× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের পথ সুগম হোক

মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম

প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:০৯ এএম

আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের পথ সুগম হোক

পহেলা নভেম্বর ছিল বিচার বিভাগ পৃথককরণ দিবস। সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রায় অনুসারে ২০০৭ সালের এই দিনে বাংলাদেশে শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা করা হয়। বিচার বিভাগ পৃথককরণের লক্ষ্য পূরণে রায়ে সুপ্রিম কোর্ট ১২ দফা নির্দেশনা দিলেও তা আজও সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হয়নি। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিচার বিভাগ পৃথককরণের মূল দফা ‘স্বতন্ত্র সচিবালয়’ প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলছে।

দেশ ও জাতিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সরকারের তিনটি অঙ্গÑ শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হয়। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্র তা-ই করে। আইনের ব্যাখ্যাদান ও বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বিচারকদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতাকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বোঝায়। তবে বিচারকদের এ ধরনের স্বাধীনতার অর্থ কোনোভাবে তাদের অবাধ কিংবা যা খুশি তা-ই করার ক্ষমতা বোঝায় না।

বিচারকের সঙ্গে ন্যায়বিচারের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। জ্যাকবীয় যুগের (১৫৯৭) শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও আইনজীবী ফ্রান্সিস বেকন বলেছিলেন, ‘আদালতে প্রতিটি অভিযোগ কোনো না কোনো ব্যক্তির অধিকারের প্রশ্ন সম্পৃক্ত। ন্যায়বিচারের প্রশ্নে বিচার প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগত অনুরাগ যদি বিচারককে অপরাধীর পক্ষ নিতে প্ররোচিত করে, তবে তার উচিত সুনির্দিষ্ট রায় না দিয়ে বিষয়টিতে সমঝোতার মাধ্যমে ফয়সালার পদক্ষেপ নেওয়া।’ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য বিচারকদের আপসহীন ও বিবেকবান হতে বলে ফ্রান্সিস বেকন বলেছিলেন, ‘বিচারকদের হতে হবে সিংহের মতো। সিংহাসনের ছত্রছায়া তাদের ওপর থাকবে, কিন্তু বিচারককে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হতে হবে অবিচল।’

আমাদের সংবিধান সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধানবিরোধী বিধিবিধান অবৈধ ও বিধিবহির্ভূত ঘোষণার ক্ষমতা দিয়েছে। সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনগণের অভিপ্রায়ে পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধান বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছে। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের অনুচ্ছেদ ২২-এ নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথককরণের বিধান সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’

সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার অংশের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ সংবিধান প্রবর্তন থেকে সে সকল আইন ততখানি বাতিল হবে।’ অর্থাৎ সংবিধান আমাদের বিচার বিভাগকে স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

বিচারকদের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে বিচারকর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ ও ম্যাজিস্ট্রেট বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন। অর্থাৎ সংবিধানের বিধান মতে বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাদের নিয়োগের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘বিচার বিভাগীয় পদে বা বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উক্ত উদ্দেশ্যে প্রণীত বিধিসমূহ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করিবেন।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, যদি কোনো রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তবে বিচারকার্যে নানা রকমের জটিলতার সৃষ্টি ও ন্যায়বিচার প্রলম্বিত হয়।

বিচার বিভাগ স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে ২০০৭-২০০৮ সালে বেশ কিছু আইন সংশোধন ও নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়, যেখানে ১৯৭২ সালের সংবিধানে উল্লিখিত বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতিফলন ঘটে। যেমন, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা ২০০৭, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস পে স্কেল ইত্যাদি। এ ছাড়া অধস্তন আদালতগুলোর শৃঙ্খলা বিধানসহ একটি আলাদা ও স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। সবচেয়ে যুগান্তকারী সংশোধনী আনা হয় ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এ। এই আইনের ০৬ ধারায় দুই ধরনের ম্যাজিস্ট্রেটের পদ সৃষ্টি করা হয়। একপক্ষে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যপক্ষে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭-১৪৮ ধারা, ১৭৬ ধারাসহ আরও কিছু ধারা যেমন ২৯(বি) ধারায় কার্যক্রম পরিচালনা ও দণ্ড প্রদানের ক্ষমতাসহ মোবাইল কোর্ট ২০০৯-এর অধীনে বাংলাদেশে প্রচলিত ১১৯টি (২০১৯ পর্যন্ত) আইনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। বিচার বিভাগের হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা মূলত বিচার বিভাগ পৃথককরণ নীতিরই বাস্তবায়ন। জনগণ ইতোমধ্যে বিচার বিভাগ পৃথককরণের সুফল পাচ্ছে। এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মামলা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসিতে নিষ্পত্তি হয়েছে এবং হচ্ছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে।

বিচার বিভাগের কাছে ন্যায়বিচার পাওয়া যেসব উদ্যোগ ও অনুষঙ্গের ওপর নির্ভর করে, তার মধ্যে অন্যতম বিচারকদের সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত মানসিকতা। তারা যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংকল্পে শক্ত অবস্থান নেন, তবে বিচার বিভাগ পৃথককরণের সুফল মিলবে। বর্তমান ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণ এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন। বিচার বিভাগ যাতে সামগ্রিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বদা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে সে ব্যাপারে সরকার সার্বিক সহযোগিতা এবং বিচার প্রশাসনে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বদ্ধপরিকর। ছাত্র এবং জনগণও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে বিচার বিভাগের পৃথককরণ নীতি এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে বাস্তবায়ন হবে। সুতরাং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে সরকার, রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের এক মঞ্চে আসা দরকার। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে। অন্তর্বর্তী সরকার ৩ অক্টোবর বিচার বিভাগ সংস্কার এবং এর স্বাধীনতা নিশ্চিতে পৃথক কমিশন গঠন করেছে। উচ্চ আদালতের মাসদার হোসেন ও অন্যান্য রায়ের আলোকে বিচার বিভাগের অধীনে পৃথক সচিবালয় গঠনের জন্য ইতোমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়কেও চিঠি দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। বিচার বিভাগের অধীনে কয়েক মাসের মধ্যে পৃথক সচিবালয় গঠন হবে বলে আশা রাখি।

বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার জরুরি। অভিযোগ রয়েছে, বিগত সময়ে রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে সরকারের ইচ্ছা অনুসারেই রায় বা আদেশ হয়েছে, বিচার বিভাগ সম্পর্কে এমন নেতিবাচক ধারণা থেকেও বিচার বিভাগকে মুক্ত করতে হবে। বিচার বিভাগের যেকোনো পর্যায়ের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে সংস্কার কমিশনকে উদ্যোগী হতে হবে। এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে নীতিমালা প্রণয়ন ও কমিশন গঠন, বিচার বিভাগের অধীনে নিজস্ব সচিবালয় গঠন, মামলা ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং স্বচ্ছতাও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

  • পিএইচডি গবেষক, আইন বিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা