সংস্কার
ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২৪ ১২:২৮ পিএম
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ এখনও ঠিক না হলেও বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ প্রায় সব দলই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। যৌক্তিক সময়ে নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ইতোমধ্যে তাগিদ দিয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। পাশাপাশি তাদের নেতাকর্মীরা নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সারা দেশে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। মূলত এরই অংশ হিসেবে নির্বাচনী প্রচারে নেমেছে দলগুলো। দেশের মানুষের মধ্যে আবারও ভোট দেওয়ার আগ্রহ দেখা দিতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে নির্বাচনব্যবস্থার সুষ্ঠুতা, স্বচ্ছতা এবং অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে তাগিদও আসতে শুরু করেছে। পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নির্বাচন সংস্কার কমিশন গঠন করে। ৩০ অক্টোবর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সার্চ কমিটিও চূড়ান্ত হয়েছে। অর্থাৎ নির্বাচনের যাত্রা হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনী কাঠামো নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের তিনটি বিষয়ে মনোযোগ বাড়ানো জরুরি। বিষয়গুলো হলো জনপ্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় সরকার কাঠামো। তিনটি বিষয় আলাদা গুরুত্বের দাবিদার বিধায় আলাদাভাবে এগুলো নিয়ে আলোচনা করাই শ্রেয়। শুরুতেই জনপ্রশাসনের সংস্কারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা জরুরি।
দেশের বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে জনপ্রশাসনের সংস্কার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের দাবিদার। বিদায়ি সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের কারণে জনপ্রশাসনিক কাঠামোর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। জনপ্রশাসনের সুষ্ঠু কাঠামোর ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের বদলি, পদায়ন, জবাবদিহি, অনিয়মের তদন্ত এবং অভিজ্ঞতার নিরিখে তাকে উপযুক্ত স্থানে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পায় বেশি। আমরা দেখছি, দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অরাজকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পাওয়ার পর জনপ্রশাসনে রদবদল এনেছে। এ ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য রয়েছে। প্রশাসনে মেরিট ভিত্তিতে কাউকে পদায়ন-পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে নাকি তার বিপরীত পদ্ধতিতে প্রশাসনিক দায়িত্ব বণ্টন হয়েছে তা স্পষ্ট নয় দীর্ঘদিন ধরে। এমন ব্যবস্থা রাতারাতি বদলে ফেলাও কঠিন। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারের জনপ্রশাসনবিষয়ক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অনেক সময় অনিশ্চয়তা বা দ্বিধার আভাস দেখা যাচ্ছে। প্রশাসনে অরাজকতার ভিত্তিতে দায়িত্ব বণ্টনকে বলা হয় স্পয়েল সিস্টেম। বিগত ১৫ বছর প্রশাসনে এ স্পয়েল সিস্টেমই প্রশাসনিক কাঠামোর ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর প্রশাসনে তা জাঁকিয়ে বসে। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক কর্মকর্তা দলীয় আনুগত্যের বিনিময়ে নিজস্ব কিছু স্বার্থ উদ্ধার করতেন। এজন্যই প্রশাসনে দলীয়করণ ও রাজনৈতিক প্রভাববলয় কিছু ফাঁক সৃষ্টি করে। এ শূন্যতা অনিয়ম-দুর্নীতিকে আরও বেশি প্রশ্রয় দিয়েছে এবং অভিযোগ আসার পরও তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা এবং শেষ পর্যন্ত উপযুক্ত প্রতিবিধান নিশ্চিত করা যায়নি। অভিযোগ রয়েছে, মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা নির্বাচনের সময়ও নানাভাবে প্রভাব খাটিয়েছেন। বস্তুত একদলীয় সংসদকাঠামো না থাকলেও প্রশাসন একদলীয় হয়ে উঠেছিল। এজন্যই রাজনৈতিক মদদপুষ্ট প্রশাসনিক আমলারা সর্বেসর্বা হিসেবে দীর্ঘদিন অনিয়মে জড়িয়েছেন। এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার জনপ্রশাসন সংস্কার কমিটি প্রণয়ন করেছে। কিন্তু এ কমিটি যে নীতি প্রণয়ন করবে তা বাস্তবায়নের জন্য জনগণের নির্বাচিত রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিটি ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। এ কমিটির দায়িত্বশীলদের মনে রাখতে হবে, তারা যে সুপারিশমালা প্রণয়ন করবেন তা বাস্তবায়নের জন্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। এজন্যই একটি স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন জরুরি। জনগণের উৎসাহের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় বসলে তাদের জবাবদিহি থাকবে। জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে এমন এক সরকার সংস্কারের ইতিবাচকতার নিরিখে কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে। এ বিষয়টির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সুপারিশমালা তৈরি করার ক্ষেত্রে কমিশনের সদস্যদের সুচিন্তিত মতামত এবং দেশের প্রশাসনিক বাস্তবতার পূর্ণ চিত্রায়ণ থাকা জরুরি। দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং চিন্তা করতে হবে জনগণের স্বার্থে প্রশাসন কীভাবে কাজ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি গতিশীলতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। এমনকি প্রশাসনে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। সংস্কার যেহেতু গতিশীল প্রক্রিয়া তাই কাজগুলো সমন্বয়ের ভিত্তিতে করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার এ মুহূর্তে প্রশাসনিক কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য নানা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমরা দেখছি, জনপ্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা তাদের দাবিদাওয়া উপস্থাপন করছেন। যৌক্তিক দাবিদাওয়া থাকলে তা জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বিবেচনা করবে। কিন্তু তড়িঘড়ি করে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে দাবিদাওয়া আদায়ের প্রক্রিয়া অনেকাংশে প্রশাসনের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে। তা ছাড়া এমনটি প্রশাসনের গতিশীলতার পথেও বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। জনপ্রশাসনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এখন যা যা সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি সে ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলে চলবে না। এ ক্ষেত্রে সরকার বিভিন্ন প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি কিংবা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকেও এ বিষয়ে কিছু সহযোগিতা করা যেতে পারে। কিন্তু বারবার প্রশাসনে শৃঙ্খলাভঙ্গের বিষয়টি মানুষের কাছে ভালো বার্তা পৌঁছায় না। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোও এ ক্ষেত্রে তাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। অর্থাৎ সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য আমাদের স্বচ্ছ, সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে এগোতে হবে।
দেশের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। স্বাধীনতার পর স্বচ্ছ নির্বাচন কটি হয়েছে, এমন প্রশ্নও ইতঃপূর্বে বহুবার উত্থাপিত হয়েছে। দেশের ইতিহাসে জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বললে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের কথা প্রথমে উত্থাপন করতে হয়। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনটিও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। আমরা দেখছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল বেশি। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করার পর বিগত তিনটি নির্বাচনে অনিয়ম-দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগ এসেছে। প্রশ্নবিদ্ধ এ নির্বাচনের ফলে দেশের মানুষ ভোট দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোও কোণঠাসা হয়ে পড়ে। নির্বাচনে প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তার ভূমিকা রাখার বিষয়টিও এসেছে আলোচনায়। মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা আমরা প্রথম পাই সেই ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের সময় থেকে। এমনটি আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থার জন্য পরে যে ক্ষত বয়ে এনেছে তা সংস্কার করতে গেলেও দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। কিন্তু এখন যেহেতু সময় এসেছে তাই সংস্কারের এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের রাজনৈতিক প্রভাববলয় দূর করার জন্য কাজও করতে হবে। বিষয়টি কোনো একটি কমিশনের বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করে সম্ভব নয়। এজন্য সমন্বয়ের প্রয়োজন। প্রশাসনে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে বা আগে ছিল তাদের প্রতিবিধান নিশ্চিত করতে হবে। তা ছাড়া এখন প্রশাসনের শূন্য এবং গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পূরণ করতে হবে। নিকট অতীতে এ স্তম্ভেই বলেছি, বেকারত্ব এখনও আমাদের দেশে একটি বড় সমস্যা। এমনকি চারটি বিসিএসের নিয়োগ এখনও সম্পন্ন হয়নি। প্রশাসনে দক্ষতা, মেরিট, যোগ্যতার ভিত্তিতে শূন্যপদগুলো পূরণ করতে হবে। দলীয় প্রভাবনীয় বিষয়গুলোর দিকে নজর রেখে তা দূর করার জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও নিয়মের ওপর নির্ভর করতে হবে। আর সবশেষে গড়তে হবে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। জনপ্রশাসন ভোটার ও নাগরিকের সুবিধা ও অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক বলয় যেন না থাকে এবং স্পয়েল সিস্টেম যেন আর আমাদের প্রশাসনকে স্থবির করতে না পারে সেজন্য কাজ করতে হবে। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ অবশ্যই। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারে বিজ্ঞ ও সুচিন্তিত অনেক ব্যক্তিই রয়েছেন। তাদের সমন্বয়ের মাধ্যমে আমরা জনপ্রশাসনের স্বচ্ছ ভিত্তিটুকু দেখতে পাব। রাজনৈতিক শক্তির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর আমরা তার ইতিবাচক ফল দেখতে পাব। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ , অনেক দায়। এ সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশাও অনেক বেশি। এ সব কিছু মনে রেখেই সরকারকে এগুতে হবে এবং স্বচ্ছ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে ফিরে যেতে হবে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সরকার ব্যাবস্থায়।