× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আইনশৃঙ্খলা

জননিরাপত্তায় নজর বাড়ান

ড. মো. নুরুল ইসলাম

প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:১৩ এএম

ড. মো. নুরুল ইসলাম

ড. মো. নুরুল ইসলাম

রাজধানীসহ সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে জনমনে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অন্যদিকে জননিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্ক মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। ১ নভেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে চলছে সেনা-র‌্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযান। কিন্তু এরপরও থেমে নেই দুষ্কৃতকারীদের দৌরাত্ম্য।’ চলছে খুন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, হামলা, দখল, ধর্ষণসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। শুধু অক্টোবরেই সারা দেশে অন্তত ৯০ জন খুনের শিকার হয়েছে। একজন সমাজতত্ত্ববিদ হিসেবে বিষয়টিকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে হবে। এই পটপরিবর্তনকে ইতিবাচক-নেতিবাচক যে দৃষ্টিতেই দেখা হোক না কেন, একটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। এই পটপরিবর্তনের ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্ম একধরনের বাহন হিসেবে কাজ করেছে। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে সরকার বদল হয়েছে। আর এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্থিতিশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু এর বিপরীতে দেশের মানুষ বেশি স্বাধীন হয়ে গেছে। স্বাধীন বলতে প্রচলিত আইনকানুনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিজেদের মাধ্যমেই পরিবর্তন আনার বিষয়টিকে বোঝানো হচ্ছে। সমাজে মানুষের মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত কিছু আচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। বিষয়টি শুধু একমাত্রিক নয়, এর প্রভাব বহুমাত্রিক।

আমরা দেখছি, গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে মব জাস্টিস বেড়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর তাদের আস্থা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসায় অনেকে নিজ হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। অনেকে অপরাধীর শাস্তি দেওয়ার দায় নিজ হাতে তুলে নিচ্ছে। এটি অরাজকতার লক্ষণ। আবার দেশের বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই, হত্যা, খুন, অপহরণও বেড়েছে। এর অন্যতম একটি কারণ মূল্যস্ফীতি। দেশের অর্থনীতি এখন অনেকটা ধুঁকছে। অর্থনীতিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়া, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি না হওয়া এবং দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে না পারার নেতিবাচক প্রভাব সমাজে নানা-শ্রেণির মানুষের ওপর পড়ে। এই নেতিবাচকতার ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ে। দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে বাঁচার জন্য তারা চুরি বা সংঘবদ্ধ হয়ে ছিনতাই করার চেষ্টা করে। তাদের উদ্দেশ্য থাকে কিছু অর্থ পাওয়া। আবার এই মানুষদের অনেক সময় সমাজের সুযোগসন্ধানী অনেকেই ব্যবহার করে। এভাবে আস্তে আস্তে অপরাধের একটি শৃঙ্খল তৈরি হয়।

করোনা মহামারিকালের পর অনেকেই চাকরি হারিয়েছে। এরপর দেশের গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই অবনত হয়েছে। এমন সময়ে অর্থনীতির সঙ্গে সমাজের যাপিত জীবনের স্বাভাবিকতার বিরোধ দেখা গেছে। এমনকি পটপরিবর্তনের সময়েও যেহেতু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে অর্থনৈতিক অনেক প্রতিষ্ঠানই কার্যকর অবস্থায় নেই, সেহেতু বেকারত্বের সঠিক চিত্রও আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু এটুকু বোঝা যাচ্ছে, শহর ও গ্রামীণ এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষরা কোণঠাসা হয়েই নানা অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি দুই ধরনের প্রবণতা। কেউ কেউ সুযোগ সন্ধান করছে আর কেউ আসলে সুযোগের ব্যবহার করছে। দীর্ঘদিন যারা রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে ছিল, তারা এখন প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পাচ্ছে। নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্যকে বিস্তারের জন্য অনেকেই বিভিন্ন স্থানে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত গোষ্ঠীদের সঙ্গে আঁতাত করছে। আর এই আঁতাতের ফলে অপরাধীরাও সুযোগ পাচ্ছে। আবার যেহেতু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনও সম্পূর্ণভাবে স্থিতিশীল অবস্থায় ফেরেনি, তাই অনেকে অপরাধের সুযোগ নিচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা সরলভাবে অপরাধীদের শনাক্ত করতে পারব না।

বর্তমানে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে বিদ্যমান প্রশাসনিক ব্যবস্থারও ব্যর্থতার দায় রয়েছে। আমরা দেখছি, আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থার অনেক সদস্যের মধ্যে একধরনের হীনমন্যতা কাজ করছে। মানসিকভাবে তারা কিছুটা দুর্বল হয়ে থাকায় অনেকেই এর সুযোগ নিচ্ছে। বিশেষত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আইন প্রয়োগ করার ক্ষেত্রেও নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষত পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে তাদের নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হচ্ছে। প্রতিদিনের বাংলাদেশের ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, অনেক পুলিশ তার টহল দেওয়া এলাকা সম্পর্কে জানে না। যেহেতু তারা তা পুরোপুরি জানে না তাই তাদের এলাকায় টহল দেওয়া এবং দ্রুত অপরাধীদের শনাক্ত করতে অসুবিধা হচ্ছে। এ সমস্যাগুলোকে ভাবনায় রেখে আসলে একটি সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে।

একটানা প্রায় ১৬ বছর একটি দলের নেতৃত্বে জোট সরকার ক্ষমতায় ছিল। সেই সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সুশীল সমাজ ও তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি মিশ্র সরকারব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এখন পর্যন্ত তারা ইতিবাচক কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সংস্কারের লক্ষ্যে কাজও করছে। কিন্তু সামাজিক বিশৃঙ্খলা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কাজের সামনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ইতিবাচক কাজকে সমর্থন দেওয়ার জন্য সমাজ সচেতনতার বিকল্প নেই। সমস্যা হলো, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই আইন সচেতন, পরিশীলিত ও সমাজকল্যাণমুখী নয়। বিশেষত আইনের ক্ষেত্রে অনেকেই সচেতন নয়। দেশের শিক্ষিত মানুষের কাছেও প্রচলিত আইন সম্পর্কে ধারণা নেই। তাই তারা অনেক সময় অজ্ঞাতবশত অনেক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় এবং তা সমাজে বিচ্ছিন্ন কিছু অপরাধের জন্ম দেয়। উন্নত অনেক বিশ্বেই একজন নাগরিকের জন্য প্রয়োজনীয় আইনের পকেটবুক সংস্করণ থাকে। যাপিত জীবনে কোন কোন ক্ষেত্রে তারা আইন লঙ্ঘন করতে পারে কিংবা তার ওপর অন্যায় হলে কীভাবে ন্যায়বিচার পাবে তা এসব পকেটবুকে লেখা থাকে।

আমাদের দেশে এমন কিছু থাকলেও মানুষের জানার আগ্রহ নেই।সমাজে আইনের সুশাসনের একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন মোড়ে ট্রাফিক লাইট প্রযুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মানুষ এই অটোমেটেড ব্যবস্থা দেখেই সড়কে চলাচল করে। একটি সুষ্ঠু কাঠামো থাকায় মানুষ আইন মেনে চলে। সড়কে কোনো যান যদি আইনভঙ্গ করে তাহলেও ব্যবস্থা রয়েছে। ট্রাফিক পুলিশ দ্রুতই গাড়ির নম্বর দেখে গাড়ির চালককে চিহ্নিত করে ফেলে। তারা কিন্তু গাড়িটিকে আটকায় না। বরং ওই গাড়ির নম্বর থেকে গাড়ির মালিকের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে ফেলে। তারপর যখন ওই ব্যক্তি তার বাড়িতে ফিরে যায় জানতে পারে তাকে শাস্তি বা জরিমানা দেওয়া হয়েছে।

অর্থাৎ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার প্রশাসনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি মানুষের মধ্যে আইন মেনে চলার সদিচ্ছা থাকতে হবে। কারণ মানুষ যখন জানবে কোন কোন ক্ষেত্রে সে আইনভঙ্গ করছে, তখন তার মধ্যে সচেতনতা তৈরি হবে। আমাদের দেশে এই সচেতনতা তৈরি করা কঠিন। কারণ আমরা আমাদের আইনশৃঙ্খলা কাঠামোর আধুনিকায়ন করতে পারিনি। অন্যদিকে মানুষকেও আইন সচেতন করতে পারিনি। এর ফলে মব জাস্টিসের মতো ঘৃণ্য অপরাধ দেখা গেছে। এমনকি সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, অনেক জায়গায় চোর সন্দেহে পেটানো হচ্ছে আবার চোর ধরা পড়লে তাকে অমানবিক শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এগুলোও কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার নয়। নিজ হাতে আইন তুলে না নিয়ে অভিযুক্তকে বিচারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সোপর্দ করাই হবে উচিত কাজ। কিন্তু যেমনটি বলেছি, মানুষ যেন একটু বেশি স্বাধীন হয়ে গেছেÑ এমন ভাবনা কাজ করায় অনেকে আইন নিজ হাতে তুলে নিচ্ছে। আইনকে শ্রদ্ধা করার উপলব্ধি সমাজের মানুষের মধ্যে কম।

একটি রাজনৈতিক দল ও তাদের সমমনা কয়েকটি দল মিলে জোট সরকার গঠন করে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সময় দলীয় কর্মীদের অনেকে নিয়মে বা অনিয়মে স্বার্থোদ্ধারে ব্যস্ত ছিল। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালী অনেককে রাজনৈতিক শক্তির অনুপস্থিতিতে কিছু সুযোগসন্ধানী ব্ল্যাকমেইল করছে। তারা আশ্বাস দিচ্ছে, অর্থের বিনিময়ে তারা ওই ব্যক্তিকে নিরাপত্তা দেবে। অথচ বাস্তবে এমন নিরাপত্তা দেওয়ার এখতিয়ার তাদের নেই। কিন্তু যেহেতু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সক্রিয় নেই, তাই বিভিন্ন এলাকায় এখনও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও পেশির ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে দলীয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য মনোযোগী হতে হবে। কারণ সুবিধাপ্রাপ্তির প্রবণতার মধ্যেও যে পরিবর্তন দেখা গেছে তা মোটেও ইতিবাচক হতে পারে না। তারা যদি দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তুলতে না পারে, তাহলে অপরাধ যেমন বাড়বে তেমনি সংঘাত-সহিংসতা বাড়ার শঙ্কাও বাড়বে। এ-ও সত্য, আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সচরাচর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সামাল দিতেই বেশি সময় ব্যয় করে। আর জনসংখ্যাবহুল এই দেশে সবাইকে সমান নিরাপত্তা দেওয়াও কঠিন। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে না পারলে আমরা ইতিবাচক পরিবর্তন দেখব না।

দেশে এখনও রাজনৈতিক দলগুলো শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। অন্যদিকে অস্থিতিশীলতা বাড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলো নানা মতপার্থক্যে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। এই সংকট সমাধানের জন্য একটি স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে রাজনৈতিক শক্তির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে সে যাত্রা শুরু করেছে। কিন্তু নির্বাচন যেন কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ না হয় এবং কোনো অপতৎপর শক্তি যেন সুযোগ নিতে না পারে সেভাবে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। রাজনৈতিক শক্তির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে সমাজে স্থিতিশীলতা কিছুটা হলেও ফিরবেÑএই অভিমত অনেকের। তবে রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে সমাজকল্যাণের সদিচ্ছা পোষণ করতে হবে। তারা যেন তাদের দায়িত্ব ভুলে না যায় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে।

  • অধ্যাপক, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা