× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রাজনীতি

নাটক-মঞ্চ সেই একই, বদলেছে কুশীলব

মহিউদ্দিন খান মোহন

প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২৪ ১২:২৫ পিএম

নাটক-মঞ্চ সেই একই, বদলেছে কুশীলব

গোপাল ভাঁড় ও তার বন্ধু কোথাও যাচ্ছিল। পথে দেখতে পেল একটি গরুর লেজের গোড়ার দিক থেকে নেই। সেখানে দগদগে ঘা। একদল মাছি ওই ঘায়ের ওপর ভনভন করছে। তা দেখে গোপাল ভাঁড় বলল, ‘নেই তাই খাচ্ছো, থাকলে কী খেতে?’ বুঝতে না পেরে গোপালের বন্ধু বলল, ‘বন্ধু তোমার কথা বুঝলাম না।’ গোপাল বলল, ‘দেখো, যদি এ গরুটির লেজ অক্ষত থাকত, তাহলে ঘা হতে পারত না, আর মাছিরাও মচ্ছব লাগিয়ে খেতে পারত না। এখন লেজ নেই, তাই ঘায়ের ওপর বসে মজা করে রস খাচ্ছে।’ গোপাল ভাঁড়ের এ কথাটির তাৎপর্য বহুমুখী। সমাজ, রাষ্ট্র সবখানে এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। সাধারণত থাকলেই মানুষ খায়, না থাকলে না খেয়ে থাকে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ ‘না থাকা’ কতিপয় মানুষের খাওয়ার মওকা তৈরি করে দেয়। এ না থাকলে খাওয়ার দৃষ্টান্ত অনেক। অবশ্য তা এক পক্ষের জন্য। যখন থাকে এক পক্ষ খায়, আবার যখন থাকে না, অন্য পক্ষ খায়। চলতি বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার আগে গত পনের বছর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশে আর কোনো দলের ‘খাওয়া’ ছিল না। নামে মাত্র গণতন্ত্রের পুরোটাই ছিল সরকার তথা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কবজায়। তারা যেভাবে স্টিয়ারিং ঘোরাত, গণতন্ত্রের গাড়িটি সেভাবেই চলত। কারও কিছু বলার ছিল না।

এ তো গেল রাজনৈতিক বিষয়। সামাজিক নানা বিষয়েও এ খাওয়া-না খাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত প্রকট আকার ধারণ করেছিল। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাণিজ্য, গ্রেপ্তারবাণিজ্য দেশবাসীকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। মানুষ সেই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তির প্রহর গুনছিল। সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে ৫ আগস্ট। ছাত্র-জনতার রুদ্ররোষে শুধু গদিচ্যুতই নয়, দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। তার সাঙ্গোপাঙ্গরা কেউ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন, কেউ বা পালিয়ে চলে গেছেন অজ্ঞাতবাসে। আওয়ামী লীগের এ পরিণতি সবার জন্যই দৃষ্টান্ত। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল, এ পনের বছর আওয়ামী লীগ যা ঘটিয়েছে, তা পৃথিবীর স্বৈরশাসনের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম সন্দেহ নেই। সে সময় দেশে কার্যত কোনো আইন ছিল না। ক্ষমতাসীন দলটির এমপি-মন্ত্রী, নেতা-পাতিনেতাদের মুখের কথাই ছিল আইন। তারা যা হুকুম করতেন থানার ওসি, ইউএনও কিংবা ডিসিরা একান্ত বাধ্যগত ছাত্রের মতো তা পালন করতেন। ফলে ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে’ কথাটি পরিণত হয়েছিল ঠাট্টা-মশকরায়। অনেকেই তখন বলতেন, আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলে, তবে সে গতির নিয়ন্ত্রক আওয়ামী লীগ। ফলে ‘আইনের শাসন’ কথাটি পরিণত হয়েছিল অন্তঃসারশূন্য কথার কথায়। ঠিক তাদের পতনও হয়েছে নজিরবিহীনভাবে। একটি সরকারের প্রধানমন্ত্রী তার দলের নেতাদেরসহ প্রকাশ্য দিবালোকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন, এমন ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে খুব বেশি ঘটেনি।

৫ আগস্টের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পর সে নৈরাজ্যকরম পরিস্থিতির অবসান হওয়ায় জনমনে স্বস্তি এসেছিল এই ভেবে যে, আর কখনও ওই ধরনের পরিস্থিতির মুখদর্শন তাদের করতে হবে না। কিন্তু তাদের সে প্রত্যাশার বেলুন ইতোমধ্যে বায়ু নির্গত হয়ে চুপসে যেতে শুরু করেছে। দীর্ঘ সতের বছর ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করা দলটির কতিপয় নেতাকর্মীর কাজকর্ম-আচরণ তাদের কাছে অশনিসংকেত বলেই মনে হচ্ছে। পত্রিকায় কলাম লিখি, টেলিভিশন টকশোয় কথা বলি এবং একসময় দলটির কর্মী ছিলাম এ সুবাদে দেশের অনেকেই এ নাখান্দা বান্দার নাম-পরিচয় সম্পর্কে কিছুটা হলেও অবগত। কারও কারও কাছে আমার দূর আলাপন যন্ত্রটির নম্বরও রয়েছে। মাঝেমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকে ফোন করেন। যারা ফোন করেন, তারা সবাই আমার সাবেক রাজনৈতিক সহকর্মী। ফোন করে তারা তাদের হতাশার কথা, আক্ষেপের কথা শোনান। তাদের হ্যাঁ-না, এটা-সেটা বলে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি। আমার পুরোনো এক রাজনৈতিক সহকর্মী আশির দশকে উত্তরাঞ্চলের এক জেলার যুবদলের নেতা ছিলেন। মাঝেমধ্যেই ফোন করেন। সেদিন বললেন দোস্ত, আমাদের দলের কিছু নেতাকর্মী যেভাবে দখলবাণিজ্যে মেতে উঠেছেন, তাতে জনমনে তো নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে। এর প্রতিকারের উপায় কী? বললাম, দেখো, তোমাদের দলের শীর্ষনেতা এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন ইতোমধ্যে। শুধু জানাননি, তিনি তা কার্যকরও করেছেন। জানো তো, চাঁদাবাজি, দখল ইত্যাদি সন্ত্রাসকাণ্ডের অভিযোগে ৫ আগস্টের পর এ পর্যন্ত তোমাদের দলের বিভিন্ন পর্যায়ের সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার, পদাবনতি, সদস্যপদ স্থগিত ইত্যাদি শাস্তি দেওয়া হয়েছে? তিনি বললেন, সবই জানি। ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু রোগের তো উপশমের লক্ষণ নেই!

রাজধানীর নিকটবর্তী একটি উপজেলায় চলছে আরেক খেলা। ওই থানায় নতুন একজন ওসিকে বদলি করে এনেছেন একজন নেতা। তিনি অর্থাৎ প্রচার করে বেড়ান, অমুক ভাই আমাকে এ থানায় এনেছেন, তিনি আমার বড় ভাই, মুরুব্বি। শোনা যায়, সেখানে চলছে জমজমাট গ্রেপ্তারবাণিজ্য। বড় ভাইয়ের নির্দেশনা মোতাবেক ছোট ভাই গ্রেপ্তার করে আনেন। তারপর রফা হয়ে গেলে ছেড়ে দেওয়া হয়। যারা বড় ভাইয়ের চাহিদা পূরণ করতে না পারেন, তাদের করা হয় চালান। ঠিক এ ধরনের খেলাই আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগের পনের বছরে। বিএনপি নেতাকর্মীসহ নিরীহ মানুষকে বিনা কারণে গ্রেপ্তার করে হাতিয়ে নেওয়া হতো অর্থকড়ি। সেই একই নাটক, মঞ্চও একই। বদল হয়েছে কুশীলবের একাংশ। আওয়ামী লীগের বদলে দেখা যাচ্ছে বিএনপির মুখ। আর পুলিশ তো সব সময় ‘পিজিপি’, মানে ‘প্রেজেন্ট গভর্নমেন্ট পার্টি’র সদস্য। কখনও আওয়ামী লীগ, কখনও বিএনপি কিংবা কখনও জাতীয় পার্টি। এসব দেখে বিএনপির সমর্থক শুভানুধ্যায়ীরা হতাশ। দল ক্ষমতায় না আসতেই কতিপয় নেতাকর্মী যে চেহারা দেখাচ্ছেন, তাতে তারা শঙ্কিত। দল ক্ষমতায় গেলে এরা কী করবেন?

এখানেই গোপাল ভাঁড়ের গল্পটি প্রাসঙ্গিক। আজ আওয়ামী লীগ নেই বলে বিএনপির সামনে অবারিত সুযোগ। সে সুযোগের অপব্যবহার না করে তাদের উচিত দলকে সুসংগঠিত, জনসম্পৃক্ত ও জনপ্রিয় করার কাজে মনোযোগী হওয়া। যেসব অপকর্মের কারণে আওয়ামী লীগের আজকের পরিণতি, তা দেখেও যদি অন্যরা শিক্ষা না নেন, তাহলে সেই পুরোনো কথাটিই বলতে হয়, ‘ইতিহাসের শিক্ষা এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না।’ আমাদের দেশের রাজনীতিতে এটাই নির্মম বাস্তবতা।

  • সাংবাদিক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা