সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:২৬ এএম
জীবনে সব আনন্দই
সুখের নয়। মাঝে মাঝে আনন্দও হয়ে ওঠে বেদনার তীব্র রূপ। যা মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়
দুঃখের সাগরে। এবারে এইচএসসি পরীক্ষার ফল আনন্দকে রূপ দিয়েছে সেরকমই বেদনায়। উচ্চ মাধ্যমিকের
এই ফল ফিরিয়ে এনেছে বেদনাভরা জুলাই-আগস্টের রক্তাক্ত ক্ষণকেই। ১৬ অক্টোবর প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এ ‘আনন্দ যখন কান্না হয়ে এলো’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি এরই সাক্ষ্যবহ।
উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ
দুটি ছবিযুক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এবারকার উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল সত্যিকার অর্থেই
কারও কারও জন্য কান্না হয়ে এসেছে।’ এই বক্তব্যের মধ্যে নিহিত ভাষ্যের প্রেক্ষাপট স্মরণ
করে আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের সহমর্মিতা ও বেদনাকাতর
চিত্তে স্মরণ করি এবং যারা কৃতকার্য হয়েছে তাদের জানাই প্রাণঢালা অভিনন্দন। প্রতিদিনের
বাংলাদেশকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ রায়হানের মা যখন বলেন, ‘আমার ছেলে বেঁচে
নেই, তার এই ফল দিয়ে কী হবে’, তখন যে শোকাবহ রোদন আমাদেরকে স্পর্শ করে, আমাদের হৃদয়ের
রক্তক্ষরণকে বাড়িয়ে তোলে তা শিক্ষার্থীদের ভালো ফলের মাঝেও কান্না হয়েই ফিরে আসে। বৈষম্যবিরোধী
ছাত্র আন্দোলনে নিহত অনেক পরীক্ষার্থীই এবার ভালো ফল করেছে, কিন্তু এখন তারা সবকিছুরই
ঊর্ধ্বে। যারা অকৃতকার্য হয়েছে তাদের জন্য শুভকামনা যেন তারা শিক্ষা অর্জনের পর্বে
ছিটকে না পড়ে, নব প্রত্যয়ে আগামীর জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নিতে থাকে।
৯টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডের
অধীন এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৭৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ, বেড়েছে জিপিএ-৫ এর হার।
গড় পাস ও জিপিএ-৫-এর দিকে এগিয়ে রয়েছে মেয়েরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে
কিছু পরীক্ষা স্থগিতের পর বাতিল করা হয় এবং এ কারণে এবার উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেটে
(এইচএসসি) মূল্যায়ন হয়েছে ভিন্ন প্রক্রিয়া বা পদ্ধতিতে। বাতিল হওয়া পরীক্ষাগুলোর মূল্যায়ন
হয়েছে পরীক্ষার্থীদের এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে (বিষয়ম্যাপিং)।
আর যে কয়টি বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছিল সেগুলোর উত্তরপত্র মূল্যায়নের ভিত্তিতে। এমন পরিস্থিতিতে
অনেকেই ধারণা করেছিলেন, পাসের হার অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু আমরা দেখছি, ৯টি সাধারণ শিক্ষা
বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষার ফল এবং পাসের গড় গতবারের চেয়ে কম। এই পরীক্ষার
ফলাফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫-এর গড় হার বেড়েছে বটে, কিন্তু বরাবরের মতোই প্রশ্ন উঠেছে,
শিক্ষার মানোন্নয়ন হয়েছে কতটা। শিক্ষার মানোন্নয়নের বিষয়টি গাণিতিক হিসাব দিয়ে নির্ণয়
করা যাবে না বলেই আমরা মনে করি। এজন্য লক্ষ রাখতে হবে, পরবর্তী পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার
জন্য ভর্তি প্রতিযোগিতার ফলাফলের পাশাপাশি জ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনার দিকে।
এবার পাসের হারের
ঊর্ধ্বগামিতার পথে প্রতিবন্ধকতা ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ে পরীক্ষার্থীদের ফল তুলনামূলক
খারাপের কারণে। আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, এইচএসসিতে ইংরেজি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি
বিষয়ের ফলের সার্বিকভাবে পাসের হারের ঊর্ধ্ব কিংবা নিম্নগামিতা পরিলক্ষিত হয়। এবারও
এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। বিশ্লেষকদের কারও কারও অভিমত, জিপিএ-৫ বাড়ার পেছনে বিষয়ম্যাপিং
বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
তারপরও উদ্বেগের
বিষয় হলো, ৬৫টি কলেজ থেকে এবার কেউ পাস করতে পারেনি। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে
বলা হয়েছে, গত বছর শূন্য পাস করা কলেজের সংখ্যা ছিল ৪২টি। আমরা দেখছি, দেশে প্রতিষ্ঠান
গড়ে উঠেছে রাজনৈতিক স্বার্থের হিসাব-নিকাশ কষে। এর বিরূপ প্রভাব বহুমাত্রিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
একদিকে কমছে শিক্ষার মান, অন্যদিকে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের অপপ্রভাব সমাজের ক্ষতির
চিত্র স্ফীত করছে। এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহলগুলোর বিশেষ
নজর দেওয়া বাঞ্ছনীয় বলে আমরা মনে করি। আমরা জানি, নিয়মানুবর্তিতা, স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা,
জবাবদিহিতা, শৃঙ্খলা ছাড়া ইতিবাচক কোনো কিছুর বিকাশই সম্ভব নয়। এই প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট
দায়িত্বশীল সব পক্ষের মনোযোগ গভীর করার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা
নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলদের
নির্মোহ অবস্থান নিতে হবে।
এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া মানে উচ্চশিক্ষার প্রবেশদ্বারমুখী হওয়া। উত্তীর্ণরা যাতে নিজ নিজ মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী পরবর্তী ধাপের শিক্ষালাভে সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। অস্বীকার করার অবকাশ নেই, আমাদের শিক্ষায় এখনও ব্যাপক বৈষম্য রয়ে গেছে। আমরা বরাবরই শিক্ষাসহ সবক্ষেত্রে সাম্যের আলো চাই। শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌঁছাক এই প্রত্যয়টুকুই যথেষ্ট নয়, শিক্ষার মানোন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা ক্ষেত্রে সমাজ সুযোগ লাভের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজে তখনই কেউ পিছিয়ে থাকবে না যখন সাম্যের আলো সমাজের স্তরে স্তরে ছড়াবে। শিক্ষার সামগ্রিক বিকাশে এসব বিষয় সামনে রেখেই সংস্কারের দিকে যেতে হবে। দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ যেসব খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, শিক্ষাও এর বাইরে থাকতে পারে না। দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থে শিক্ষা খাতে সংস্কার অপরিহার্য। অনিয়ম-দুর্নীতিসহ বহুমাত্রিক নেতিবাচকতার যে বিরূপ প্রভাব শিক্ষা ক্ষেত্রে পড়েছে এবং একেবারে নিচু থেকে উচ্চপর্যায়ের শিক্ষাস্তর পর্যন্ত দলীয়করণসহ ক্ষতিকর অনেক কিছুর ছায়া বিস্তৃত হয়ে পড়েছিল, এর অপসারণ জরুরি। আমরা চাইব, এবার যারা এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চশিক্ষার প্রবেশদ্বারে পা রেখেছে, তাদের ভবিষ্যতের সেই পথচলা যাতে সুগম হয় সেই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, এইচএসসি উত্তীর্ণ হওয়ার পর অনেকের পক্ষে আর এগোনো সম্ভব হয় না। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এর জন্য অনেকটাই দায়ী বটে, তবে শিক্ষাব্যবস্থার গলদও কম দায়ী নয়। আমরা বিশ্বাস করি, ব্যবস্থা ভালো হলে অবস্থা এমনিতেই ভালো হতে বাধ্য। কলুষতার ছায়া যেন শিক্ষা ক্ষেত্রে না থাকে, এই হোক অঙ্গীকার। পরবর্তী ধাপে মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে যাতে কোনো প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে না হয়, তাও নিশ্চিত করতে হবে। কর্মমুখী শিক্ষার দিগন্ত প্রসারিত করার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সব ধরনের শিক্ষা লাভের পথ মসৃণ করার বিকল্প নেই।