সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:২৬ এএম
দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে বিগত কয়েক মাস ধরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ৯ নভেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর অনলাইন সংস্করণের প্রতিবেদনে ফের এই চিত্রই উঠে এসেছে। ওই দিন সকাল থেকে গাজীপুরে তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। মধ্যে কিছুদিন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের প্রচেষ্টায় শ্রমিক আন্দোলন বন্ধ থাকলেও এর যে কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি, গতকালের গাজীপুরের ঘটনাটি এরই সাক্ষ্য বহন করছে। অথচ দেশের অর্থনীতিতে রিজার্ভের পারদ ঊর্ধ্বমুখী হয় তৈরি পোশাক রপ্তানির মধ্য দিয়ে। রপ্তানি পণ্যের তালিকায় অগ্রভাগে রয়েছে তৈরি পোশাক এবং এই পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক। সেই শিল্পে ফিরে ফিরে যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, এর কারণগুলো আমাদের অজানা নয়।
তৈরি পোশাক শিল্পে
অতীতেও অস্থিরতার বহুমাত্রিক বিরূপ প্রভাব দৃশ্যমান হয়েছে বটে, কিন্তু এবার দেশে সম্পূর্ণ
ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এই শিল্পে ইতোমধ্যে দফায় দফায় যে শ্রমিক অসন্তোষ পরিলক্ষিত হয়েছে
তাতে নিরুদ্বিগ্ন থাকার কোনো উপায় নেই। আমরা দেখছি, দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে শান্তিপ্রিয়
মানুষ যখন রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখছে এবং অন্তর্বর্তী সরকার মানুষের স্বপ্ন
পূরণে নানামুখী সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, তখন আমাদের রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে
ফিরে ফিরে দেখা দিচ্ছে অস্থিতিশীলতা। নিকট অতীতে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর ভিন্ন একটি
প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ক্রেতা এবং দেশের তৈরি পোশাক কারখানার
মধ্যে মধ্যস্থতাকারী একটি প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, সময়মতো শিপমেন্ট করতে না পারায় তাদের
৯০ শতাংশ ক্রয়াদেশ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে চলে গেছে। তারা আরও জানিয়েছিল, ডিসেম্বরের
মধ্যে আরও ক্রয়াদেশ সরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের অজানা নয়, দেশের বড় পোশাক কারখানাগুলো
গড়ে উঠেছে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভার এলাকায়। এর বাইরে
চট্টগ্রাম ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু তৈরি পোশাক শিল্প গড়ে উঠলেও মূলত এই খাতের শিল্প
প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকা ও এর আশপাশেই বেশি।
শিল্পের উৎপাদন
শক্তির মূল অনুষঙ্গ শ্রমিক। শ্রমিকদের অসন্তুষ্ট রেখে উৎপাদনের চাকা যেমন গতিশীল করা
সম্ভব নয়, তেমনি শ্রমিকদেরও শিল্প উদ্যোক্তাদের স্বার্থ সুরক্ষায় আন্তরিক না থাকার
অবকাশ নেই। উভয় পক্ষের সমঝোতার মধ্য দিয়েই উৎপাদন কিংবা শিল্পের বিকাশ এবং উভয় পক্ষের
স্বার্থ সুরক্ষার বিষয়টি বহুলাংশে নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে,
অতীতে বহুবার কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের অপচেষ্টায় তৈরি পোশাক শিল্প খাতে অস্থিরতা
এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিল যে, এর ফলে হতাহতের মতো মর্মস্পর্শী ঘটনাও কম ঘটেনি। করোনা
বিপর্যয় পরবর্তী সময়ে দেশের তৈরি পোশাক শিল্প খাত যূথবদ্ধ প্রচেষ্টায় ঘুরে দাঁড়ালেও
এর স্থায়িত্ব দীর্ঘ হয়নি। আমরা যেমন শ্রমিক পক্ষের স্বার্থের সুরক্ষার দাবি জানাই,
তেমনি মালিক কিংবা উদ্যোক্তাদেরও শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় যথাযথ নিয়মকানুন মানার
আহ্বান জানাই। বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আরও অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে, কিন্তু
আমাদের এই খাতের পণ্যের দিকে বিদেশি ক্রেতাদের বিশেষ আগ্রহ থাকলেও এখন তা ব্যাহত হচ্ছে।
আমাদের স্মরণে আছে, গত ১২ সেপ্টেম্বর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘ন্যাশনাল বিজনেস ডায়লগ’
অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘শ্রমিক-মালিক-সরকার
টিম হয়ে কাজ করবে। ব্যবসা করা একটি সংগ্রাম, এ সংগ্রামটি আমরা সহজ করব।’ আমরা প্রধান
উপদেষ্টার এই বক্তব্যের সাধুবাদ জানিয়ে এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেও বলেছিলাম, ব্যবসার অনুকূল
পরিবেশ তৈরি করা এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ভিন্ন বিকাশমান এই শিল্পের ঔজ্জ্বল্য
ধরে রাখা দুরূহ।
আমরা অত্যন্ত
গুরুত্বের সঙ্গে মনে করি, এ খাতের কর্মী ও মালিকপক্ষের মধ্যে যদি সদ্ভাব এবং পারস্পরিক
সহযোগিতা-সহমর্মিতার বিষয়গুলো পুষ্ট করা যায়, তাহলে শিল্প ও শিল্পের শ্রমিক-কর্ণধারদের
স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত করা দুরূহ কোনো বিষয় নয়। দেশের কর্মসংস্থানের অন্যতম একটি
বড় খাত তৈরি পোশাক শিল্প। নিকট অতীতে এই শিল্পের অস্থিরতার ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমে কিছু
শ্রমিক নেতার বক্তব্য উঠে এসেছিল। তারা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে প্রায় অভিন্ন মন্তব্যই
করেছিলেন। তাদের বক্তব্য ছিল, ক্ষমতার পালাবদলে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী তাদের হীনস্বার্থ
চরিতার্থকরণে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ঝুট ব্যবসা ও চাঁদাবাজি নিয়ে শিল্পাঞ্চলে অস্থিতিশীলতা
সৃষ্টির অপচেষ্টা তারাই ফিরে ফিরে করে থাকে। আমরা শ্রমিক নেতাদের ওই অভিযোগ খতিয়ে দেখার
ওপরও গুরুত্বারোপ করেছিলাম। বেকার সমস্যা সমাধানে ও দেশের অর্থনীতির বিকাশে যে খাতটির
এত ব্যাপক ভূমিকা, সে খাতে অস্থিতিশীলতা যদি জিইয়ে থাকে, তাহলে এর বিরূপ প্রভাব কতটা
বহুমুখী হতে পারেÑএর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নতুন করে নিষ্প্রয়োজন।
বিদ্যমান পরিস্থিতির
স্থায়ী নিরসনে জাতীয় স্বার্থে সরকারের তরফে এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে
আমরা মনে করি। শ্রমিক-মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে আলোচনার টেবিলে এর স্থায়ী সমাধান
খোঁজার বিকল্প নেই। আমরা যেকোনো মূল্যে এই শিল্প খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ওপর
বারবার জোর দিচ্ছি। কারণ, এই শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের মাধ্যমে শুধু আমরা বৈদেশিক মুদ্রাই
অর্জন করছি না, বিশ্বের দেশে দেশে আমাদের পরিচয়ও এই শিল্প খাতটি নতুনভাবে তুলে ধরছে।
আমাদের পোশাক খাত নিয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা ইতোমধ্যে বহুবার উঠে এসেছে। আমরা
সে দিকেও নজর গভীর করার তাগিদ দিই। রপ্তানি কিংবা ক্রয়াদেশ যাতে অন্য দেশে চলে না যায়,
এর জন্য সর্বাগ্রে জরুরি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। রপ্তানিমুখী এ শিল্পকে বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট
সবাইকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। বিদেশি ক্রেতাদের দেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা
পৌঁছে দিতে শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে অন্য কোনো ষড়যন্ত্র রয়েছে কি নাÑ তাও খতিয়ে দেখা
জরুরি। যেহেতু দেশের পোশাক শিল্পের অসন্তোষের নেপথ্যে বারবার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠে
আসে, সেহেতু এ ব্যাপারে অধিকতর সতর্কতার বিকল্প নেই। সংকট যত দীর্ঘায়িত ও জটিল হবে,
আমাদের জন্য দুঃসংবাদের তালিকাও তত দীর্ঘ হবে। মনে রাখতে হবে, এর সঙ্গে আমাদের জাতীয়
স্বার্থ জড়িত এবং শ্রমিক অসন্তোষসহ নানাবিধ কারণে ক্ষতির তালিকা ইতোমধ্যে কম দীর্ঘ
হয়নি। সংখ্যানুপাতে বিশ্বের সর্বোচ্চসংখ্যক পরিবেশবান্ধব তৈরি পোশাক কারখানা এখন বাংলাদেশে।
এ খাতের টেকসই উন্নয়নের পাশাপাশি স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণের কোনো বিকল্প নেই।