সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:১৮ এএম
সুপেয় পানি জীবনযাপনের অন্যতম মূল অনুষঙ্গ। হালের বাস্তবতা হচ্ছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াসার ব্যর্থতার খতিয়ান অনেক দীর্ঘ। এর বাইরে নয় চট্টগ্রামের পরিস্থিতিও। ৫ নভেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ের পরও চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি উৎপাদন প্রকল্প অন্ধকারে। চট্টগ্রামে সুপেয় পানির সংকট দীর্ঘদিনের এবং এ নিয়ে গ্রাহকের অসন্তুষ্টির বিষয়টি ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে কম উঠে আসেনি। বিদ্যমান সংকট নিরসনে ২০১৬ সালে দৈনিক ১ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করতে ‘ভাণ্ডালজুড়ি পানি শোধনাগার’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় চট্টগ্রাম ওয়াসা। কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে রাঙ্গুনিয়া ও বোয়ালখালী উপজেলার মধ্যবর্তী পাহাড়ি জনপদ জ্যৈষ্ঠপুরায় ৪১ দশমিক ২৬ একর জমির ওপর এ প্রকল্প নির্ধারিত করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। বিস্ময়কর হলো, প্রকল্প অনুমোদনের পর পেরিয়ে গেছে নয় বছর, ব্যয় হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা; কিন্তু প্রকল্পটি এখনও দেখেনি আলোর মুখ!
এ প্রকল্পটি ২০১৬
সালের ৫ জানুয়ারি একনেকে অনুমোদন পেয়েছিল। শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা
এবং মেয়াদ ধরা হয় ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। বিস্ময়ের হলো, প্রকল্পটি অনুমোদনের
প্রায় তিন বছর পর ২০১৯ সালে শুরু হয় এর নির্মাণকাজ। নির্মাণকাজ চলমান অবস্থায়ই ২০২০
সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পটির মেয়াদ সংশোধন করে ব্যয়ও বাড়ানো হয়। সেই মেয়াদও পেরিয়ে
গেছে কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। ব্যয় বেড়েছে ৬০০ কোটি টাকার
বেশি। দক্ষিণ কোরিয়ার ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান তাইইয়ং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন
লিমিটেড প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে তাতে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি উৎপাদন প্রকল্পটির
ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখা গেলেও চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রকল্প পরিচালক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে
এ ব্যাপারে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে যা বলেছেন তা সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে আমরা
মনে করি।
যেখানে প্রকল্পের
কাজ এখনও অনিশ্চয়তার ছায়ায় ঢাকা, সেখানে চট্টগ্রাম ওয়াসা এ প্রকল্পের মাধ্যমে দ্রুত
৬ কোটি লিটার উৎপাদিত সুপেয় পানি চট্টগ্রামবাসীর কাছে কীভাবে সরবরাহ করবে তা আমাদের
বোধগম্য নয়। প্রকল্পটির গোড়ায়ই গলদ রয়েছে। চট্টগ্রামের সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন)
সভাপতি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানিয়েছেন, ‘প্রকল্পটির ফিজিবিলিটি স্টাডি ঠিকভাবে হয়নি।’
তার আরও বক্তব্য, ‘যথাযথভাবে প্রকল্প নেওয়া হলে
এটি সম্পন্ন হতে এত সময় লাগার কথা নয়।’ অন্যদিকে এ প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে
জানিয়েছেন, প্রকল্পটির অগ্রগতি অনেক। ইতোমধ্যে ৬ শতাধিক গ্রাহককে সংযোগ দেওয়া হয়েছে,
গ্রাহকসংখ্যা আরও বাড়বে এও তিনি জানিয়েছেন। আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, বছর বছর পানির দাম
বাড়ানো এক প্রকার অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে ওয়াসা। ২০০৯ সাল থেকে দফায় দফায় পানির দাম
বাড়ানোর এ ধারাবাহিকতা চলছে। কিন্তু সুপেয় পানির সংকট কোনোভাবেই কাটানো যাচ্ছে না।
পানির দাম বাড়ছে বটে কিন্তু সেবা বাড়ানোর কোনো প্রচেষ্টা না থাকায় গ্রাহকের ভোগান্তি
পৌঁছেছে চরমে। দাম বাড়ানোর পেছনে বরাবরই চট্টগ্রাম ওয়াসা উৎপাদন খরচের প্রসঙ্গটি সামনে
এনেছে। কিন্তু আমাদের প্রশ্নÑ গ্রাহক যথাযথ দাম দিয়েও কেন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সেবা পাবেন
না। ইতঃপূর্বে সংবাদমাধ্যমেই উঠে এসেছে, চট্টগ্রাম নগরের ৪০ শতাংশ এলাকায় পানির জন্য
হাহাকার রয়েছে। আবার কোথাও কোথাও সংযোগ থাকলেও পানি নেই, আবার কোথাও নেই সংযোগই। সমুদ্রঘেঁষা
অঞ্চল চট্টগ্রামের পানিতে লবণাক্ততার কারণে গ্রাহকের ভোগান্তির নেতিবাচকতার মাত্রা
জিইয়েই আছে। এর জন্য ওয়াসা কোনো সমাধানের পথে হাঁটছে, এমন কোনো সংবাদ আমাদের জানা নেই।
চট্টগ্রাম ওয়াসার
পানি উৎপাদন প্রকল্পের বিদ্যমান পরিস্থিতি এ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। দেশে প্রকল্প
প্রণয়ন-বাস্তবায়ন, এর সম্ভাব্যতা যাচাইসহ প্রকল্পসংক্রান্ত নানা বিষয়ে আমাদের অনেক
তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমরা জানি, গৃহীত অনেক প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়িত হয়ই
না, উপরন্তু দফায় দফায় মেয়াদ ও বরাদ্দ বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়ের প্রকল্পটি
যে পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে তা আরও বড় বেশি প্রশ্নবোধক চিহ্ন দাঁড় করায়। আমরা মনে করি, চট্টগ্রাম
ওয়াসার পানি উৎপাদন প্রকল্প এরই ধারাবাহিকতার খণ্ডিত চিত্র। নগরবাসী যথাযথ দাম দিয়েও
কেন বছরের পর বছর সুপেয় পানির সংকটে ভুগবে, এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় চট্টগ্রাম
ওয়াসা এড়াতে পারে না। আমরা জানি, গত মে-জুনে চট্টগ্রাম ওয়াসা চাহিদার নিরিখে সুপেয়
পানি সরবরাহ করতে পারেনি এবং এর ফলে তীব্র গরমে চট্টগ্রামবাসীর অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছিল
নাকাল। আমরা এর আগে এ সম্পাদকীয় স্তম্ভেই বলেছিলাম, পানির মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে
কোনো ধরনের অবহেলার অবকাশ নেই এবং চট্টগ্রাম নগরীতে পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এর
বিকল্প উৎস সন্ধান যেমন জরুরি, তেমন চট্টগ্রাম ওয়াসার কার্যক্রমের পরিসর বাড়ানোর পাশাপাশি
গতিশীল করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু আমরা দেখছি, জনগুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের
উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার-প্রতিশ্রতি ভিন্ন কার্যত সংকট নিরসনে শিরঃপীড়া নেই। মেয়াদ
এবং প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়েও চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে
না পারার বিষয়ে যে ব্যখ্যা দিয়েছে তা আমলযোগ্য নয় বলে আমরা মনে করি। প্রকল্প হাতে নেওয়ার
পর জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য বিষয়ে জটিলতা সৃষ্টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কারণ
প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইকালেই এসব বিষয়ের নিরসন হওয়া উচিত।
বিগত রাজনৈতিক
সরকারের আমলে চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি বছরের পর বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সময়সীমা বাড়িয়ে
নিজের আখের কীভাবে গুছিয়েছেন এর বহুমাত্রিক চিত্র প্রতিদিনের বাংলাদেশসহ সহযোগী সংবাদমাধ্যমে
কম উঠে আসেনি। তার এসব গর্হিত কাজের প্রতিবিধান না হওয়ায় চট্টগ্রাম নগরবাসীকে সুপেয়
পানি নিয়ে আরও বেশি সংকটে পড়তে হয়। সম্প্রতি পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম ওয়াসার
ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) অপসারণ করা হলেও তার আমলে যে অনিয়ম-দুর্নীতির খতিয়ান
বিস্তৃত হয়েছে এর প্রতিবিধান কী হবে, তা বলবে ভবিষ্যৎ। আমরা আশা করি, চট্টগ্রাম ওয়াসার
পানি উৎপাদন প্রকল্পে ব্যয় ও সময় ক্ষেপণের কারণ অনুসন্ধান করে যথাযথ প্রতিবিধান নিশ্চিত
এবং প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন করে নগরবাসীর দীর্ঘদিনের সুপেয় পানির সংকট নিরসনে মনোযোগ
গভীর করবে ওয়াসা।