ক্রিকেট
ইকরামউজ্জমান
প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:২১ এএম
আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:২৪ এএম
ইকরামউজ্জমান
আমাদের ক্রিকেটে ব্যর্থতার পাল্লা ক্রমেই কেন ভারী হচ্ছে-এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান জরুরি। খেলাটি ঘিরে বাড়ছে আশঙ্কা এবং উৎকণ্ঠা। ক্রিকেটারদের মাঠের পারফরম্যান্সে ক্রীড়ামোদীদের স্বস্তিবোধ দূরের কথা, বরং তারা অবাক ও হতাশ। একটি প্রশ্ন সবার মুখে ঘুরপাক খাচ্ছেÑ ক্রিকেটাররা এত বিবর্ণ, ক্লান্ত এবং অকার্যকর কেন হয়ে পড়েছেন? বর্তমানে মাঠের যে অভিজ্ঞতা তা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। খেলায় হারজিত আছে। তবে মেরুদণ্ডহীন ক্রিকেট খেলে নাক নিচুতে নামিয়ে বারবার মাঠ থেকে ফিরে আসা তো মেনে নেওয়া যায় না। বলে-বীর্যে-বুদ্ধিতে দৃঢ় না হলে এ খেলা মূল্যহীন। আমরা খেলব আর প্রতিপক্ষ আমাদের বিপক্ষে খেলে অভাবনীয় কিছু দেখাবে, এর জন্য তো খেলা নয়! আমাদের খেলা তো অন্যের গৌরব সৃষ্টির জন্য হতে পারে না। ক্রিকেটে ব্যর্থতার পাল্লা ক্রমেই কেন ভারী হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দাবি। নিশ্চয়ই এ দাবি উপেক্ষার অবকাশ নেই। শুধু কথাবার্তা ও আলোচনাই এর জন্য যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন আন্তরিক পদক্ষেপ; যেখানে যা দরকার করতে হবে তা-ই।
আমরা কেন আসল
সময় আমাদের ক্রিকেটটা খেলতে পারছি না। ক্রিকেটারদের ওপর কোনো বাড়তি চাপ নেই। বলা হচ্ছে
স্বাভাবিক খেলাটা খেলো; আর খেলাটা উপভোগ করো। চেষ্টা করো সময়মতো সামর্থ্যের প্রতিফলন
ঘটাতে। এই তো চাওয়া। আত্মবিশ্বাস, মনঃসংযোগ, মানসিক শক্তি, দৃঢ়তা, ধৈর্য এবং ইতিবাচক
মানসিকতায় ঘাটতি থাকলে তো ক্রিকেট এলোমেলো হবেই। নেটে সবকিছু ঠিকঠাক কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতায়
নেমে উল্টো কাজটি করলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে প্রতিপক্ষ ধ্বংস করে দেবে। দেশের খেলা
তো স্রেফ একটি খেলা কখনও নয়। দেশের হয়ে খেলা তো অনেক বড় প্রেরণা ও সম্মান। যোগ্যতা
আছে বলেই দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাওয়া। নিজের স্কিল এবং টেকনিক যথাযথভাবে কাজে
না লাগাতে পারলে পরে অনুশোচনা করে লাভ নেই। আফগানিস্তানের সঙ্গে হারার পর অধিনায়ক নাজমুলের
উপলব্ধিÑ উইকেটে যদি থাকতাম তাহলে এ অবস্থা হয়তো হতো না। সেট ব্যাটসম্যান নাজমুল কীভাবে
উইকেট বিলিয়ে দিয়ে এসেছেন?
উইকেটে ‘সেট হওয়ার’
পরÑ উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসা তো রীতিমতো অপরাধ। টপ অর্ডার, মিডল অর্ডার এবং লোয়ার অর্ডারে
একই অবস্থা। অভিজ্ঞ আর নবীন ক্রিকেটারের মধ্যে পার্থক্য নেই। হুড়মুড় করে ব্যাটিংয়ে
ধস নামা যেন বড়ই সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সময় বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ক্রিকেটার
নেই। ঘরের মাঠে এবং বাইরে একই অবস্থা তিন সংস্করণে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে জিততে হলে
রান করতে হবে ২৩৬। ২ উইকেটে ১২০ রান। এরপর ২৩ রানে ৮ উইকেট বিলিয়ে দিয়ে ৯২ রানে পরাজয়।
অবিশ্বাস্য পরাজয়। জঘন্য ব্যাটিং। ১৮ বছরের আল্লাহ গজনফর, যিনি মাত্র পাঁচটি টি-টোয়েন্টি
খেলেছেন, বাংলাদেশের ‘ছয় বাঘ’কে খাঁচায় বন্দি করে ফেললেন মাত্র ২৬ রানের বিনিময়ে! বাংলাদেশ
পারেনি ৩৫ ওভারও টিকে থাকতে উইকেটে। আফগানিস্তান গত মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ
জিতেছে। আফগানরা ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানে চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফিতে অংশ নেওয়ার
প্রস্তুতি বিষয়ে ভীষণ সিরিয়াস। বাংলাদেশও খেলবে এ ট্রফিতে। প্রস্তুতিটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলতে নামার আগে। এতে নির্ভার ক্রিকেট খেলা সম্ভব হয়।
সবচেয়ে বড় বিষয়
হলো, প্রত্যয় এবং নিজের ওপর বিশ্বাস। বাংলাদেশের সঙ্গে ওয়াইটওয়াশ হওয়ার পর পাকিস্তান
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জিতেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে দাপটের সঙ্গে জেতার পর নিউজিল্যান্ডের
সঙ্গে সিরিজ হেরেছে ভারত। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ভারতের প্রস্তুতিতে গলদ ছিল। পাকিস্তানের
সঙ্গে প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজ বিজয়। এরপর ভারতের মাটিতে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি সিরিজ
হারার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। আধুনিক ক্রিকেট কী এবং তার চিন্তাভাবনা কীভাবে বাস্তবায়িত করা
সম্ভব; টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে তার একটি প্রদর্শনী বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা দেখেছেন আর
অবাক হয়ে পার্থক্য নির্ণয় করার চেষ্টা করেছেন। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দেশের
পরিচিত উইকেটে করুণভাবে আত্মসমর্পণ টেস্ট সিরিজে। তরুণ খেলোয়াড়দের সমন্বয়ে গঠিত দলের
অধিনায়ক বলেছেন, ‘আমরা ভাবতে পারিনি এত সহজে বাংলাদেশ দলকে পরাজিত করা সম্ভব হবে।’
আরও অবাক হয়েছি স্বাগতিক দল নিজ দেশের উইকেটকেও সঠিকভাবে পড়তে পারেনি। অধিনায়ক এইডেন
মার্করাম আরও বলেছেন, ক্রিকেট এমন একটি খেলা যেখানে অন্য কিছু মাথায় ঢোকালে আর ক্রিকেটে
থাকা সম্ভব হয় না।
ক্রিকেট পুরোপুরি টিমওয়ার্ক। এখানে সবাইকে ভালো পারফরম্যান্স
করতে হয়। সবার মধ্যে বোঝাপড়াটাও থাকতে হবে সে রকমই। এখানে কোনো কোন্দল-মানসিক দূরত্ব-বৈষম্যের
যেন ছায়া না থাকে। আমরা আমাদের ক্রিকেট নিয়ে হতাশ হতে চাই না, কিন্তু কেন অবনতি ঘটছে
এর জন্য উৎসে নজর দিয়ে যথাযথ প্রতিবিধান করার দাবি জানাই। ক্রিকেট আমাদের প্রত্যাশার
বড় ক্ষেত্র, এর ক্রমবিকাশে আমাদের গর্বের খতিয়ান দীর্ঘ হোক তা-ও প্রত্যাশা। আর প্রত্যাশার
সঙ্গত কারণও তো বিদ্যমান। কারণ ক্রিকেটে আমাদের অর্জন তো কম নয়। এ অর্জনের বিসর্জন
কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। নীতিনির্ধারকরা গভীরভাবে এসব ভাবুন। ভাবতে হবে ক্রিকেটারদেরও।
ক্রিকেটের সেই অর্জনের আলো ফেরানোর দায় সংশ্লিষ্ট সবার। বিভাজন নয়, চাই ঐক্য। ঐক্যই
ছড়াতে পারে আলো। দূর হোক অন্ধকার।
দক্ষিণ আফ্রিকার
বিপক্ষে এক দিনেরও কম সময়ে ১৫টি উইকেট হারিয়ে (ইনিংস এবং ২৭৩ রানে পরাজয়) দুই দিন বাকি
থাকা সত্ত্বেও খেলা সাঙ্গ! টানা চার টেস্ট (ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা) হার। আর এ হার প্রতিদ্বন্দ্বিতা
সৃষ্টি না করে। চট্টগ্রামে অধিনায়ক নাজমুল মিডিয়াকে বলেছেন, ‘আমাদের দক্ষতার অনেক জায়গা
আছে, যেসব জায়গায় উন্নতি করতে হবে এবং পাশাপাশি চিন্তাভাবনায় অনেক পরিবর্তন আনতে হবে।
উন্নতি করতে হবে এ কথাটা তো আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। তবে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত
করাটা খুব জরুরি। আসলে হচ্ছেটা কী! টেস্ট ক্রিকেটে যদি টপ-অর্ডার থেকে পার্টনারশিপ
না হয় তাহলে পরের ব্যাটসম্যানদের জন্য খুবই কঠিন। আমি জানি না ওপরে যারা ব্যাটিং করে
তারা কী চিন্তা করে বা কী রকম প্রস্তুতি নেয়। তবে এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে এ রকম
ফলই হবে।’
বাংলাদেশ দলের
সাবেক অধিনায়ক বর্তমানে একজন কোচ আমিনুল ইসলাম বুলবুল শারজায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে
প্রথম ম্যাচ দেখার পর মিডিয়াকে বলেছেন, ‘জয়পরাজয় তো থাকতেই পারে, কিন্তু অধিনায়কত্ব
আর ব্যাটিং পরিকল্পনা দেখে সত্যি বিস্মিত হয়েছি। সবকিছু যেন ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। শরীরী
ভাষা, বলের প্রতি মনোযোগ, প্রি বল রুটিন, পুরোটা মিশিয়ে পরিকল্পনা খুবই দুর্ব মনে হয়েছে।’
তার মন্তব্য পর্যালোচনা দরকার। কেন ক্রিকেটারদের মধ্যে ক্রিকেটের ভাষার ঘাটতি দেখা
দিয়েছে এর অনুসন্ধান জরুরি। আমাদের চাওয়ার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যর্থতা-সফলতার
চুলচেরা বিশ্লেষণ দরকার। নির্বাচকদের বরাবরই থাকতে হবে নির্মোহ। দলে যেন কোনো বিভক্তি
না থাকে এবং যোগ্যরা যাতে দলে স্থান পায় তা-ও সব সময় থাকতে হবে আমলে। পর্যালোচনা যদি
যথাযথ না হয় তাহলে ভুল শোধরানো যাবে না।
আমরা আমাদের ভালো ক্রিকেটটাই দেখতে চাই। আর এর জন্য জরুরি সংশ্লিষ্ট সবার যথাযথ ভূমিকা। অনুশোচনা নয়, দরকার আত্মসমালোচনা। আত্মসমালোচনা আত্মশুদ্ধরি পথ উন্মুক্ত করে। যার যে দায় ও দায়িত্ব তা পালন করতে নিষ্ঠা খুব জরুরি। আমাদের ক্রিকেটাররা তো ভালো ক্রিকেট খেলছেন, কিন্তু এর ধারাবাহিকতা থাকল না কেন? সব সময় ভালো খেলবে দল তা-ও নয়, জয়পরাজয় থাকবেই; কিন্তু খেলায় যেন ধস পরিলক্ষিত না হয়। খেলা হোক প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। কখনও কখনও খেলায় কিছুটা ভাটা পড়তেই পারে এবং অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আবার হতে হবে পরিশীলিত। ক্রিকেটের সুদিন ফিরে আসুক।