সার্চ কমিটি
মুনিরা খান
প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:১৮ এএম
মুনিরা খান
দেশের সংবিধান অনুযায়ী সংসদ ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন আয়োজনের নির্দেশনা রয়েছে। ৪ নভেম্বর গত সংসদ ভেঙে যাওয়ার ৯০ দিন পূর্ণ হবে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে হাতে মাত্র তিন দিন বাকি থাকতে নির্বাচন আয়োজন যে সম্ভব নয়, এ নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিশন ৫ সেপ্টেম্বর একযোগে পদত্যাগ করে। এর পর থেকে দেশে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সাংবিধানিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশন দুই মাস ধরে শূন্য। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৯ অক্টোবর ইসি গঠনে সার্চ কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ৩০ অক্টোবর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছয় সদস্যের এ কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী এবং সদস্য হয়েছেন বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান। আইন অনুযায়ী ছয় সদস্যের সার্চ কমিটিতে দুই বিচারপতির সঙ্গে থাকছেন রাষ্ট্রপতি মনোনীত দুই বিশিষ্ট নাগরিক। তারা হলেন পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিন্নাতুননেসা তাহমিদা বেগম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক সি আর আবরার। এ ছাড়া পদাধিকারবলে অন্য দুই সদস্য হলেন সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মোবাশ্বের মোনেম এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মো. নূরুল ইসলাম। নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটির বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তারা আপাতত পর্যবেক্ষণ করছে। এর আগে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার জোর দাবি জানানোর প্রেক্ষাপটে সরকারের তরফে বার্তা গেছে, ইসি গঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচনমুখী যাত্রা হয়ে গেছে।
আমরা জানি, নির্বাচন কমিশন সংস্কার লক্ষে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই কমিশনের
৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের কাছে সুপারিশ উপস্থাপন করার কথা রয়েছে। ৩০ অক্টোবর প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, সরকার গঠিত এ সার্চ কমিটি নতুন
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্য চার নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য প্রতি
পদের বিপরীতে দুজন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে। এ সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি পাঁচ
সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। শুরুতে আইন সংস্কারে ব্যাপক উদ্যোগের কথা বলা
হলেও বিদ্যমান আইনেই গঠন হতে যাচ্ছে নতুন কমিশন। রাজনৈতিক মহলে এ নিয়ে মিশ্র
প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও তাদের পর্যবেক্ষণ করার বিষয়টি ইতিবাচক। কারণ দেশে নির্বাচনব্যবস্থা
নিয়ে এ স্তম্ভেই নিকট অতীতে জানিয়েছিলাম অসন্তোষের কথা। তাই
নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কারের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বের দাবিদার। পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দেশের জনগণ এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও
বাড়তি উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ নিজের ভোটাধিকার সম্পর্কে সব পক্ষই সচেতন হয়ে উঠতে
শুরু করেছে।
আমরা জানি, নির্বাচনের মাধ্যমে
গণপ্রতিনিধিত্বশীল রাষ্ট্র পরিচালনাকারী কাঠামো গঠন করা হয়। দেশে গণতন্ত্রের আড়ালে
স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা কায়েমের অপপ্রচেষ্টা কম চালানো হয়নি। ফলে আমাদের দেশে
বিভিন্ন সময় জনতাকে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হয়েছে। বারবার
যেন গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেজন্য জনগণের নির্বাচিত সরকার
গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করার কোনো বিকল্প নেই। একটি সুষ্ঠু-অবাধ-স্বচ্ছ-নিরপেক্ষ এবং
সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধির কাছে দেশের শাসনভার
অর্পণ করাই হবে রাষ্ট্র সংস্কারের মুখ্য ধাপ। এজন্য সবার প্রথমে জনগণের মতের
প্রতিফলন ঘটায়, এমন নির্বাচন কমিশন গড়ে তুলতে হবে। সার্চ
কমিটি এবং নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করাই
এখন মূল চ্যালেঞ্জ।
আমরা জানি, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে দেশে একটি কমিশন
তৈরি করা হয়েছে। এ সংস্কার কমিটি একটি স্বচ্ছ-জবাবদিহিমূলক
নির্বাচন কমিশন গঠনের পাশাপাশি নির্বাচনব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়টি
পর্যালোচনার কাজ শুরুও করেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ভোটার
ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে আসন্ন
নির্বাচনের ব্যবস্থাপনা কাঠামো, সংস্কার পদ্ধতি, সুপারিশমালা ও অংশীজনদের মতামত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে উপস্থিত করবে। দেশের
জাতীয় সংসদে নির্বাচন পদ্ধতি ‘দ্য রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপলস রিপ্রেজেন্টেটিভ-১৯৭২’
এবং ‘কন্ডাক্ট অব ইলেকশন রুলস-১৯৭২’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এসব অর্ডার রাষ্ট্রপতির আদেশ, বিধিমালা
ও সবকিছু বিবেচনা করে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় সময় গঠিত কমিশনের
প্রধান এবং অন্য সদস্যদের অবশ্যই দিতে হবে। সার্চ কমিটি মূলত তাদের সুপারিশের
ভিত্তিতেই নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। অর্থাৎ তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া এবং ব্যবহারিক প্রক্রিয়ার
মিশেলে একটি স্বচ্ছ, সুষ্ঠু এবং স্পষ্ট নির্বাচন কমিশনের কাঠামো পাওয়ার প্রত্যাশা পূরণ
হওয়া সম্ভব।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত নির্বাচন সংস্কার কমিটির সদস্যরা
দীর্ঘদিন ধরেই দেশের বিদ্যমান নির্বাচনব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতি
সম্পর্কে অবগত রয়েছেন এবং এ বিষয়ে তাদের দক্ষতারও ঘাটতি নেই। তবু দেশে জনগণের
নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। ফলে এ কমিশনের উপস্থাপিত সুপারিশমালা কতটা জনমতের সমর্থন
আদায়ের পাশাপাশি আইনগতভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে এবং ঠিক কোন পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করা
হবে;
এ নিয়ে এখনও আমরা স্পষ্ট নই। কিন্তু
সার্চ কমিটি গঠন হওয়ার পর এ বিষয়ে এবার স্পষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেছে। সংস্কার কমিশনকে পূর্বাপর মতামতগুলো যেমন বিবেচনায় আনতে হবে, তাদের কার্যক্রমের ভিত্তিতে
সার্চ কমিটি মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা থিতু রূপ দিতে পারবে। তবে নির্বাচন কমিশন গঠনের
ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে।
কারণ রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এত বড় কর্মযজ্ঞ সফল করা সম্ভব নয়।
দেশে অনেক রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত রয়েছে। তাদের সঙ্গে অনেকটা
মাশরুমের মতো অনেক অঙ্গসংগঠনও রয়েছে। আছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষকরাও। এ ক্ষেত্রে
রাজনৈতিক দল এবং অংশীজনদের বিষয়ে কী নির্দেশনা থাকবে তা বিবেচনায় রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট
দায়িত্বশীল পক্ষকে। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আওতায়
কমিশনের আকার, কার্যক্রম এবং তাদের কার্যক্রমের জবাবদিহির
ধরন, তাদের ক্ষমতায়নের রোডম্যাপ থাকা বাঞ্ছনীয় এবং সার্চ কমিটি সে অনুসারেই
নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য, জবাবদিহিমূলক এবং সর্বজনগৃহীত নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনব্যবস্থার আয়োজনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের গঠন
প্রক্রিয়ার প্রতি সবার আস্থা গড়ে তুলতে হবে। যদি তা না করা যায় তাহলে আবারও
নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিক্রান্তেও তর্কের ঊর্ধ্বে
নির্বাচন দেশের মানুষ দেখেনি। আমরা অনেকেই দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থা
আয়োজনের বিষয়ে নানা প্রস্তাবের বিষয়টি উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি এবং দেশে-বিদেশে
বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছি।
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার নিরিখে বলতে পারি—নির্বাচন কমিশনের যদি সমন্বয়ক্ষমতা, সাহসী
মনোভাব,
দৃঢ়তা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের প্রতিজ্ঞায়
প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকার জবাবদিহি না থাকে, তাহলে সুষ্ঠু-স্বচ্ছ
নির্বাচন আয়োজন কঠিন হয়ে যায়। রাজনৈতিক দল ও ভোটারÑ এ দুই বড় অংশীজন
নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা না রাখলে সুষ্ঠু ভোটের আয়োজন কঠিন হয়ে পড়ে। তাই
নির্বাচন কমিশন যাতে স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে সে স্বাধীনতা ও
ক্ষমতা তাদের দিতে হবেই। নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে তাদের দায়িত্ব পালনে সততার জন্য
রাজনৈতিক হেনস্থা যাতে না হতে হয় সেজন্যও আইন থাকা জরুরি। এখানে আরেকটি বিষয়
গুরুত্বপূর্ণ,
আমরা দেখি নির্বাচন কমিশনে থাকা প্রতিটি সদস্যই থিতু হয়ে
কাজ করেন। টানা পাঁচ বছর মেয়াদে নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা কাজ করে যান এবং অতীতে
আমরা দেখেছি তারা বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে তাদের ব্যর্থতার দৃশ্য আরও
করুণভাবে উপস্থাপন করেও পার পেয়ে গেছেন।
নির্বাচন কমিশন শুধু জনগণের কাছে জবাবদিহি করবে। দায়িত্বে
থাকাকালে কোনো সদস্য দায়িত্ব পালনে গাফিলতি, অসততা, অযোগ্যতার পরিচয় দিলে তাকে অপসারণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন
আয়োজনের স্বার্থে সদস্যসংখ্যা বাড়ানোও যেতে পারে। তবে সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে
অবশ্যই অনেক যাচাইবাছাই করতে হবে। আমরা দেখেছি, সুষ্ঠু নির্বাচনের ধ্যানধারণার মধ্যেই পড়ে না এমন তিনটি নির্বাচন টানা তিন
মেয়াদে সম্পন্ন হয়েছে। আর এভাবেই জনগণের সার্বভৌম অধিকার খর্ব হয়েছে এবং মানুষ
ভোটদানের প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে। অর্থাৎ পুরো নির্বাচনব্যবস্থা বা প্রক্রিয়া
ভোটারের আস্থা হারিয়েছে। সার্বভৌম অধিকারের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত না
হওয়ার ফলে শাসনব্যবস্থায় যে বড় ফাঁক তৈরি হয়েছে তার ফলে জনপ্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের
সঙ্গেও সাধারণ মানুষের বিরাট বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। দেখা দিয়েছে শাসনব্যবস্থায়
দুর্নীতি ও হতাশাজনক নৈরাজ্য।
ভোটাধিকার এক ধরনের মানবাধিকার। ভোটাধিকার নিশ্চিত হলে রাষ্ট্র মানবাধিকারের অন্য অনুষঙ্গগুলো নিশ্চিত করার সুষ্ঠু ভিত পায়। জনপ্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে কেউ শাসনকাঠামোয় বসবেন এবং সেই জনপ্রতিনিধি জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবেন; তখন অপশাসনমুক্ত হবে দেশ। আর তা করতে হলে আমাদের প্রয়োজন সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে অনেক গভীরে গিয়ে কাজ করতে হবে। নির্বাচনব্যবস্থা আয়োজনের দায়িত্ব যে প্রতিষ্ঠানের, সে কমিশনের ক্ষমতায়ন ও স্বচ্ছতার ভিত মজবুত করতে হবে। একই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে তাদের জবাবদিহিও। স্বচ্ছতা ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে এগোক আগামীর নির্বাচন কমিশন। তবে এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর এবং জনগণের সহযোগিতা দরকার। যূথবদ্ধ প্রয়াসেই সূচিত হতে পারে কাঙ্ক্ষিত পথ। বিশ্বাস করি, ব্যবস্থা স্বচ্ছ হলে নিশ্চয়ই অবস্থা ভালো হবে।