আইনের শাসন
মহিউদ্দিন খান মোহন
প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:১৫ এএম
তখন দেশে টিভি চ্যানেল বলতে সবে ধন নীলমণি বাংলাদেশ টেলিভিশন বা বিটিভি। অনুষ্ঠান চলাকালে মাঝে মাঝেই সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেলে পর্দায় একটি কৈফিয়ত ভেসে উঠতÑ ‘যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে অনুষ্ঠান সম্প্রচারে বিঘ্ন ঘটছে। এ অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য আমরা দুঃখিত। Ñকর্তৃপক্ষ’। এ ‘অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি’ নিয়ে আমাদের বন্ধুমহলে বেশ সরস আলোচনা হতো। যেহেতু এটা অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি, তাহলে ইচ্ছাকৃত ত্রুটি বলে কিছু আছে কি না তা নিয়ে বিতর্ক হতো। বিটিভির সেই ‘অনিচ্ছাকৃত’ ত্রুটিকে মানুষ ক্ষমা করে দিত এবং না করেও উপায় ছিল না। তবে সব ভুল বা ত্রুটি বোধহয় ক্ষমা করা যায় না।
মানুষ সাধারণত
ইচ্ছা করে ভুল করে না। কারণ ভুল করলে ভুলের খেসারত দিতে হয়। তাই মানুষ চেষ্টা করে কোনো
কাজে ভুল বা ত্রুটি যাতে না হয় সে সম্পর্কে সজাগ থাকতে। এতদ্সত্ত্বেও মানুষ ভুল করে।
‘মানুষমাত্রই ভুল হয়’ কথাটির প্রচলন তো এমনি এমনি হয়নি। কাজ করলে ভুল হতেই পারে। অবশ্য
ব্রিটেনের রাজা-রানী সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত আছেÑ ‘রাজা বা রানী ভুল করতে পারেন
না’। প্রকৃতার্থে তাদের ভুল করার সুযোগ নেই। কারণ তারা রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে কোনো ভূমিকাই
রাখতে পারেন না। আরও সহজ ভাষায় বললে সে সুযোগ তাদের নেই।
তবে ভুলেরও মাত্রা
আছে। কিছু ভুল আছে, যা সহজেই ক্ষমা করে দেওয়া যায়। কিন্তু এমন কিছু ভুল আছে, যেগুলো
ক্ষমার অযোগ্য। কেননা ওইসব ভুলে কোনো ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর ভোগান্তি সৃষ্টি হতে পারে,
ক্ষতির কারণ হতে পারে। তেমনই একটি ‘ভুল’ এখন দেশব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। বর্ষীয়ান
আইনজীবী অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্নাকে একটি হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি করার খবরে বিস্মিত
হননি এমন কেউ আছেন বলে মনে হয় না। জেড আই খান পান্না একজন মুক্তিযোদ্ধা, মানবতাবাদী,
গণতন্ত্রী এবং মানুষের বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার নাগরিক হিসেবে সুপরিচিত।
তার নাম যখন একটি হত্যাচেষ্টা মামলার তালিকাভুক্ত হয়, তখন সে মামলার বাদীর মস্তিষ্কের
সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। উপরন্তু ঘটনার দিনক্ষণ বৈষম্যবিরোধী
ছাত্র-গণ আন্দোলনের সময়কার। আর আক্রান্ত যুবক ওই আন্দোলনের একজন কর্মী ছিলেন। মনে হতে
পারে, জেড আই খান পান্না ওই আন্দোলনের রিবোধী ছিলেন এবং হত্যাচেষ্টাকারীদের ইন্ধন জুগিয়েছেন।
অথচ গোড়া থেকে তিনি ছিলেন আন্দোলনের পক্ষে এবং সরকারের দমননীতির প্রতিবাদ করেছেন প্রকাশ্যেই।
একটি কথা প্রচলিত
আছেÑ বাংলাদেশ হলো সব সম্ভবের দেশ। এখানে সবকিছুই সম্ভব। ব্রিটেনের পার্লামেন্টের শক্তিমত্তার
কথা জানান দেওয়া হয় একটি বাক্যেÑ ‘ব্রিটেনের পার্লামেন্ট পুরুষকে নারী ও নারীকে পুরুষ
বানানো ছাড়া আর সবই করতে পারে।’ আমাদের দেশের পুলিশ সম্পর্কে প্রচলিত কথাটি হলোÑ পুলিশ
সব পারে। তারা সহজেই সাধুকে শয়তান আর শয়তানকে সাধু বানিয়ে দিতে পারে। তবে জেড আই খান
পান্নার ব্যাপারটি পুলিশ ঘটিয়েছিল কি না স্পষ্ট নয়। কেননা মামলার বাদী বাকের বলেছেন,
তিনি জেড আই খান পান্নাকে চেনেন না, তার নাম মামলায় তিনি দেননি। মামলা যারা লিখেছেন,
তারাই দিয়েছেন। এখন মামলার দলিলপত্র যাচাই করলে বোঝা যাবে কাদের কেরামতিতে পান্না সাহেব
উকিল থেকে আসামি হয়ে গেলেন। অবশ্য ইতোমধ্যে বাদী বাকের মামলা থেকে অ্যাডভোকেট পান্নার
নাম বাদ দেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। এদিকে ২১ অক্টোবর জেড আই খান পান্না হাইকোর্ট থেকে
জামিন পেয়েছেন। বাদীর আরজির পরে হয়তো এ মামলায় জেড আই খান পান্নার নাম আর থাকবে না।
কিন্তু ইতোমধ্যে তিনি যে মানসিক ও সামাজিক হয়রানির শিকার হয়েছেন তার প্রতিবিধান কী?
বর্ষীয়ান এ আইনজীবী মামলায় তার নাম দেখার পর খুবই বিমর্ষ হলেও রসিকতা করে বলেছেন, বয়স
বিবেচনায় তো তার নামটি এক নম্বরে থাকা উচত ছিল। সে জায়গায় তার নাম দেওয়া হয়েছে ৯৪ নম্বরে।
এটা তার নাম এবং খ্যাতির সঙ্গে অবিচার করা হয়েছে।
এমন অন্যায়ের
শিকার এ দেশে অনেকেই হয়েছেন এবং হচ্ছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আমাদের এলাকার
(মুন্সীগঞ্জ-১) নৌকার প্রার্থী মাহী বি. চৌধুরীর নির্বাচনী ক্যাম্প পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে
দুটি মামলায় আমাকে আসামি করা হলো। একটিতে আসামি ৪৭, আরেকটিতে ৬৩ জন। ওই মামলায় যেদিন
জামিন নিতে যাই, আদালতে আমাদের আইনজীবী বন্ধু নাসিরুজ্জামান খান বলেছিলেন, ‘মাননীয়
আদালত, এ আদালতে আমরা দুইশর মতো আইনজীবী রয়েছি। দশ-বিশ জন ছাড়া আমরা কাউকে সরাসরি চিনি
না। অথচ এ মামলা দুটির বাদী রাতের অন্ধকারে শতাধিক মানুষকে চিনে ফেললেন! শুধু তাই নয়,
তিনি তাদের বাবার নাম, বাড়িঘরের ঠিকানাও জেনে গেলেন! বুঝতে কি বাকি থাকে স্যার, এটা
কোন ধরনের মামলা?’ বিচারক কোনো মন্তব্য না করে আমাদের জামিন মঞ্জুর করেছিলেন। পরে সে
মামলাটি আর টেকেনি। না টেকারই কথা। মিথ্যার ওপর কখনও কোনো কিছু দাঁড়াতে পারে না। আইনের
শাসন ও ন্যায়বিচারের পথ সুগম করার জনদাবি দীর্ঘদিনের। এ ধরনের কর্মকাণ্ড জিইয়ে রেখে
যে তা সম্ভব তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই।
জেড আই খান পান্না
দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী বিধায় তার বিষয়টি সবার নজর কেড়েছে, হাইকোর্ট তাকে জামিন দিয়েছেন।
কিন্তু সাধারণ মানুষ কি হয়রানি থেকে রেহাই পায়? ভুয়া মামলা, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির
রেকর্ড সৃষ্টি করেছে গত আওয়ামী লীগ সরকার। বিএনপির সক্রিয় নেতাকর্মীদের মধ্যে এমন খুব
কমই আছেন যিনি দু-চারটি মামলার আসামি হননি। কেউ কেউ তো একশ-দুশ মামলারও আসামি হয়েছেন।
মামলা-গ্রেপ্তারে বিশ্বরেকর্ড বলা যায়।
সেই দুঃসহ পরিস্থিতির অবসান হয়েছে। স্বৈরশাসক বিদায় নিয়েছে। তবে পুলিশের গ্রেপ্তার বন্ধ হয়নি। আগে গ্রেপ্তার করত বিএনপি নেতাকর্মীদের, এখন করছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। ইতোমধ্যে অভিযোগ উঠেছে, কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই অনেককে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ঠিক আওয়ামী লীগ স্টাইলে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। লীগ সরকারের তাঁবেদার পুলিশ কর্মকর্তারাই নাকি এ ধরনের পাইকারি গ্রেপ্তারে বেশি উৎসাহী। অনেকেই সন্দেহ করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পুলিশের একটি অংশ এ অশুভ কাজে প্রবৃত্ত হয়ে থাকতে পারে; যারা ৫ আগস্টের বিপ্লব মেনে নিতে পারেনি। সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, এ ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর নজরদারি দরকার। যাতে কোনো অপশক্তির অসদুদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসেবে পুলিশ ব্যবহৃত না হয়।