আমদানি পণ্যে শুল্কছাড়
মোস্তফা হোসেইন
প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৩১ এএম
মোস্তফা হোসেইন
আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি মানুষের ক্ষোভের অন্যতম একটি কারণ, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির টানা অভিঘাত। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ছিল সাধারণ মানুষের ক্রয়সাধ্যের বাইরে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর সরকার বিষয়টি গুরুত্বসহ বিবেচনা করে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম ১৫ দিন বাজারে অকল্পনীয় স্থিতাবস্থা চলে আসে। যদিও সরকার তখনও বাজার নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ পায়নি। কিন্তু দিন পনেরো গত হওয়ার পর নিত্যপণ্য আবারও ক্রয়ক্ষমতা বা সাধ্যের বাইরে যেতে থাকে। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর পর এমন কী হয়েছিল যে নিত্যপণ্যের মূল্য হঠাৎ কমে গেল? এ পরিস্থিতি বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে। আসলে আওয়ামী লীগের পতনের পর উৎপাদনকারী ও খুচরা বিক্রেতাদের মাঝখানে যে ধাপগুলো আছে সেখানে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। এ ধাপগুলোই সিন্ডিকেটের অংশ হিসেবে গণ্য যাদের কারণে, ক্রেতা পর্যায়ে দুর্ভোগ নেমে আসে। আবার সেই সিন্ডিকেট কিংবা মধ্যস্বত্বভোগীরা যেই মুহূর্তে জায়গা দখল করে নেয়, সে মুহূর্তেই বাজার আকাশমুখী হতে শুরু করে।
এ
মুহূর্তে মধ্যস্বত্বভোগীদের চেহারা হয়তো পরিবর্তন হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তারা
পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে একবারে অবিকৃতভাবে। এ দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষার
জন্য সরকার দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ অবস্থায় তারা দোকানিদের অভিযোগ আমলে নেয়।
খুচরা দোকানিরা অভিযোগ করে থাকেন বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তারা যেন কম মূল্যে
পণ্য কিনতে পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে কম মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে পারেন।
যুক্তি হিসেবে এটা অগ্রহণযোগ্য এমনটা বলা চলে না। জনস্বার্থ চিন্তা করে সরকার
সম্প্রতি ছয়টি পণ্যের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক ছাড় দেয়। উদ্দেশ্য, ভোক্তা পর্যায়ে
যাতে পণ্যগুলো সহজলভ্য হয়, সেগুলো যাতে ক্রেতারা স্বল্পমূল্যে কিনতে পারেন।
বাস্তবতা হচ্ছে, সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়নি। যে কারণে আমদানিকৃত পণ্যের মতো
দেশি শাকসবজির মূল্যও অনাকাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে রয়ে গেছে। অর্থনীতির চিরন্তন সত্যÑ চাহিদার
তুলনায় সরবরাহ কম হলে মূল্য বাড়ে। এ সত্যটি অকার্যকর হয়ে পড়ে বাজারে। সরবরাহ
স্থিতিশীল রাখতে চালে শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় এনবিআর।
শীতের
শুরুতেই যেসব সবজি বাজারে আসার কথা সেগুলোর সরবরাহে ঘাটতি নেই। অনেকেই মজুদ
পরিস্থিতির দিকে না তাকিয়ে বলে থাকেন, সেপ্টেম্বরে পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার কারণে
সবজি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে মূল্যে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বন্যা
চলাকালে বাজারে সবজির মূল্য স্থিতিশীল ছিল। অন্যদিকে ঢাকাসহ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোয়
পূর্বাঞ্চলে উৎপাদিত সবজি আসে কম। বরং এসব এলাকায় বাইরে থেকে সবজি সরবরাহ হয়ে
থাকে। যে কারণে বন্যাকে সবজি ও কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা
কতটা যৌক্তিক তা ভেবে দেখা দরকার মনে করি। সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা বাজার
নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে অভিযান চালালে কিংবা সংবাদমাধ্যম ক্যামেরা নিয়ে বাজারে গেলে
পণ্যের মূল্য কমে যায়। অভিযান শেষ হলে কিংবা ক্যামেরা সরে গেলে সেই একই অবস্থায়
ফিরে আসে। সেই চিরন্তন জবাব পাওয়া যায় খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে। তারা বেশি দামে
কিনে কম দামে বিক্রি করতে পারবেন না।
নিকট
অতীতে ডিমের দাম নিয়ে হইচই শুরু হলে সরকার ভারত থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডিম
আমদানির উদ্যোগ নেয়। এর ফলে, ডিমের ডজন ১৬০ টাকায় নেমে আসে। কিন্তু দুই দিন না
যেতেই আবার ১৭০ টাকায় পৌঁছায়। বিক্রেতাদের কথাÑ আড়ত দাম বাড়ালে তাদের কী করার আছে।
সত্য হচ্ছে, ডিমের যে পরিমাণ চাহিদা সে অনুযায়ী সরবরাহ না হওয়ায় ডিমের দাম তখন
কমেনি। এ ডিম নিয়ে ডিম ছোড়াছুড়ি কম হয়নি। ভোক্তাদের চিৎকার করা ছাড়া তেমন কিছু
করার নেই। মধ্যস্বত্বভোগীদের আগ্রাসী মানসিকতা পাশ কাটানো সম্ভব হচ্ছে না। মধ্যস্বত্বভোগীদের
ওপর সব সময়ই দায় চাপানো হয়, যার সত্যতাও আছে। কিন্তু কিছু পণ্য মধ্যস্বত্বভোগীদের
বাইরে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর আধিপত্যও বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে। বাজার
নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার ছয়টি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে আমদানি শুল্ক ছাড় দিয়েছে।
উদ্দেশ্য, বাজারে মূল্যবৃদ্ধি না ঘটানো। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, সাময়িকভাবে
ডিমের দাম সামান্য কমলেও বাকি পাঁচটির মূল্য কমেনি বরং বেড়েছে। এতে রাষ্ট্র যেমন
রাজস্ব হারাচ্ছে, পাশাপাশি ভোক্তারও কোনো উপকারে আসেনি। টিসিবির হিসাব অনুযায়ী এক
মাস আগে পেঁয়াজ ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হতো। শুল্কছাড়ের পরও সে পেঁয়াজ এখন ১৩০ টাকা
পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। সর্বশেষ এ পেঁয়াজ ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে,
ক্ষেত্রভেদে তা ১৬০ টাকায়ও বিক্রি হতে শোনা গেছে। এর কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
ভোজ্যতেল
আমদানির কথাও তেমন বলা যায়। শুল্কছাড়ের কোনো সুফল ভোক্তা পর্যায়ে নেই। শুল্কছাড়ের
পর সরকার থেকে বলা হয়েছিল, প্রতি কেজি চিনির দাম ১১ টাকা কমবে। অথচ চিনির দাম কমার
পরিবর্তে বেড়ে গেছে কেজিপ্রতি ৫-৭ টাকা পর্যন্ত। এখন বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩০
টাকায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ৫৮ জনের পরিদর্শক দল বাজারে বাজারে ঘুরছে। নজরদারি
করছে। কিন্তু আমদানিকৃত পণ্যগুলো নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে আমদানিকারকদের ব্যাপারে
কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। তারা যদি ন্যায্যমূল্যে পণ্য
বাজারে সরবরাহ করতে পারতো তাহলে এর ভোক্তাদের নাকাল হতে হতো না। সুতরাং বাজার
নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রযোজ্য স্থানগুলোয় নজরদারি বাড়াতে হবে। টিসিবির
মাধ্যমে খোলাবাজারে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তবে এ
ব্যাপারে ঢাকায় স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছু ভুলভ্রান্তি আছে। সাধারণত নিম্নমধ্যবিত্তদের
বসতিপূর্ণ জায়গাগুলোয় পণ্য বিক্রির ট্রাকগুলো থাকার কথা বেশি। কিন্তু সেখানে
ব্যত্যয় ঘটতে দেখা গেছে।
দ্রব্যমূল্য
নিয়ন্ত্রণে বড় পরিবর্তন প্রয়োজন উৎপাদনকারী ও ভোক্তার মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার।
অর্থাৎ উৎপাদনকারী কৃষকের কাছ থেকে যদি সরাসরি বাজারে পণ্য আনার সুবিধা করা যায়
তাহলে কৃষক এবং ভোক্তা উভয়েরই স্বার্থ রক্ষা হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে কৃষকও
বঞ্চিত। ঢাকায় যে চিচিঙ্গার কেজি ৭০-৮০ টাকা, সেই চিচিঙ্গা উৎপাদনকারীকে বিক্রি
করতে হয় ৩০ টাকায়। এটা অস্বাভাবিক অবস্থা। এর জন্য সরকারি কৃষি বিপণন সংস্থাকে
এগিয়ে আসতে হবে। অথচ কৃষি বিপণন বিভাগের প্রতি কোনো নজরই দেওয়া হয় না। কোনো কোনো
জেলায় সংশ্লিষ্ট বিভাগে একজন কিংবা দুজন কর্মচারী থাকার কথাও জানা যায়। তারা অফিসে
বসে থাকার বাইরে কিছু করতে পারেন না। কৃষিপণ্য ছাড়াও যেসব নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য
আছে সেগুলোও তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পৌঁছে দেওয়া এবং ন্যায্যমূল্যে বিক্রির
বর্তমান ব্যবস্থাপনা বদলে দিতে হবে। মনে থাকার কথা, মুক্তিযুদ্ধের পর
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক অভাব দেখা দেয়। তখন সরকারিভাবে ন্যায্যমূল্যের
দোকান পরিচালনা করা শুরু হয়। নো লস নো প্রফিট ভিত্তিতে আবার সেই উদ্যোগ গ্রহণ করা
যায় কি না রাষ্ট্রচিন্তকদের ভেবে দেখা দরকার। এটা যদি সম্ভব না-ও হয় অন্তত টিসিবির
সক্ষমতা বাড়াতে তাদের বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। তাদের বর্তমান বিপণনব্যবস্থাও
সম্প্রসারিত করা দরকার। যেখানেই অন্যায্য মূল্যবৃদ্ধি হবে, সেখানেই টিসিবি যাতে
দ্রুত সময়ের মধ্যে চলে যেতে পারে এই ব্যবস্থা করা দরকার। কনজুমার সাপ্লাই করপোরেশন
বা কসকর যেভাবে ইউনিয়ন পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছিল, আজকে কসকর না করলেও টিসিবিকে
কসকরের ভূমিকায় অবতীর্ণ করা যায়। এতে জনবল বৃদ্ধিটা হয়তো প্রয়োজন হতে পারে।
পণ্যের মূল্যে যদি ভর্তুকি না-ও দেওয়া হয়, তাদের বিস্তৃত কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ সুফল পেতে পারে। শীতের সবজি বাজারে সরবরাহ বেড়েছে, এর সুফলও ভোক্তারা ইতোমধ্যে পেতে শুরু করেছেন। হয়তো চলতি সপ্তাহে আরও দাম করতে পারে। মানুষ সহজে এবং স্বল্পমূল্যে খাদ্যপণ্য যাতে কিনতে পারে সেদিকে জরুরি ভিত্তিতে নজর দিতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু নজরদারির আওতায় না আনা গেলে সরকার যতই শুল্কছাড় দিক, লাভের গুড় পিঁপড়ার পেটেই যাবে। বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে এ পর্যন্ত কথা হয়েছে বিস্তর কিন্তু কাজের কাজ যে সেই অনুপাতে কিছুই হয়নি এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রোজন।