যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন
জনাথান মার্টিন
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:১০ এএম
জনাথান মার্টিন
ঘড়ির কাঁটা সময় এগিয়ে নিচ্ছে। হাতে সময় অল্প। কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প দুজনই নির্বাচনী প্রচারের শেষ ধাপে রয়েছেন। সম্প্রতি মিলওয়ায়ুবে মফস্বলে এক রাতে একটি গির্জায় কমলা হ্যারিস অনেকের সঙ্গে বসে আলোচনা করেছেন। রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য ম্যাকডোনাল্ডসের ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ভেজে বিতরণ করছিলেন। তার নির্বাচনী সেই প্রচারের আলাদা সাংস্কৃতিক মাত্রা রয়েছে। ম্যাকডোনাল্ডস ও অর্থনীতির এই সম্পর্ককেও অনেক রাজনীতিবিদ এড়িয়ে যাননি। তবে কমলার আয়োজন সেদিন ছিল শান্ত। ধর্মসভার মতোই শান্তশিষ্টভাবে তিনি সবাইকে জানিয়েছেন নিজের লক্ষ্যের কথা। সমস্যা হলো, তারা দলবদল করা মানুষদের কাছেই জানাচ্ছিলেন তাদের কথা। মূলত, ওই আয়োজনে কমলা মডারেট এবং যুক্তিবাদী রিপাবলিকানদের লক্ষ্য করে নিজ দলে টানতে চেয়েছিলেন। যদি এই অংশের ভোট পাওয়া যায় তাহলে ট্রাম্পকে টেক্কা দেওয়া কঠিন কিছু হবে না। তবে ওই সভাতেই অনেকে ‘দ্য লিংকন প্রজেক্ট’ নামের টি-শার্ট পরে ছিলেন। তাই এই জনসভা কতটা সার্থক হয়েছে এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কমলা হ্যারিস তার প্রচারে জানান, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে ন্যূনতম ভদ্রতাবোধ নেই। তিনি দেশের সংবিধান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। এমনকি উপস্থিত অনেককেই জিজ্ঞেস করেছেন, তার শাসনে আইনের অবস্থা কেমন হতে পারে তা একবার কল্পনা করে দেখা উচিত। সংগতকারণেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের অপরাধের খতিয়ান নিয়েও নানা আলোচনা হয়েছে।
ডেমোক্র্যাটদের জন্য এসব বিষয় অনেক জরুরি। কারণ জাতি ও বর্ণবাদী বিষয়বস্তু
তাদের নির্বাচনী লড়াইয়ের জন্য একটি বড় ঝড়। অনেকেই ট্রাম্পের জিওপি থেকে নিজেদের দূরত্বে
রেখেছেন। তারপরও অনেক মানুষ এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি তারা কাকে ভোট দেবেন। এমনকি
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহেও এমন অনেক মানুষ রয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের চরিত্র বিশ্লেষণ
করে কি এই ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণ করা সম্ভব হবে? অন্তত ট্রাম্পের প্রচার থেকে উল্টোটাই
দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ট্রাম্প জানিয়ে দিয়েছেন, তার কাছে গতকাল আজ এবং পরেরদিনটাই অনেক
জরুরি। অবশ্যই ট্রাম্প সুযোগসন্ধান করছেন নাÑ এমনটি ভাবলে ভুল হবে। কমলাকে অনেকে অবশ্য
জানিয়েছেন, অনেক রিপাবলিকান ট্রাম্পকে সমর্থন না দিলেও ডেমোক্র্যাটদের ভোট দেওয়ার ব্যাপারে
তাদের অনাগ্রহও রয়েছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা অবশ্য বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলে ওই আয়োজনে
নিজের অবস্থান স্পষ্ট করার চেষ্টা করেন। ওই সময় তাকে অনেকটা ছাত্রনেতার মতোই শোনাচ্ছিল।
যেন ম্যাডিসনের সেই শিক্ষার্থী যে কি না অধিকাংশ আমেরিকানের কথা স্বাচ্ছন্দ্যে বলতে
পারেন। তিনি গণতন্ত্র ও দেশপ্রেমের পক্ষে কথা বলেছেন। গণতন্ত্রের কথাও বলেছেন। এমনকি
তিনি জানিয়েছেন সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটিতে তিনি অনেকটাই অগ্রসর হতে পেরেছেন এবং আইনজীবীদের
অধিকার সংরক্ষণের বিষয়ে সোচ্চার রয়েছেন। মূলত, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং সুশাসনের দিকে
তাদের চিন্তাভাবনা অনেক গভীর। হ্যারিসের মতে, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে এ দুটো বিষয়ই নানা
সংকটে পড়বে। হ্যারিস অবশ্য তার প্রচারণায় বহুবার বলেছেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে রিপাবলিকানরাও
সুশাসনের নিশ্চয়তা পাবেন কি না এ বিষয়টি স্পষ্ট নয়। তিনি রাষ্ট্রকে একটি নির্দিষ্ট
কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক অবস্থান থেকে পরিচালনার পক্ষপাতী নন। অবশ্যই কমলা হ্যারিস নিজের
দলের সমালোচনা করেননি। কেন দীর্ঘদিনের কনজারভেটিভদের দিকে না এগিয়ে তিনি লিবারেলদের
দিকে ঝুঁকছেন তাও ব্যখ্যা করেননি। এমনকি নিজ কেবিনেটে একজন রিপাবলিকানকে অন্তর্ভুক্ত
করার কথাও তিনি বলেননি। বলেননি বাইপারট্যাসিয়ান কাউন্সিল গঠনের কথাও। এ দুটো বিষয়ই
রিপাবলিকানদের দ্বন্দ্বে থাকা ভোটারদের মনে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, অনেকে কমলার চেষ্টা
দেখেই যে আগ্রহী হয়ে উঠছেন তা নয়। বরং অনেকেই চায় কমলা জিতুক। ট্রাম্পের পরাজয় অনেকেই
চাচ্ছেন। আর এজন্যই অনেকে কমলার প্রচারাভিযানে অংশ নিচ্ছেন। তাদের সমর্থন জানাচ্ছেন।
কিন্তু সাবেক প্রেসিডেন্টকে দোষারোপ করে কিংবা তার ত্রুটি চিহ্নিত করে আমেরিকানদের
মন জয় করা যাবে না। সম্ভবত, হ্যারিস এখনও তা উপলব্ধি করতে পারেননি। ২০২৫ সালের ওয়াশিংটনের
স্থিতিশীল অবস্থাও তার চোখে হয়তো ধরা পড়েনি। বিষয়টি ডেমোক্র্যাটদেরও ভাবাচ্ছে। যেমন
সম্প্রতি হিলারি ক্লিনটন এক সমাবেশে জানালেন, ‘আপনারা ২০১৬ সালের মতোই আভাস পাচ্ছেন?’
অর্থাৎ ভোটের আগেও ডেমোক্র্যাটদের অবস্থা নাজুক। জোটভুক্ত অবস্থায় থাকা মার্কিন সরকারের
দিকেই যদি যাওয়া হয় তাহলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাই গেড়ে বসে বলে অনেক পুঁজিপতির ধারণা।
তবে সফল ডেমোক্র্যাটরা কেন্দ্রকে আশ্বস্ত করছেন। তারা এজন্যই লিবারেল ভোটারদের নিজ
দিকে টানার চেষ্টা করছেন। হ্যারিস তার পূর্বসূরিদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি নিরপেক্ষ
বিধায় তার গ্রহণযোগ্যতাও বেশি বলে অনেকের মত।
কমলার মতে, ‘ট্রাম্প এমন একজন ব্যক্তি যিনি একটি ভালো, মর্যাদাপূর্ণ
এবং মহান দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য নন।’ ইতোমধ্যে অনেকে তা মেনেও নিয়েছেন। এজন্যই
বিগত দুই নির্বাচনে ট্রাম্প সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি। কিন্তু দেখা গেছে, ট্রাম্পের চরিত্র
এবং বিগত মানসিক স্বাস্থ্যের মূল্যায়ন তাকে নির্বাচনে ভোট পাওয়া থেকে দূরে রাখতে পারেনি।
তুলনার হিসেবে হ্যারিসের জনকল্যাণমুখিতা এবং অল্প বয়সকেই অনেকে প্রচারে ব্যবহার করছেন।
এমনকি যারা হ্যারিসের সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত নন তারাও এখন হ্যারিসের পক্ষেই প্রচার
চালাচ্ছেন। আর লিবারেল ভোটারদের জন্য গত সপ্তাহেই কমলা হ্যারিসের পক্ষ থেকে বার্তা
চলে গেছে। তিনি জানিয়েই দিয়েছেন, ‘ট্রাম্প ভালো কি মন্দ তা নিয়ে অহেতুক তর্কে এখন লাভ
নেই। আর জয়ী হলে অবশ্যই আমরা বামপন্থি কায়দার অনুসারী হয়ে যাব না।’
অবশ্যই কমলা হ্যারিসের জন্য অনেক সুযোগ রয়েছে। রোনাল্ড রিগানের মতো
আজীবন রিপাবলিকানও কমলার পক্ষে প্রচার করেছেন। সাবেক স্পিকার টিপ ও নিলও একই দলে। তারা
ইতোমধ্যে বলেও দিয়েছেন, তাদের অবস্থান কেমন। কী কারণে তারা বদলাচ্ছেন দলে ভোট দেওয়া।
ট্রাম্পের বিশ্ববীক্ষা নিয়েও অনেকের নানা তর্ক রয়েছে। বিশেষত, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার
কার্যক্রম নানাভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি অনেকেই ট্রাম্পের প্রচারণা অভিযানের প্রতি
কটূক্তি করে বলেছেন, আপনার সন্তানকে দেখার জন্য যদি প্রেসিডেন্ট বানাতে হয় তাহলেও তো
ট্রাম্পকে বাছাই করার যুক্তি নেই। অনেকেই এমন বক্তব্য পছন্দ করেছেন। বেশ কয়েকটি সমাবেশে
এমন বক্তব্য আনন্দোল্লাসে বরণ করাও হয়েছে। হ্যারিসের নতুন ভোটার বাড়ছেই। অর্থাৎ নির্বাচনের
কিছুদিন আগ পর্যন্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট যথেষ্ট ইতিবাচক রয়েছেন। তিনি মানুষকে মারার পক্ষে
নন বরং ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছেন। ট্রাম্পের তরফে এসব কটূক্তির কোনো
জবাব আসেনি। আর এসব উত্তরহীনতা থেকেই কমলার প্রচারাভিযান দল জানাচ্ছে, ভবিষ্যতের জন্য
ট্রাম্পের আসলে কোনো পরিকল্পনা নেই। চলছে আগাম ভোট। এই আগাম ভোটের মধ্যে ট্রাম্পের
কোনো পরিকল্পনা নেই বললেও বাস্তব বলছে উল্টো। বিজ্ঞাপনী প্রচারণায় পেনসিলভেনিয়ায় ট্রাম্প
প্রচুর বিনিয়োগ করেছেন। কমলার তুলনায় তার বিনিয়োগ দ্বিগুণ। অর্থাৎ ট্রাম্পের যে কোনো
পরিকল্পনাই নেই তা বলা ভুল হবে। বরং সুইং রাজ্যে ভোটের ফলই আমেরিকার বর্তমান ইতিহাসের
মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।
কমলার প্রচারণা দল সম্প্রতি ফিলাডেলফিয়া এবং ডেট্রয়েটে জানিয়েছেন,
আপনার নিজের জ্ঞান ও বিবেচনা দিয়েই ভোট দিন। এমন ভোট দেবেন না, যার জন্য আপনাকে ভবিষ্যতে
আক্ষেপ করতে হয়। কিন্তু এও সত্য, ট্রাম্পের সঙ্গে সফল বিতর্কের পর কমলা প্রচারের সৃজনশীল
কায়দাও হারিয়ে ফেলেছেন। এই মুহূর্তে নতুনভাবে তাকে প্রচারণা চালাতে হবে। তাই কমলা হ্যারিসের
জন্য এখনও সব কাঁটা দূর হয়নি। বেশ কয়েকটি জরিপ ইতোমধ্যে জানিয়েছে, এখনও সমানে সমান
দুই প্রার্থী। আর এ বিষয়টির জন্যই কমলার দেরি করার সুযোগ নেই। এখন আসলে কমলার পক্ষে
শুধু বার্তা পাঠানোই একমাত্র সমাধান নয়।
এখন পর্যন্ত হ্যারিসের দিকেই জয়ের কাঁটা ঝুঁকে আছে। অন্তত বিজ্ঞাপনী প্রচারণা, টেলিভিশনের প্রচার এবং রঙচঙে সমাবেশ তা-ই বলে। সমস্যা হলো, আরব, আমেরিকান, লিবারেল এবং কৃষ্ণাঙ্গ ভোটাররা আস্তে আস্তে ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। যদি বিতর্ক উস্কে দেয় এমন কোনো মন্তব্য কমলা হ্যারিস না করেন, তাহলে জয় তার দিকে আসবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যত খারাপ মানুষই হোক না কেন, নির্বাচনের সমীকরণে তিনি এখনও সমানে সমান। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে। সময় ফুরিয়ে আসছে দুই প্রার্থীর জন্যই।
পলিটিকো থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ : আমিরুল আবেদিন