্তিনিদের পৈতৃক ভূমি এভাবে বৈষম্যের ভিত্তিতে বণ্টন কোনোভাবেই মেনে নেওয়া না হলেও
জায়োনিস্ট নেতারাই এখানে বেশি গুরুত্ব পান। অথচ ইহুদির সংখ্যা ছিল ছয় লাখের সামান্য
বেশি এবং প্রায় ১৩ লাখ মানুষ ছিল ফিলিস্তিনি। আন্তর্জাতিক একটি আইন গ্রহণের পরও মানবিক
সহায়তা কেন আইনি কোনো সুবিধাই ফিলিস্তিনিরা পাননি। হাস্যকর হলেও সত্য, আন্তর্জাতিক
মানসিক সহায়তা আদায়ের ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা ছিল, যা তৎকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতিকরা
অনুধাবন করতে পারেননি। ওই সময় ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনের একাধিক গ্রামে গণহত্যা, ধর্ষণ
ও লুটপাট চালায়। গণহত্যা চালানোর এ সময়ে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন করে ফিলিস্তিনিদের
ন্যায়বিচারে আশ্বস্ত করে।
জাতিসংঘ আরও কিছু
হাস্যকর সিদ্ধান্ত নেয়। পরে জেনেভা কনভেনশন চালু করা হয়, যাতে ইহুদি গণহত্যার মতো ঘটনার
পুনরাবৃত্তি না ঘটে। এই আইনের অধীনে গণহত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে।
জেনেভা কনভেনশনের দিকে তাকালে অন্তত বোঝা কঠিন ফিলিস্তিনিদের বর্তমান অবস্থা কীভাবে
গণহত্যার সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ নয়। নিজ বাসভূমেই তারা হত্যার শিকার, তাদের বাস্ত্যুচ্যুত
করা হচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে গণহত্যার বিষয়টি ১৯৯০-এর আগেও জাতিসংঘের সামষ্টিক
ভাবনায় গুরুত্ব পায়নি। এ ভাবনা থেকেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ রিসপন্সিবিলিটি টু প্রটেক্ট
নামে একটি প্রস্তাবনা ২০০৫ সালের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত
নেয়। এই আইন অনুসারে, জাতিসংঘ গণহত্যা বা আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থি কাজ করলে জাতিসংঘের
সদস্য অন্য কোনো রাষ্ট্র মধ্যস্থতার ভূমিকায় আসতে পারে। বিগত দুটো আইনের তুলনায় এই
আইনের বাস্তবায়নের সম্ভাবনা ছিল বেশি। বরং এই আইন পশ্চিমা বিশ্বের হেজেমনিকে অস্ত্র
হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। এই আইনের মাধ্যমে লিবিয়ার নেতা কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে
হঠানো হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। অথচ গাদ্দাফি এর
আগেও যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবনায় স্বাক্ষর করেছিলেন, কিন্তু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ
ও ন্যাটো তা বাতিল করে দেয়। ফিলিস্তিনিদের অধিকার সংরক্ষণের বদলে এই আইন উল্টো ইসরায়েলের
জাতিগত নিধনকে সহযোগিতা দেয়।
প্রাচ্যের যেকোনো
রাষ্ট্রের জন্য আন্তর্জাতিক আইন পশ্চিমা আধিপত্যবাদীদের অস্ত্রই বলা যায়। কারণ তাদের
আধিপত্য যাতে নষ্ট না হয়, তা নিশ্চিত করতেই এই আইন চালু করা হয়েছে। ইরাকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট
জর্জ ডব্লিউ বুশ অভিযান চালানোর সময় আন্তর্জাতিক আইনকেই ব্যবহার করেছেন। তিনি সাদ্দাম
হোসেনের ওপর অবৈধ ক্ষেপণাস্ত্র রাখার অভিযোগ তুলেই সামরিক অভিযান চালান। এক্ষেত্রে
আন্তর্জাতিক আইন সফল হলেও জায়োনিস্ট রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘ
গাজায় গণহত্যার আলামত রিপোর্ট আকারে সংরক্ষণ করে ২০০৪, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালে। জাতিসংঘের
মানবাধিকার সংগঠন ‘গোল্ডস্টোন রিপোর্ট’ প্রণয়ন করে। আইডিএফের প্রধান ওই সময় কী কী অপরাধ
করেছিলেন, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ছিল সেখানে। নরমান জি ফিংকেলস্টেইন পরে তার বইয়ে
লেখেন, ‘গোল্ডস্টেইন রিপোর্ট অনুসারে ইসরায়েল গাজায় নির্বিচারে হত্যা, মানুষকে অপমান
এবং বেসামরিক নাগরিকদের আতঙ্কগ্রস্ত করছিল। তারা গাজার অর্থনীতিকে পুরোপুরি ধসিয়ে দেওয়ার
চেষ্টা করছিল। ফিলিস্তিনকে তারা নিজের উপনিবেশ বানিয়ে তুলতে চাচ্ছিল। গাজার মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ
হবেÑ এমন ভাবনা থেকে তাদের দূর করার চেষ্টাই ছিল অভিযানের মূলকথা।’
অন্যদিকে আমেরিকান
ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিউনিটি এই রিপোর্টকে মিথ্যা ও অপপ্রচারমূলক বলে অভিহিত
করে। শিগগিরই রিপোর্টের লেখক, যিনি নিজেও জায়োনিস্ট ছিলেন তিনি জানান, এই রিপোর্ট করার
সময় তিনি কাস্ট লিডের ব্যবহার করেছিলেন। ইসরায়েলের নেতৃত্ব দ্রুতই মানবাধিকার সংরক্ষণে
তাদের সফলতার বিষয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। রেড ক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটি অনুসারে যেকোনো
দখলদার শক্তি শনাক্ত করার ক্ষেত্রে বলেছে, ‘কোনো দখলদার রাষ্ট্র যদি এমন কোনো নীতিনির্ধারণ
করে কিংবা ব্যবস্থা নেয়, যাতে দখলকৃত এলাকায় স্থায়ী পরিবর্তন বিশেষত সামাজিক, অর্থনৈতিক
এবং গণতান্ত্রিক অবকাঠামোয় পরিবর্তন আনলে তা মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে।’ তাদের আইন অনুযায়ী
যারা দখলদার তারা কোনোভাবেই দখলকৃত এলাকায় স্বাভাবিক জীবনে রদবদল আনবে না। ওই নির্দিষ্ট
এলাকায় স্বাভাবিক জীবনযাপনে যেন কোনোভাবেই বড় পরিবর্তন না আসে, তা লক্ষ করতে হবে। কিন্তু
জায়োনিস্ট নেতারা কখনই ফিলিস্তিনিদের জন্য এমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। গাজা ও পশ্চিম
তীরে ফিলিস্তিনিদের আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে কোনো সুবিধাই দেওয়া হয়নি। গাজার আর্থসামাজিক
ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। পশ্চিম তীর কিংবা গাজায় স্বাভাবিক জীবনের কোনো অস্তিত্বই
নেই। পরে হেগ রেগুলেশন্স এবং চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের পাশাপাশি আরও কিছু আন্তর্জাতিক
আইন আসে। তারা দখলদার শক্তিকে ভূমি দখল না করার জন্য অনেক নিয়ম বেঁধে দেয়। ইসরায়েল
ও যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই এমন আইনকে তোয়াক্কা না করে আসছে। ফিলিস্তিনের আরও ভূমি ইসরায়েলের
দখলে যেতে থাকে এবং উত্তর গাজা জনশূন্য করার জন্য এখনও তাদের অভিযান চলমান রয়েছে। আন্তর্জাতিক
সম্প্রদায় এগুলো দেখেও না দেখার ভান করছে। আন্তর্জাতিক আইন তার গতিতে চলে। পশ্চিমা
আদর্শ রক্ষায় তাদের অবস্থানও পোক্ত। কিন্তু পশ্চিমা শক্তি অবৈধ দখলদারিত্ব বন্ধের ক্ষেত্রে
কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। বিশেষত ফিলিস্তিনে এ মানবিক সংকট আরও পোক্ত হয়েছে। ইসরায়েল,
যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক পরিসরে সামান্য দায়বদ্ধতাই দেখিয়ে
গেছে। গাজায় নির্বিচারে গণহত্যা এবং অবৈধ দখলদারিত্ব বন্ধে তাদের কোনো উদ্যোগই নেই।
এমনকি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ বিষয়ে তাদের অন্ধ অবস্থান ধরে রেখেছে।
জবাবদিহিমূলক
কার্যক্রম ব্যতীত আন্তর্জাতিক আইন কোনো কাজেরই নয়। আর জবাবদিহিমূলক কার্যক্রমও অর্থহীন
যদি সমতার ভিত্তিতে বাস্তবায়িত না হয়। পশ্চিমা বিশ্ব ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচারে
হত্যাকে যেভাবে সমর্থন করে যাচ্ছে, তা-ই বলে দেয় সমতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আইন পরিচালিত
হচ্ছে না। ইসরায়েলিরা বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করছে তা স্পষ্ট অপরাধ। অথচ তারা ফিলিস্তিনি বেসামরিক
নাগরিক হত্যাকাণ্ডকে ভুলবশত ঘটেছে বলে রায় দিয়েছে। ফিলিস্তিনিরা হত্যা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র,
যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সরবরাহ করা অস্ত্রে। সম্ভবত ট্রাম্পের সময়ে বদল আসবে।
ধারণা করা যেতে পারে, ফিলিস্তিনের ধ্বংস এখন আরও দ্রুত ও অবধারিত হয়ে উঠবে। পশ্চিমা
বিশ্ব বরাবরই বলতে শুরু করবে, তারাই মানবাধিকার সংরক্ষণের ধ্বজাধারী হিসেবে আবির্ভূত
হবে। কিন্তু তারা কখনই বুঝতে পারবে না, গোটা বিশ্বের কাছে কীভাবে পশ্চিমা বিশ্ব হাসির
পাত্র হয়ে উঠছে।
মিডল ইস্ট
মনিটর থেকে অনুবাদ : আমিরুল আবেদিন