জনস্বাস্থ্য
ড. কবিরুল বাশার
প্রকাশ : ২৩ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:৪২ এএম
ড. কবিরুল বাশার
ক্ষুদ্র পতঙ্গ মশা, কিন্তু তার দ্বারা সাধিত
অর্থনৈতিক ক্ষতি অনেক বেশি। পৃথিবীতে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি প্রজাতির মশা রয়েছে। এর
মধ্যে প্রায় ২০০ প্রজাতির মশা বিভিন্নভাবে মানুষের রোগশোকের জন্য দায়ী। মশাই
একমাত্র প্রাণী যে সবচাইতে বেশি মানুষের প্রাণ নিয়েছে। আর মানুষের মৃত্যু ঘটানোর
জন্য দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মানুষ। প্রতি বছর মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে লাখ
লাখ মানুষ মারা যায় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মশাকে জনস্বাস্থ্যের জন্য, বিশেষ
করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য শীর্ষ হুমকির তালিকাভুক্ত করেছে। প্রতি বছর বিভিন্ন
দেশ মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে এবং মশার কামড়-পরবর্তী
জটিলতার সম্মুখীন হওয়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে বিনিয়োগ করে। যার
ফলে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয় দেশগুলো।
ডেঙ্গুর প্রধান বাহক এডিস ইজিপ্টা মশা। ধারণা করা হয়,
৯৫ শতাংশ ডেঙ্গুর কারণ এ মশা। এটিকে নগরের মশা বা গৃহপালিত মশাও বলা হয়। ডেঙ্গুর আরেকটি
বাহক মশা আছে যা ৫ ভাগ ডেঙ্গুর জন্য দায়ী যেটি এডিস অ্যালবোপিকটাস বা এশিয়ান টাইগার
মশা নামেও পরিচিত। এ মশা গ্রামাঞ্চলে যেখানে গাছগাছালি বা ঝোপঝাড় বেশি, সেখানে হয়।
এটিকে বলা হয় গ্রামের মশা। দুটি মশারই গায়ে এবং পায়ে সাদা-কালো ডোরাকাটা দাগ থাকে।
এ মশা দুটি মাঝারি আকৃতির। কেউ কেউ ডেঙ্গুর বাহক হিসেবে আরেকটি মশার কথা ভুল করে বলেন,
সেটি হলো আর্বিজেরিস। আর্বিজেরিসের পেটে ডোরাকাটা থাকে কিন্তু পায়ে থাকে না। অন্যদিকে
এডিস মশার গায়ে এবং পায়ে উভয় জায়গায়ই ডোরাকাটা থাকে। এডিস ইজিপ্টা মশা ডেঙ্গুর প্রধান
বাহক। এটি শহর-নগরে বেশি দেখা যায়। আবার এডিস অ্যালবোপিকটাস মশা গ্রামাঞ্চলে দেখা যায়।
এ দুই ধরনের মশাই মূলত ডেঙ্গুর জন্য দায়ী। তাই যেখানেই অপরিকল্পিত নগরায়ণ হয়েছে, সেখানেই
ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটেছে।
এডিস মশার আচরণ বা চরিত্রে পরিবর্তন হয়েছে। এটি একটি
সুচতুর মশা। যেকোনো পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। একটা সময়ে আমরা
জানতাম এডিস মশা শুধু পরিষ্কার পানিতে হয়। কিন্তু দীর্ঘ পাঁচ বছরের গবেষণায় আমরা দেখেছি
শুধু পরিষ্কার পানিতেই নয়, নোংরা পানিতেও এডিস মশা জন্মায়। অন্যদিকে আমরা এও জানতাম,
এডিশ মশা শুধু সকালে এবং বিকালে কামড়ায়। এ ব্যাপারটিও আমরা ভুল প্রমাণ করেছি। ২০২১
থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে গবেষণা করে আমরা দেখেছি যে রাতের
বেলাও এডিস মশা কামড়ায়। আমাদের এ গবেষণার ফলটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে প্রকাশিত
হয়। ডেঙ্গু একসময় শহর বা নগরের রোগ ছিল। কিন্তু এখন এটি ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত পৌঁছে
গেছে। এর কারণ সারা দেশেই অপরিকল্পিত নগরায়ণের ছোঁয়া। এখন গ্রামেও একজন মানুষ বিল্ডিংয়ে
থাকতে চায়, কিন্তু বিল্ডিং করার সময় পানি সরবরাহব্যবস্থা ও ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিকমতো
নিশ্চিত না করার কারণে অনেক সময় পানি জমে থাকে এবং এ জমা পানিতে এডিস মশা জন্মায়।
এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ক্যান ফুড ও প্যাকেটজাত খাবারের
ব্যবহার গ্রামে বেড়ে যাওয়ায় গ্রামেও এখন এসব প্যাকেট বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকে। পরবর্তীতে
এসব জায়গায় আমরা এডিস মশার প্রজনন হতে দেখি। এ ছাড়া গ্রাম ও শহরের মধ্যে ব্যবধান কমে
যাওয়া এবং গ্রামেও বিভিন্ন ধরনের পাত্র যেখানে সেখানে পড়ে থাকায় এখন এডিস মশার প্রজনন
বেড়ে যাচ্ছে এবং ডেঙ্গু দেখা দিচ্ছে। বিভিন্ন বিজ্ঞানীর গবেষণা অনুযায়ী,
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২৬ প্রজাতির মশা শনাক্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে বর্তমানে ঢাকায়
আমরা পাই ১৬ প্রজাতির। উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়া, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বর্জ্য
ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার
বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ না করার কারণে বাংলাদেশ মশা ও মশাবাহিত রোগ বিস্তারের জন্য
উত্তম জায়গা। বাংলাদেশে মশাবাহিত রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ডেঙ্গু,
চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস। সম্প্রতি
আইসিডিডিআরবির গবেষণায় জিকারও অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
আগে বলা হতো, শুধু দিনের বেলায় এডিস মশা কামড়ায়। আমরা আমাদের
গবেষণায় দেখেছি, এডিস মশা এখন দিনে ও রাতে উভয় সময়েই কামড়ায়। ফলে দুই সময়েই আমাদের
সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। এ ছাড়া আমরা জানতাম, এডিস মশা শুধু পরিষ্কার পানি থেকে
জন্মায়, এও এখন আর সত্য নয়। গবেষণায় আমরা পেয়েছি, এডিস মশা নোংরা পানিতে এমনকি
নালা-নর্দমায়ও প্রজনন ঘটাচ্ছে এবং আমরা এর প্রমাণও করেছি। বিষয়টি অবশ্যই ডেঙ্গু
মোকাবিলা আরও কঠিনতর করে তুলবে। কারণ শুধু পরিষ্কার পানি নয়, নোংরা পানিতে এডিস
মশার প্রজনন নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে এখন।
এ বছরের ১২ এপ্রিল একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে প্রকাশ ‘মশার পেটে ১২৭৫
কোটি টাকা’। খবরের এই শিরোনামটি চমকে যাওয়ার মতো, যদিও এ হিসাবটি গত ২৭ বছরের বলে
জানিয়েছেন প্রতিবেদক। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গবেষক ড. আবদুর
রাজ্জাক সরকার ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ডেঙ্গুর আর্থিক ক্ষতি নিয়ে একটি গবেষণা করেন।
তাদের গবেষণামতে প্রতিজন ডেঙ্গু রোগী তার চিকিৎসার জন্য গড়ে ৩৯ হাজার ৮৯৩ টাকা খরচ
করেছেন। সরকারি হিসাবমতে ২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন রোগী হাসপাতালে ডেঙ্গুর
চিকিৎসা নিয়েছেন। তাহলে তাদের মোট ব্যয় হয়েছে ৪০৪ কোটি টাকা। এ ব্যয় শুধু
চিকিৎসা বাবদ। এ ছাড়া হাসপাতাল পরিচালনা, পরিবহন, রোগী এবং তার পরিবারের লোকদের
শ্রমঘণ্টা নষ্ট হওয়ার ব্যয় আরও অনেক বেশি। তাতে অর্থনীতির ওপরও চাপ পড়ছে। ২০২২
সালেও ৬২ হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের
গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ডেঙ্গু চিকিৎসায় ব্যয় হয়েছে হাজার কোটি টাকার ওপরে।
তাদের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে ব্যক্তি পর্যায়ে ডেঙ্গু চিকিৎসার কারণে আর্থিক ক্ষতির
পরিমাণ প্রায় ৩৫৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। তবে যারা হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে
বাসায় ফিরে গেছেন তাদের খরচ এবং ডেঙ্গু থেকে নিরাপদে থাকতে মশাপ্রতিরোধী কয়েল,
স্প্রেসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনার খরচ এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। দি
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব অ্যাপ্লাইড ইকোনমিকস্ অ্যান্ড ফিন্যান্সে প্রকাশিত
সায়মা ইসলাম ও ইফতেখারুল হকের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৯-২০ সালে ডেঙ্গু
চিকিৎসায় অর্থনৈতিক ব্যয় প্রায় ১৫.২৭ মিলিয়ন ডলার। ডেঙ্গু মোকাবিলার সামগ্রিক
ব্যয় আরও বৃদ্ধি পাবে যদি বহির্বিভাগের রোগীর খরচ এবং রোগী ও তার স্বজনদের শ্রমঘণ্টা
হিসাবের মধ্যে আনা হয়। হাসপাতালে ভর্তি ছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসা খরচের
পাশাপাশি এ রোগ থেকে বাঁচতে মশা প্রতিরোধে স্প্রে, কয়েল, ব্যাট, মশারিসহ বিভিন্ন
ধরনের সরঞ্জাম কেনার খরচ প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা।
ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়ার
মতো মশাবাহিত রোগের চিকিৎসা বা মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করার অর্থনৈতিক ক্ষতি
একমাত্র ক্ষতি নয়। মশা গবাদি পশু এবং পশুদের ক্ষতি করে, ফলে কৃষকের জন্য রোগ এবং
আঘাতের কারণ হয়। এ ক্ষতির অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে কিছু বিতর্ক আছে। তবে একটি
অনুমান করা হয়, পৃথিবীতে বার্ষিক ৬১ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হতে পারে। মশার ও
মশাবাহিত রোগের চিকিৎসায় জনগণ নিজেদের পকেট থেকে ব্যয় করছে। তবে সরকারকেও প্রচুর
টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে, যা এখানে অন্তর্ভুক্ত নয়। তা ছাড়া মশাবাহিত রোগ আতঙ্কে অনেকে
মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যার আর্থিক ক্ষতি হিসাব করা যায় না।
আমার এ লেখাটি কাউকে আতঙ্কিত করার উদ্দেশ্যে নয়। ডেঙ্গু ২০১৯, ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে বিপুল জনগোষ্ঠীকে আক্রান্ত করেছে এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে। এমন পরিস্থিতি আগামীতেও হতে পারে। তাই এর একটি প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে যেসব গবেষক মশার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন তাদের সঙ্গে নিয়ে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার একটি বিজ্ঞানভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের অবর্ণনীয় কষ্ট ও আর্থিক ক্ষতির গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে দেশের বড় রকমের অর্থনৈতিক ক্ষতি ঠেকানো সম্ভব। এ নিয়ে সময়ক্ষেপনের সময়ও হাতে নেই। যত দ্রুত সম্ভব কাজগুলো করতে হবে।