সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:২৪ এএম
৫ আগস্ট-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। আমাদের স্মরণে আছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডাকাতি ও নানা ধরনের অঘটন ঘটতে থাকে এবং সমাজবিরোধী চক্রের দৌরাত্ম্য বহুগুণ বেড়ে যায়। সেই পরিস্থিতি এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এলেও সামগ্রিকভাবে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটেছে এমনটি বলার অবকাশ নেই। ৬ নভেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর শীর্ষ প্রতিবেদনটি এরই সাক্ষ্যবহ। ‘ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্য রাজধানী, হটস্পট দেড়শ’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে তা স্বস্তির নয়। পুলিশ ও র্যাব সূত্র উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীতে ছিনতাই যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেকে বেড়ে গেছে। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর অনুসন্ধানে উঠে এসেছেÑ মহানগরীতে আতঙ্ক বাড়ে রাত নামলে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের ভীতিকর অভিজ্ঞতার পাশাপাশি ছিনতাইয়ের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর অনুসন্ধানে আরও যে তথ্য উঠে এসেছে এর প্রতিবিধান নিশ্চিত করার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল পক্ষগুলোরও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কেও জানা গেছে।
নিকট অতীতে এই
সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা বলেছিলাম, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে মানবাধিকারে আঘাত
লাগে। বিগত প্রায় চার মাসে দেশে এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে, যে ঘটনাগুলো মানবাধিকারের লঙ্ঘন।
আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, ছিনতাইকারী চক্রের পেছনের অদৃশ্য শক্তি নানাভাবে সক্রিয় থাকে
এবং তাদের কাছ থেকে সমাজবিরোধীরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটনে পৃথক শক্তি সঞ্চয় করে।
আমরা এও জানি, রাজধানী ঢাকায় সেনা, র্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযান চলছে এবং ঢাকার বাইরেও
অনেক ক্ষেত্রে যৌথ বাহিনীর শ্যেনদৃষ্টি রয়েছে। তার পরও জননিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে থাকার
রহস্য উদ্ঘাটনের বিষয়টি সংগত কারণেই গুরুত্বসহকারে সামনে এসেছে। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ঢাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়লেও মানুষ খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত
না হলে থানা পুলিশের শরণাপন্ন হতে চায় না। ফলে যে হারে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে, সে তুলনায়
মামলার সংখ্যা অনেক কম।
রাজধানীর অনেক
এলাকায়ই দিনে তো বটেই সন্ধ্যা নামলেই জনচলাচল কমে আসে। ভয় আর অনিশ্চয়তার মধ্যে চলাফেরা
করেন বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির প্রেক্ষাপটে প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদকের প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে ডিএমপি কমিশনার বলেছেন, ‘ছিনতাই প্রতিরোধে
পুলিশ আরও সক্রিয় হবে। শিগগিরই সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।’ র্যাবের মুখপাত্র
বলেছেন, ‘হটস্পটগুলো চিহ্নিত এবং অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ ‘আমরা যখন এই সম্পাদকীয়
লিখছি, তখন প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর অনলাইন সংস্করণে দেখেছি, ৬ নভেম্বর সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল
(অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘দেশে চাঁদাবাজি বেড়ে গেছে। এটা কঠোরভাবে দমন করা
হবে। চাঁদাবাজি বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। অপরাধী যে-ই হোক কেউ ছাড় পাবে না।’ আমরা
দায়িত্বশীলদের এ প্রত্যয়কে সাধুবাদ জানাই বটে, কিন্তু এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাইÑ
এ ব্যাপারে কালক্ষেপণের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।
ছিনতাইয়ের সঙ্গে
মাদকের একটি যোগসূত্র আছে এবং অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা বলতে পারি, মাদক কেনাবেচার সঙ্গে
ছিনতাইয়ের হার পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে আমরা মনে করি, বহুমাত্রিক সমাজবিরোধী
কর্মকাণ্ডের উৎসে দৃষ্টি দিয়ে মূল হোতাদের চিহ্নিত করা জরুরি। যেকোনো একটি কারণে আইনশৃঙ্খলা
পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে এর অন্যান্য অনুষঙ্গও সমান্তরালে বাড়তে থাকে। কোনো কোনো নিরাপত্তা
বিশ্লেষক বলেছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোও জোরালো ভূমিকা
রাখতে পারছে না বলেই সুযোগসন্ধানী অপরাধী চক্র এর ফায়দা লুটছে। আমাদের স্মরণে আছে,
গত সপ্তাহে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ রাস্তায় তো বটেই এমনকি
বাসাবাড়িতে পর্যন্ত গিয়ে চাঁদাবাজরা চাঁদা দাবি করছে। এই সত্যও অস্বীকার করা যাবে না
যে, প্রতিদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় জননিরাপত্তাহানিজনিত অনেক ঘটনা ঘটলেও সবই
সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে না।
আমরা মনে করি,
চিহ্নিত হটস্পটগুলোতে বাড়তি নজর দেওয়ার পাশাপাশি যেসব দণ্ডিত অপরাধী কয়েক দিন আগে মুক্তি
পেয়েছে তাদের দিকে সার্বক্ষণিক নজরদারি জরুরি। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই কিছুদিন আগে এ
আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছিলাম, দণ্ডপ্রাপ্ত যেসব সমাজবিরোধী মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে এসেছে তাদের
কারণে অপরাধজগৎ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। আমরা স্পষ্টতই মনে করি, সবার আগে জননিরাপত্তা।
অপরাধের হ্রাস টানতে, সমাজবিরোধীদের মূলোৎপাটনে, জননিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে এবং অপরাধজগৎ
ভেঙে দেওয়ার প্রত্যয়ে চলমান যৌথ অভিযান আরও জোরদার করা জরুরি। আমরা এও মনে করি, এলাকাভিত্তিক
সাঁড়াশি অভিযান ভিন্ন এবং ছিনতাইকারী চক্রের ‘গডফাদার’দের আইনের আওতায় না আনতে পারলে
পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সহজ হবে না। গত দুদিন আগে, সহযোগী একটি সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে
উঠে এসেছেÑ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সিসি ক্যামেরাগুলো ভাঙা থাকার কারণে অপরাধীকে দ্রুত
শনাক্ত করার ক্ষেত্রে কঠিন সমস্যায় পড়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো। কিন্তু
আমরা দেখছি, নষ্ট সিসি ক্যামেরাগুলো কার্যকরের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। বিভিন্ন
সূত্র বলছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট-পরবর্তী পুলিশি কার্যক্রম ভেঙে পড়ে এবং
পরে পর্যায়ক্রমে তা স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করলেও সর্বত্র এর কার্যকারিতা কাঙ্ক্ষিত
মাত্রায় এখনও দৃশ্যমান হয়নি। আমাদের অজানা নয়, যেকোনো রাষ্ট্রে জননিরাপত্তা নিশ্চিত
করার ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকাই অগ্রগণ্য। ইতোমধ্যে পুলিশ বাহিনীতে অনেক রদবদল করা হয়েছে
এবং সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ করছে গঠিত সংস্কার কমিশন। কিন্তু অন্তর্বর্তী সময়ে জননিরাপত্তা
নিশ্চিত করতে ছিনতাইসহ যেকোনো সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডের নিরসনে যৌথ বাহিনীর অভিযান আরও
জোরদার করার পাশাপাশি সংঘটিত ঘটনাগুলোর উৎস সন্ধানে নজরদারি গভীর করতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির
উন্নতি ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উদাসীনতার অবকাশ নেই। আইনশৃঙ্খলা
রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশের কাছে জনগণের দৈনন্দিন প্রয়োজনে রাত-বিরাতে যেতে হয়। এই প্রেক্ষাপটে
পুলিশকে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে যদি পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাহিনীকে সুসংগঠিত
ও আরও অধিকতর কর্মতৎপরতা বাড়ানোর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের
দায়। আমাদের বিশ্বাস, আইনের শাসন নিশ্চিত হলে এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সব পক্ষেরই
নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠা থাকে, তাহলে অনেক অস্থিরতা-অনিশ্চয়তা কেটে যাবে। এক্ষেত্রে
দায়িত্বশীলদের জবাবদিহির বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হবে। খুন-ছিনতাই-ডাকাতিসহ
গুরুতর অপরাধমূলক ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় জনমনে যে উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ দেখা দিয়েছে এর নিরসনে
সরকারকে বিন্দুমাত্র সময়ক্ষেপণ না করে যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাই,
স্বস্তি-নিরাপত্তা-শান্তি-শৃঙ্খলা।