ঐতিহ্য
মুহাম্মাদ রিয়াদ উদ্দিন
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:১২ এএম
মধ্যযুগে বাংলার শিল্প-সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান যে গুরুত্বপূর্ণ তা প্রতিষ্ঠায় সরদার ফজলুল করিম, আহমদ শরীফসহ অনেক সাহিত্যতাত্ত্বিকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মধ্যযুগ বাংলার মুসলমানদের জন্য একটা সোনালি যুগ। অনুবাদ, শিল্প, সাহিত্য থেকে সর্বত্র তারা তাদের জ্ঞান ও দক্ষতার নান্দনিক পরিচয় রাখে। মধ্যযুগে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি, মুদ্রা ও শিলালিপিতে আরবি-ফারসি প্রাধান্য লাভ করে। এ প্রসঙ্গে মধ্যযুগে মুদ্রা ও শিলালিপিতে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি নামক গ্রন্থে শাহনেওয়াজ এ কে বলেন, মধ্যযুগের বিশেষত সুলতানি বাংলায় মুদ্রা ও শিলালিপিসমূহের অধিকাংশই আরবি এবং ফারসি ভাষায় উৎকীর্ণ। লিপিগুলো খুদিত হয়েছে হস্তলিপি শিল্পের বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। কিন্তু ভিন্ন ভাষার হলেও বাংলার বিকাশে মধ্যযুগের লিপিকলার প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই।
মধ্যযুগে মুসলিম লিপিকলার বেশ বৈচিত্র্যময় রূপশৈলীর চিত্র
প্রত্যক্ষ হয়। যেগুলোতে পাওয়া যায় নন্দতত্ত্বের সব নানন্দিক ছোঁয়া। তার মাঝে
অন্যতম কিছু হলোÑ নাসখ,
কুফিক, রিকা, ছুলুছ, তাওকি, তালিক, মুহাক্কাক, নাস্তালিক, রায়হানি, দিওয়ানি, তুঘরা, সিকস্তা, গুরাব, গুলজার, তাওস, মাহি
ও আফতআবি
প্রভৃতি। এ ধরনের লিপিকলার প্রয়োগ হতো
মানুষের নিত্যব্যবহার্য তৈজসপত্রে, মসজিদ, মক্তব, দালানকোঠা, ধাতব
মুদ্রা তৈরিতে। এ ছাড়া পাণ্ডুলিপিতেও এর অসাধারণ সৌন্দর্যের ছোঁয়া দেখা যেত।
বিশিষ্ট গবেষক হাফিজ মাহবুবুর রহমান রচিত গবেষণাকর্ম মধ্যযুগে বাংলায় মুসলিম
লিপিকলা : সূচনা ও বিকাশ গ্রন্থে লিপিকলা প্রয়োগের অনুরূপ উপাদানগুলো পাওয়া যায়।
যেমনÑ টাঁকশাল,
মুদ্রা, পাণ্ডুলিপি, শিলালিপি প্রভৃতি।
সুলতানগণ মুদ্রাকে জনগণের সহজলভ্য করার জন্য টাঁকশালের বিকেন্দ্রীকরণ নীতির ওপর
গুরুত্বারোপ করেছেন। মধ্যযুগে বাংলার মুসলিম শিল্পকলার বিকাশে প্রায় ২৮টি টাঁকশালের
গুরুত্বও অতুলনীয়।
মধ্যযুগের মুসলিম লিপিকলার বিকাশ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, মুসলিম
লিপিকাররা ৭০টিরও অধিক লিপিশৈলীর উদ্ভাবন করেন। যদিও
এ কথাটি নিয়ে মতানৈক্য বিদ্যমান। কেননা, মুহাক্কাক, রিকা, তাওকি, কুফিক, নাসখ, ছুলুছ, তুঘরা, নাস্তালিক, রায়হানি প্রভৃতি লিপিশৈলী মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র প্রচলিত ছিল।
তবে বাংলায় মুসলিম লিপিকাররা কিছুটা
ব্যতিক্রম হয়ে ওঠেন। এ প্রসঙ্গে লিপিকলা গবেষক ইয়াকুব আলী তার
মুসলিম মুদ্রা ও হস্তলিখন শিল্প গ্রন্থে অনুরূপ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, লিপিশিল্পীগণ
তাদের সুকুমার বৃত্তির স্বাক্ষর রেখেছেন স্বর্ণ, রৌপ্য, ব্রোঞ্জ
ও পিতলে নির্মিত আহারপাত্রে, প্রদীপ, ফুলদানি, দোয়াত, ঝুড়ি, যুদ্ধের
হেলমেট অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদির অবয়বের অলংকরণে হস্তলিখন শিল্পকে ব্যবহার করেছেন; যা
বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। অর্থাৎ মধ্যযুগের
লিপিশিল্পের বিকাশ বিশ্বদরবারেও ছড়িয়ে পড়ে। তবে মধ্যযুগে বাংলার মুসলিম শিল্পকলার
প্রধান চর্চা হতো মুদ্রা,
মাদ্রাসা, মসজিদ, খানকা, দরবার, ঈদগাহ, ফটক, সেতু
নির্মাণের কাজে। বিশেষ করে মধ্যযুগে বাংলায় মুসলিম শিল্পকলার বিকাশে মুদ্রা খুবই
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিনিময়যোগ্য মুদ্রা বিশ্বদরবাবে শিল্পকলার বিকাশকে
ত্বরান্বিত করে।
মধ্যযুগে বাংলার মুসলিম শাসনকালে লিপিশিল্পীদের মর্যাদা ছিল
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত। রাষ্ট্রের তরফ থেকে তাদের অনবদ্য শিল্পকর্মের জন্য নানাবিধ
উপাধি ও সম্মানী দেওয়া হতো। এমনকি রাজদরবারেও তাদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। তারা
রাজানুগ্রহ পেয়ে শিল্পচর্চায় আরও গভীর মনোনিবেশ করত। তাদের এ মর্যাদার বিষয়ে
লিপিশিল্প গবেষক ইয়াকুব আলী বলেন, হুসাইন কাশ্মীরিকে জররী কলম, আব্দুর
রহীমকে আম্বারীন কলম,
মীর খলিলুল্লাহ শাহকে বাদশাহ কলম... ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত
হন। আধুনিক সময়ে আমাদের এই শিল্পকলার অংশটি সম্পর্কে প্রজন্ম সচেতন
নয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে এই শিল্পগুলোকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে জড়িয়ে ফেলা হয়। এমনটি
মোটেও কাম্য নয়। বরং শিল্পকলা মানুষকে নন্দনের ছোঁয়া।
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়