লেবানন-ইসরায়েল সংঘাত
স্টিভেন হাওয়ার্ড
প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:২২ এএম
স্টিভেন হাওয়ার্ড
লেবাননে যুদ্ধ
বন্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে। দেশটিতে ইরান সমর্থিত সশস্ত্র ইসলামি
গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েল পূর্ণাঙ্গ সংঘাতে জড়িয়েছে। দেশটির দক্ষিণে একটানা
স্থল অভিযান চালাচ্ছে তারা। এই মুহূর্তে কূটনৈতিকভাবে তারা যদি দক্ষিণ সীমান্ত থেকে
হিজবুল্লাহকে সরিয়ে লেবানিজ আর্মড ফোর্স এবং যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সেনাদের বসাতে পারে,
তাহলে ইরানকে টেক্কা দিতে পারবে বলে ভাবছে। কিন্তু ইসরায়েল যদি একাধারে স্থল অভিযান
চালাতে থাকে, তাহলে যুদ্ধের মাত্রা বাড়তে থাকলে দেশটিতে শিগগিরই গৃহযুদ্ধ বাধবে। আর
এই গৃহযুদ্ধে হিজবুল্লাহ সবচেয়ে বেশি সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করবে।
চলতি বছর জাতিসংঘের
সাধারণ পরিষদের সাধারণ অধিবেশনে লেবাননে ইসরায়েলের অভিযানের বিষয়ে কূটনৈতিক নীতিমালা
অস্পষ্ট। অন্যদিকে চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও একাধিক সহযোগী রাষ্ট্র মিলে
ইসরায়েল এবং লেবাননের কাছে ২১ দিনের যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। এই প্রস্তাবটি
অনানুষ্ঠানিকভাবে হিজবুল্লাহর কাছেও পৌঁছেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
অবশ্য একাধিকবার প্রস্তাবনার বিরোধী কাজই করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে যুদ্ধবিরতির
প্রসঙ্গে কথা বলছে। অন্যদিকে লেবাননে স্থল অভিযান পরিচালনায়ও তারা হালকা ইঙ্গিত দিয়ে
রেখেছে। লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল্লাহ বউ হাবিব জানান, ইসরায়েলও জানে হিজবুল্লাহ
এই যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবনা মেনে নিতে রাজি হয়েছে। তার পরও তারা গোষ্ঠীটির প্রধান হাসান
নাসরুল্লাহকে হত্যা করেছে। তারা লেবাননে বিমান হামলা এবং স্থল হামলাও চালাচ্ছে।
ইতোমধ্যে এতটুকু
সত্য, এই যুদ্ধে ইসরায়েলের লাভের পাল্লা ভারী। ইসরায়েল একটি নিরাপদ সীমান্ত চেয়েছে।
তাদের চাওয়া এতটাই জরুরি যে, ৬০ হাজার ইসরায়েলি গৃহহীন হয়েছে। হিজবুল্লাহও পাল্টা হামলা
চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, এই সমস্যার একমাত্র সমাধান কূটনীতি। ইসরায়েল
লেবাননে গত পাঁচ দশকে পাঁচবার অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু তারা কখনই তাদের অভ্যন্তরীণ
নিরাপত্তা ঝুঁকির শঙ্কা দূর করতে পারেনি। তাদের সিকিউরিটি ফোর্স বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে।
এখন পরিস্থিতি এমন যে লেবাননের সঙ্গে কূটনৈতিক সমাধানের কোনো পথই খোলা নেই। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের
জন্য মাথাভারী ভূরাজনৈতিক সমস্যা বাড়তে শুরু করেছে। ইসরায়েল যতই হিজবুল্লাহকে নির্মূলের
জন্য লেবাননের ভেতরে যাবে, পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলোও নিজেদের স্বার্থরক্ষায় ততো বেশি
সচেতন হতে শুরু করবে। তখন দেখা যাবে এই যুদ্ধের পরিধি আরও বাড়তে শুরু করছে। বিশেষত
এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে এখন পূর্ণাঙ্গ সংঘাত যদি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেয়, তাহলে ইরান
কোন পক্ষে সমর্থন দেবে তা জানা কথা। আর এমনটি হলে সমস্যা আরও ভারী এবং ব্যপ্ত হয়ে উঠবে।
লেবাননে এই মুহূর্তে
কূটনৈতিক প্রক্রিয়া কার্যকর করার জন্য যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ যুদ্ধবিরতি
হলে আলোচনার সুযোগ বাড়ে। যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত লেবানিজ আর্মড ফোর্সকে সীমান্ত এলাকায়
কার্যকর করতে হবে। তার পর আস্তে আস্তে লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত
করার সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে একে একে সমাধান করা সম্ভব। মূলত সীমান্তবর্তী অঞ্চলের
মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এখন প্রথম গুরুত্বপুর্ণ অনুষঙ্গ। তাদের পুনর্বাসন
করতে হবে। যদি তা করা যায় তাহলে আগামী প্রজন্মের জন্য অন্তত একটি ভালো বার্তা থাকবে।
মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের মধ্যে বেড়ে ওঠা শিশুদের মনের ওপর গভীর রেখাপাত করেছে। মধ্যস্থতাকারী
হিসেবে এগুলোও ভাবতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকেই। কিন্তু ইসরায়েল যেভাবে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে
এবং তাদের নির্ধারিত লক্ষ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে যা থেকে স্পস্ট তাদের কোনো সময়জ্ঞান
নেই। এমনকি এই অভিযানের লক্ষ্য আদায়ের কোনো পরিকল্পনাও নেই। তারা শুধু যা ইচ্ছে তা-ই
করছে।
আপাতত মনে হচ্ছে
লেবাননে ইসরায়েলের এই হামলা তাদের ওপরই ফিরে আসতে পারে। তাদের নির্বিচার হামলায় অনেক
বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যাই বেশি। লেবাননে বাস্তুচ্যুতদের
জন্য অভিবাসী সমস্যাও বাড়বে। আর এতে করে তাদের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি ক্ষোভও বাড়বে।
বিশেষত তরুণরা হিজবুল্লাহ কিংবা অন্য কোনো সংস্থায় যোগ দেবেন। ১৯৮২ সালে লেবাননে ইসরায়েলি
অভিযানের পর থেকেই হিজবুল্লাহর ইতিহাস শুরু। তারা নিজেদের লেবাননের রক্ষাকারী বিবেচনা
করে। ইসরায়েলের স্থল অভিযান এই সংগঠনকে তাই বাড়তি প্রণোদনা দিচ্ছে। আর এমন সময় হিজবুল্লাহর
মাথা কাটতে গিয়ে আরও বড় সমস্যা তৈরি হতে পারে, তা সংগঠনটির বিস্তৃতি বাড়াতে পারে। সংস্থাটির
কাঠামোর মধ্যেও বদল চলে আসতে পারে। ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধে এই
সংস্থাটি ব্যাপক সমর্থন আদায় করে। ওই সময়ের পর থেকেই দেশটির সরকার কাঠামোতেও ওদের প্রভাব
অনেক বাড়ে। এই মুহূর্তে সংগঠনটি কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাদের নিশানা করে অভিযান
চালানোয় সংস্থাটির মূল কাঠামো একটু পিছিয়ে আছে। তারা লেবাননের বাইরে থেকেই হয়তো কাজ
চালিয়ে যাচ্ছে। এর আগে একবার লেবাননের বাইরে সংস্থাটি ব্যাপক গুপ্তহত্যা চালিয়েছে।
এক্ষেত্রে হিজবুল্লাহ আবার পুরোনো পথে ফিরে যেতে পারে। আর তাতে করে লেবাননে অবস্থানরত
দুষ্কৃতকারী কোনো রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গেও আঁতাত করতে পারে। অর্থাৎ ইসরায়েলের ওপর আরও
ভয়াবহ হামলা হতে পারে। আর যুক্তরাষ্ট্রকে এক্ষেত্রে বড় কোনো কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়তেই
হবে। তাদের যুদ্ধবিরতির প্রসঙ্গে বোঝাতে হবে, জানাতে হবে।
ইসরায়েলের অভিযানে
লেবানন অনেকাংশে স্থবির হয়ে পড়বে। গত বছর ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের আগেও লেবানন একটি দুর্বল
রাষ্ট্র ছিল। আর দুর্বল হওয়ায় ভূরাজনৈতিক প্রভাবে দেশটির অভ্যন্তরে রাজনৈতিক শক্তি
একটি বিচ্ছিন্নতার মধ্যে চলে এসেছে। দেশটিতে মানবিক সংকট যেমন বেড়েছে, তেমনি ১০ লাখ
মানুষ বাস্ত্যুচ্যুত এখন। আর তারা দেশের বাইরে চলে যায়নি। অভ্যন্তরেই আছে। তাই দেশটির
সামাজিক পরিস্থিতিও অনেক সংকটের মধ্যে। যদি এই অভিযান ও সংঘাত জিইয়ে থাকে, তাহলে দেশটির
ভেতর সামাজিক অস্থিরতা বাড়তেই থাকবে। এই অস্থিরতার সুযোগ নেওয়ার জন্য অনেক পক্ষই সেখানে
রয়েছে। আর যদি এমনটি হয় আঞ্চলিক মধ্যস্থতাকারী যুক্তরাষ্ট্র কঠিন সমস্যার মধ্যে পড়বে।
দ্বিতীয় সমস্যা,
ইসরায়েলের অভিযানে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা প্রবল। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই
কূটনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের পক্ষে। তারা ইরান কিংবা তাদের মদদ দেওয়া সশস্ত্র সংগঠনগুলোর
সঙ্গে লড়াইয়ে যেতে রাজি নয়। ইসরায়েল বারবার সংঘাত উস্কে দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে
ইসরায়েলের সামরিক সমঝোতার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। হিজবুল্লাহ এক প্রকার অথর্ব
হলেও তারা ইরানের অক্ষশক্তি। ইরানও এই মুহূর্তে কঠিন ভাষায় জবাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
ইসরায়েলের কৌশল এবং ইরানকে বারবার উস্কে দেওয়ার বিষয়টি দেখে মনে হচ্ছে তারা আসলে বড়
সংঘাতই প্রত্যাশা করছে। এজন্যই যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক থাকতে হচ্ছে। কারণ ইরান হয়তো
তাদের অবস্থান বা কৌশলে বদল আনতে পারে। তারা ইসরায়েলের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে নেমে
যেতে পারে। আর এমনটি হলে সোজাসুজি পথ নেই বের হওয়ার।
যাহোক, এত সমস্যার
মধ্যেও সময় হারায়নি। হিজবুল্লাহর ডেপুটি চিফ নাসিম কাশিম যুদ্ধবিরতির প্রসঙ্গে একমত।
তারা গাজায় একটি শান্তি সমঝোতা হলে কোনো অস্থিতিশীলতায় যাবে না। তাই গাজায় শান্তি স্থাপন
করতে হলে গাজাকে গুরুত্ব দিতে হবে। আর এমনটি হলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপন করা যাবে।
আর হিজবুল্লাহ এজন্য অভ্যন্তরীণভাবে সক্রিয় নানা কার্যক্রম ও পরিকল্পনা করছে। তাদের
অভিযান বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হলে আরও ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। হিজবুল্লাহ এখন
আসলে সম্মুখ সমরে বড় ঝুঁকি বহন করে না। তারা বরং সংঘাত বন্ধের জন্যই বরাবর কথা বলছে।
এক্ষেত্রে গাজা ইস্যুকেও তারা এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে। তার মানে এই নয় যে, এখন চাইলেই আসলে
হিজবুল্লাহকে নির্মূল করা যাবে। ইসরায়েল সম্ভবত তেমনটি ভেবেই অভিযান চালাচ্ছে। আর এর
ফল কত ভয়াবহ হতে পারে তা বলে দিতে হবে না।
যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক মধ্যস্থতাকারী। তাদের জন্য এখন আর অন্য পথ খোলা নেই। লেবানন ও হিজবুল্লাহর মধ্যে যুদ্ধবিরতি সম্মতি আদায় করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। আর এভাবেই উন্মুক্ত হবে কূটনৈতিক মঞ্চ। দীর্ঘদিন মধ্যপ্রাচ্যে এই কূটনৈতিক মঞ্চই দরকার বলে আশা করা হচ্ছে। আর যাতে প্রধান বাধা ইসরায়েল। তবে অনাগত ভবিষ্যতকে বিবেচনায় রেখেই আসলে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় সমস্যা সমাধানে এগোতে হবে। আরব রাষ্ট্রগুলোও সেদিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রকেই মাথাভারী অবস্থা থেকে বের হতে হবে। যদি তারা ব্যর্থ হয় তাহলে বড় শক্তি হিসেবে বড় ক্ষতি হওয়ারও আশঙ্কা রয়ে গেছে। সংঘাত বাস্তবে কিছু এনে দেবে না।
পরিচালক, পলিসি অ্যান্ড আউটরিচ, লেবাননে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের টাস্কফোর্স অফিস
ফেয়ার অবজার্ভার থেকে অনুবাদ : আমিরুল আবেদিন