× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রাষ্ট্রব্যবস্থা

জনগণের মালিকানা নিশ্চিত করতে হবে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:০৭ এএম

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

শাসনক্ষমতার ব্যাপারে পাকিস্তানের বেলায় যেটা ঘটেছিল, বাংলাদেশের বেলায়ও কিন্তু সেটাই ঘটেছিল। ক্ষমতা চলে যায় বুর্জোয়াদের হাতে। কারণ স্বাধীনতার পর রাষ্ট্র আয়তনে ছোট হলো ঠিকই, চেহারায়ও বদলাল, কিন্তু চরিত্রে বদলাল না। সমাজবিপ্লব ঘটল না। আমাদের এ রাষ্ট্রে অনেক কিছুই বেশ ভালো রকমেরই মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু সর্বাধিক মুক্তি প্রাপ্তি যার ঘটেছে তার নাম পুঁজিবাদ। বুর্জোয়ারা পুঁজিবাদী শোষণ-শাসনই চায়। পাকিস্তানি বুর্জোয়ারা চেয়েছে, বাংলাদেশি বুর্জোয়ারাও সেটাই চাইছে। এতে তাদের সুবিধা। পুঁজিবাদ তাই দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে।

এটা অবশ্য কেবল যে বাংলাদেশের ব্যাপারেই সত্য এমন নয়। সারা বিশ্বেই এখন পুঁজিবাদের অপ্রতিহত দুঃশাসন চলছে। পুঁজিবাদীরা সাম্রাজ্যবাদী হবে এটা অনিবার্য। সেটা তারা হয়েছেও। বাঘ কি তার মুখের দাঁত ও গায়ের দাগ বদলে ফেলে দিতে পারে? আধুনিক কালে বিশ্বে যে দুটি প্রলয়ংকর যুদ্ধ ঘটেছে তার আসল কারণ তো পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীদের ভেতর আধিপত্য নিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদ। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও অশনিসংকেত শুনতে পাওয়া যাচ্ছে; তবে তা এখনো ঘটেনি যে তার কারণ দ্বন্দ্বের মীমাংসা নয়, কারণ হচ্ছে বিবদমান দুই পক্ষের উভয়ের হাতেই ভয়ংকর ভয়ংকর সব মারণাস্ত্রের প্রাচুর্য। তবে স্থানীয় যুদ্ধ তো চলছেই। রাশিয়া যে ইউক্রেন আক্রমণ করেছে সেটা তো পুঁজিবাদী দুই বড় শক্তির লড়াই ছাড়া অন্য কিছু নয়। রাশিয়া বিলক্ষণ জানে কার বিরুদ্ধে লড়ছে, আমেরিকাও তালে আছে এ সুযোগে রাশিয়াকে সিজিল করবার।

পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার পুতিনকে বলছে নব্য-হিটলার। সেই অভিধা মিথ্যা নয়; তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও যে কম যান না সেটা অমান্য করবে কে? ব্যবধানটা গুণের নয়, পরিমাণেরই। তবে পুঁজিবাদীরা নিজেদের সরাসরি পুঁজিবাদী বলতে চান না, বয়স যদিও নিতান্ত কম হয়নি, তবু লুকোচুরি খেলেন। তাদের দ্বারা প্রভাবিত গবেষক ও বুদ্ধিজীবীরাও নিজেদের লেখায় পুঁজিবাদ পর্যন্ত না গিয়ে করপোরেট পুঁজি, বাজার অর্থনীতি, বিশ্বায়ন ইত্যাদি পর্যন্ত পৌঁছে থেমে যান। জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন বিশ্ব যে এখন ধ্বংসের একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে সেটা বললেও, এর জন্য দায়ী যে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা ভিন্ন অন্য কিছু নয় সেই মোটা কথাটা বলতে সংকোচ বোধ করেন। তবে আবরণে যে আর কুলাবে না, দানবটি এতটাই স্থূল, বৃহৎ ও জুলুমবাজ হয়ে পড়েছে যে তাকে ভদ্র গোছের অন্য কোনো নামে ডাকবার সুযোগ যে আর নেই সেই সত্যটি এখন সামনেই চলে এসেছে। পুঁজিবাদই যে দৌরাত্ম্য চালাচ্ছে এবং মানুষ, প্রকৃতি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য সবকিছুরই যে সে এখন মূল শত্রু সেই সত্যটা সম্পূর্ণ উন্মোচিত হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশেও তো দেখতে পাচ্ছি ওই একই ঘটনা। মুক্ত পুঁজিবাদের দুঃশাসন এখানেও দেখেছি। মানুষ এখন সবকিছুর আগে টাকা বোঝে ও চেনে এবং টাকার জন্য হন্যে হয়ে সম্ভব-অসম্ভব সবকিছুতে হাত দেয়। ধরা যাক কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া নড়াইলের ঘটনাটা; ফালতু একটা অজুহাত খাড়া করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া ও সম্পত্তি লুণ্ঠন করার যে কাণ্ডটি ঘটেছিল, সেখানে আওয়াজটা ধর্মীয় ছিল ঠিকই, কিন্তু ভেতরের নির্দয় চালিকাশক্তিটা ছিল অর্থলোলুপতা। হামলাকারীরা বলেছে টাকা দে, নইলে মারা পড়বি। সোজাসাপটা বক্তব্য। যারা টাকা দিতে পেরেছে তারা ছাড়া পেয়েছে, যারা পারেনি তাদের বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ ঘটেছে। নগদ টাকাপয়সা যা পেয়েছে নিয়ে নিয়েছে, স্বর্ণালংকারও বাদ পড়েনি। সাম্প্রদায়িক আওয়াজটা ছিল মুখোশ, ভেতরের মুখটা লোলুপতার। কেউ নগদ চেয়েছে, অন্যরা, যারা কিছুটা গভীরের, তারা আশায় আশায় আছে হিন্দু পরিবারগুলো কখন দেশ ছেড়ে চলে যায়। চলে গেলে তারা দখলে নেবে ওদের ভিটেমাটি, দোকানপাট, জমিজমা। রাতের অন্ধকারে হিন্দুদের ঘরবাড়িতে দেওয়া আগুন যতটা না উজ্জ্বল ছিল তার চেয়ে অধিক লেলিহান ছিল লুণ্ঠনের লিপ্সা।

আপাতবিবেচনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের একটা ঘটনা ঘটেছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। সন্ধ্যার পর একজন ছাত্রী ক্যাম্পাসে পায়চারি করছিলেন। ভেবেছিলেন সবচেয়ে নিরাপদ এলাকায় আছেন। কিন্তু তার ধারণা ছিল ভ্রান্ত। অন্ধকারে একা পেয়ে দুজন ছাত্র তার ওপর চড়াও হন; তারা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। মোটরসাইকেলে চেপে আবির্ভূত হন। নড়াইলের দুর্বৃত্তদের মতো তাদেরও ছিল ওই একই দাবি। টাকা দে। ছাত্রীটির কাছে টাকা ছিল না; দিতে পারেনি। তার মোবাইল তো কেড়ে নিয়েছেই; টাকা কেন দিতে পারেনি, কেন বঞ্চিত করল এ অপরাধে তাকে নির্যাতন করার জন্য মোটরসাইকেলওয়ালা দুজন ছাত্র আরও তিনজন সহযোদ্ধাকে ডেকে এনেছিল। তারপর সবাই মিলে মেয়েটিকে হেনস্থা করেছে এবং দুর্দশাপীড়িত অবস্থায় তার ছবি তুলেছে মোবাইলে, হুমকি দিয়েছিল ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার, ইন্টারনেটে। ছাত্রীটি অবশ্য দমে যাননি। নিজের আবাসিক হলে গিয়ে অন্য মেয়েদের জানিয়েছে তার লাঞ্ছনার কথা। শুনে মধ্যরাতেই ক্যাম্পাসে বসবাসকারী সব ছাত্রী বেরিয়ে এসেছিল। তারা ঘেরাও করেছিল উপাচার্য ও প্রক্টরের বাসগৃহ। মিডিয়া সে খবর প্রচার করায় গড়িমসি করে হলেও অপরাধী বলে চিহ্নিত পাঁচজনকে শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বলাবাহুল্য অভিযুক্তরা সবাই ছিল একই ছাত্র সংগঠনের সদস্য। সেই ছাত্রসংগঠনটি ছিল ছাত্রলীগ। এছাড়া সে সময়ে আর কার অত বুকের পাটা হবে? ঘটনাটি বিগত সরকারের পতনের কিছুদিন আগের।

ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের পক্ষে যারা বলেন তারা মনে হয় জানেন না যে, ছাত্র রাজনীতি নেই বলেই সরকারি দলের সমর্থক সেজে ছাত্ররা এ রকমের দুর্বৃত্তপনা চালানোর সুযোগ পেয়েছিল। পাকিস্তান আমলেও এরা ছিল। তখন এদের নাম ছিল এনএসএফ। পাকিস্তান চলে গেছে, কিন্তু এরা ঠিকই ভিন্ন ভিন্ন নামে রয়ে গেছে। কারণ রাষ্ট্র বদলেছে ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্রের অন্তর্গত চরিত্রটা বদলায়নি। কিছুটা উন্নতি ঘটেছে এটা খুবই সত্য; তবে সেটা ওই পুঁজিবাদী লাইনেই। এনএসএফের গুন্ডারা সাপ ও ছুরি দেখাত, এমনকি অধ্যাপককে লাঞ্ছিত করতেও দ্বিধা করেনি, তবে অগ্রসর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তৎপরতা চালালেও তাদের কায়দাটা ছিল অনেকটা সামন্তবাদী; এখন সামন্তবাদ নেই, পুঁজিবাদ এসে গেছে। এখনকার এনএসএফ তাই সবকিছুর আগে টাকা খোঁজে। চাঁদা তোলে, ভাড়া তোলে, সহপাঠীদের কাছেও টাকা দাবি করে ছিনতাইয়ে নামে। দলের নেতারা ক্ষমতা যতটা না চেনেন তার চেয়ে বেশি চেনেন টাকা এবং জানেন যে ক্ষমতার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ঘটে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে। পাড়ামহল্লার দুর্বৃত্তদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরও তাই প্রায়শই কোনো পার্থক্য থাকে না, একাকার হয়ে যায়।

একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় যে সমাজ এখন আর সমাজের হাতে নেই, রাষ্ট্রের হাতে চলে গেছে। কথাটা যে অসত্য তা নয়। রাষ্ট্রই তো প্রধান। রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা আছে; তার আছে বাহিনী, আছে তার আইন-আদালত। দিনকে রাত করে দিতে পারে, রাতকে দিন। কিন্তু একালে রাষ্ট্র ও সমাজকে বিচ্ছিন্ন করাটা কি আদৌ সম্ভব? না, সম্ভব নয়। ওই চেষ্টাটা আমরা ব্রিটিশ যুগে করতাম; আমাদের মনীষীরা আমাদের শেখাতেন যে রাষ্ট্র তো আসবে যাবে, ভাঙবে গড়বে, কিন্তু সমাজ রয়ে যাবে প্রবহমান। রাষ্ট্র বহিরাগতদের হতে পারে, সমাজ তো আমাদেরই। কিন্তু সমাজ যে রাষ্ট্রের অধীনে চলে যায়, অর্থাৎ বাধ্য হয় চলে যেতে, তার কী হবে? আর রাষ্ট্রের শাসকদের আদর্শই যে সমাজের ওপর নাজিল হয়ে থাকে, তারই বা প্রতিকার কী? রাষ্ট্রকে বৈরী হিসেবে দেখাটা বেঠিক নয়; ঠিকই আছে, কিন্তু তাকে বদলাবার দায়টা কিন্তু সমাজেরই, অর্থাৎ সমাজের অগ্রসর মানুষদেরই। মুশকিল হলো ওই অগ্রসর মানুষদের এখন খুঁজে পাওয়াটা ভার হয়েছে। পুঁজিবাদ তাদের চেনে, সম্ভাব্য শত্রু হিসেবে জানে এবং দমন করতে চায়। দমন করার কাজে রাষ্ট্রের বিশেষ রকমের অস্ত্র হচ্ছে দুটিÑভীতি ও প্রলোভন।

রাষ্ট্র ভয় দেখায়, শাস্তি দেবে বলে জানায়, শাস্তি দিতে কসুরও করে না। এ ব্যাপারে সদাজাগ্রতই থাকে। রাষ্ট্র আবার প্রলোভনও দেখায়, পুরস্কার দেবে বলে। দেয়ও। অগ্রসর মানুষেরা নত হয়ে পড়েÑভীতিতে এবং প্রলোভনে। ভীতি প্রদর্শন ও পুরস্কার প্রদানের জন্য আবশ্যক টাকাটা রাষ্ট্র কিন্তু নিজে উৎপাদন করে না, সে ক্ষমতা তার নেই; টাকা আসে লুণ্ঠন থেকে। লুণ্ঠনের টাকা আবার জনগণের শ্রমে ও ঘামেই উৎপাদিত হয়। জনগণের অর্থ লুণ্ঠন করে ব্যবহার করা হয় জনগণকে তো বটেই, জনগণের পক্ষে বলবার সম্ভাব্য শক্তিকেও দমনের জন্য। এমনটা আগেও ঘটেছে, এখনও ঘটছে, হয়তো আগামীতেও ঘটবে। ক্রমাগত তৎপরতাটা হয়তোই বৃদ্ধিই পাবে, কেননা জনগণের চাপ অব্যাহত না থাকলে ক্ষমতার হাতবদল হলেও রাষ্ট্রবদলের সম্ভাবনা দেখা যাবে না। তাই রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা নিশ্চিত করতেই হবে।

  • ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা