দুর্গোৎসব
ড. সৌমিত্র শেখর
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:০৪ এএম
ড. সৌমিত্র শেখর
বৃহৎ বঙ্গীয় জনপদে
বসবাসরত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে শারদীয় দুর্গোৎসব দীর্ঘদিন ধরেই উদযাপিত হয়ে আসছে।
উপমহাদেশের যেসব স্থানে বাঙালিদের বাস, সেখানেই শারদীয় দুর্গোৎসবের আয়োজন হয়ে থাকে।
বেশ ঘটা করেই এই সর্বজনীন উৎসব উদযাপন করা হয়। আজ বিশ্বায়নের যুগে বাঙালিরা বিশ্বের
নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় এই উৎসবটি এখন ইউরোপ, আমেরিকাসহ অনেক দেশে সাংস্কৃতিক
ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে উদযাপিত হয়। এর আয়োজনে থাকেন বাঙালিরা এবং বিশ্ববাসীরাও আমাদের
এই সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পুজোর
সময়ের আবহ একসময় ব্যাপক প্রচলিত ছিল। দুর্গোৎসবের সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গটুকু বাদ দিলে
অন্তত আমরা এই আয়োজনকে সর্বজনীন সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবেই দেখতে পাই। আজকের দিনেও তার
ব্যত্যয় ঘটেনি। পূজা-অর্চনার অংশটুকু ধর্মনিবেদিতপ্রাণ সনাতনী ভক্তরা পালন করেন। কিন্তু
পূজার সঙ্গে সম্পৃক্ত আয়োজন, উদযাপন এবং অনেক কিছুর সঙ্গে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার
সমান অংশগ্রহণ দেখা যায়।
ঐতিহাসিক কারণে
বাঙালির ভৌগোলিক বাস্তবতা ভিন্ন। রাজনৈতিক কারণে দুটো দেশ সৃষ্টি হওয়ার আগেই বাংলা
দুভাগ হয়ে যায়। ভারতের অন্তর্ভুক্ত পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় আমরা বাঙালি দেখতে
পাই। বাঙালিদের একটি বড় অংশ সনাতন ধর্মাবলম্বী। কিন্তু ভৌগোলিক বাস্তবতা এবং রাজনৈতিক
কারণে বাঙালি আজ নানা কারণে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আর এজন্যই অঞ্চলভেদে দুর্গোৎসবে অংশগ্রহণের
ক্ষেত্রে মাত্রাফের লক্ষ্য করা যায়। অনেক স্থানে মতপার্থক্যের ভিত্তিতে কিছু সংকটও
থাকে। কিন্তু দুর্গোৎসবের যে মূল চেতনা, ঐক্য এবং শান্তির বার্তা পৌঁছে দেওয়া তার মধ্যে
কোনো বিচ্যুতি আজও ঘটেনি। সম্প্রীতি, ঐক্য ও সহমর্মিতাÑ এই তিনটি প্রতিপাদ্যই শারদীয়
দুর্গোৎসবের মূল চেতনা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যাতে এই উৎসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত
হতে পারে; সে বিষয়টিকে এই উৎসব অনেক আগে থেকেই জোর দিয়ে আসছে। মূলত এই সামগ্রিক চেতনার
সঙ্গেই যেন সবাই একত্রিত হতে পারে, সেজন্য দেবীকে আরাধনা করা হয় এবং তার কাছে এই চেতনার
প্রতিফলন ঘটানোর সামর্থ্য পাওয়ার আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হয়। দশভুজা দুর্গা তার ভক্তদের
মঙ্গলার্থে বর দান করেন।
বাঙালিদের সংস্কৃতির
বাইরেও দুর্গাপূজার ভিন্ন একটি রূপ রয়েছে। অবাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও এই পুজো-অর্চনার
আয়োজন করে থাকে। তারা এটিকে নবরাত্রি বলে দাবি করে থাকেন। মূলত মহালয়া থেকে নবরাত্রি
উদযাপন শুরু করা হয়। দশমীর দিন তারা দশেরা উদযাপন করে থাকেন। বাঙালির দুর্গোৎসব এবং
অবাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আয়োজনের মধ্যে চেতনাগত এক ধরনের পার্থক্য রয়েছে। অথচ
ধর্মীয় এই আয়োজনের মূল দিনক্ষণ, আয়োজনের ধরনও অনেকটা এক। কিন্তু চেতনাগত পার্থক্যটির
কারণে দুই ক্ষেত্রে আলাদা ধারণা মেলে। বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দুর্গোৎসব উৎসবমুখরভাবে
উদযাপন করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নানা উপাচার এবং এই উপাচারকে কেন্দ্র করেই উৎসব এগিয়ে
চলে। বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার এখানে ব্যাপকহারে লক্ষণীয়। বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি
প্রবলভাবে ফুটে ওঠে। এমনকি আনন্দযাত্রার আয়োজনও হয়ে থাকে। দশেরার ক্ষেত্রে আমরা এদিকটি
দেখতে পাই না। দশেরা অবাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আত্মনিষ্ঠতার সঙ্গে উদযাপন করেন।
এক্ষেত্রে তাদের নানা ব্রত উদযাপন করতে দেখা যায়। অর্থাৎ তারা এই উৎসবের ক্ষেত্রে এক
ধরনের গুরুগাম্ভীর্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন। অনেকে পুজোর অংশ হিসেবে ধ্যানও করেন।
টানা নয় দিন, নয় রাত একটানা ব্রতপালন, ধ্যান ও উপাসনার মাধ্যমে তারা আধ্যাত্মিক একটি
মাত্রা যুক্ত করেন। অবাঙালি সনাতনী ধর্মাবলম্বীরা নবরাত্রির দিন মূলত উৎসবের উৎসাহে
এগিয়ে আসেন। এখানেই মূলত চেতনাগত পার্থক্য। বাঙালি সনাতনী ধর্মাবলম্বীরা উৎসবের উৎসাহে
গোটা নয় দিন দুর্গোৎসবকে মাতিয়ে রাখে। সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে এবং তার সঙ্গে সৌহার্দ্য,
সম্প্রীতি এবং সহমর্মিতা ছড়িয়ে থাকে। এই উৎসবে সবাই যুক্ত হন এবং এজন্যই দুর্গোৎসব
আমাদের একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও হয়ে উঠেছে। কিন্তু অবাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে
এটি একটি ব্রত বা উপাসনার সময়। এই সময়টিকে তারা অভ্যন্তরীণভাবে পালনে একটি ধর্মীয় উপলক্ষ
হিসেবে বিবেচনা করে আয়োজন সাজিয়ে থাকে। ব্রত শেষে তারাও উদযাপন করে, তবে তার সাংস্কৃতিক
তীব্রতা বাঙালি দুর্গোৎসবের মতো হয় না।
ব্রিটিশ আমল থেকেই
বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা জাঁকজমকপূর্ণভাবে দুর্গাপূজার আয়োজন করে আসছে। ঐতিহাসিকভাবে
বাঙালির জন্য এটি একটি সাংস্কৃতিক রীতিতে পরিণত হয়। এর আগেও দুর্গোৎসব হতো, কিন্তু
সর্বজনীনভাবে দুর্গোৎসবের সাংস্কৃতিক পুনর্বাসন মূলত ব্রিটিশ আমল থেকে পাওয়া যায়। এর
আগে দুর্গোৎসবের সাংস্কৃতিক রীতি, প্রথা বা চেতনার বাণী কোনো ঐতিহাসিক গ্রন্থ কিংবা
পুঁথিতে পাওয়া যায় না। যদিও ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে আমাদের এই শূন্যতার কথা নীহাররঞ্জন
রায় তার ‘বাঙালির ইতিকথা’ বইটিতে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছেন। বাঙালিরা শরৎকালে দুর্গাকে
স্বাগত জানায়। শরতে বাংলা এক নতুন রূপ নেয়। আর এই ঋতুর আবহের কারণে দুর্গোৎসব এক আলাদা
রূপ পায়। এজন্যই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেনÑ ‘আজি এ
শারদ সাঁঝে/ ঐ শোনো দূরে পল্লী-মুখর কাঁসর, ঘণ্টা বাজে।/ দিনমণি
যায়Ñ ‘বিদায় বিদায়’/
বিহগ-কণ্ঠে দিশি দিশি ধায়/ উদ্দাম বেগে, মরম
আবেগে, মত্ত তটিনী চলিছে;/
ধীরে ধীরে তীরে তীরে, শ্লথ মন্থর বীচিমালা ফিরে/ গাহিয়া
সবারি কাছে।’ রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ও দুর্গোৎসবের ওই চেতনার মরম আবেগের বাণী
প্রতিফলিত হয়। আবার দুর্গোৎসবে এই উৎসবের আমেজের ক্ষেত্রে বাঙালির ঐক্যবদ্ধ জীবন, গ্রামীণ
ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক চেতনার সম্মিলনটিও ব্যাপক গুরুত্ব ধারণ করে। দুর্গোৎসবে বাঙালির
এই যৌথ পরিবারের ধারণাটি ফিরে ফিরে আসে। অন্তত এই উপলক্ষে পরিবারের সবাই একত্রিত হতে
পারে। সবাই সবার সঙ্গে উৎসবে মাতোয়ারা, দুর্গার সামনে গোটা পরিবারের সবার আশীর্বাদ
কামনায় পারিবারিক ইতিবাচকতার কামনা থাকে। পশ্চিমা বিশ্বে বাঙালির এই একাত্মতা এখন প্রশংসিত
হচ্ছে এবং সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের ক্ষেত্রেও বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রধান দেবী দুর্গার
দুই কন্যা লক্ষ্মী-সরস্বতী, দুই পুত্র কার্তিশ ও গণেশ এবং দুর্গার স্বামী দেবাদিদেব
মহাদেব। একটি সম্পূর্ণ পরিবার দেবী দুর্গার। বাঙালির উৎসবেও এই পরিবারিক আবহটুকু থাকে।
কারণ বাঙালি গার্হস্থ্য জীবনের একটি পরিপূর্ণ রূপ দেবী দুর্গার পরিবারেই রয়েছে।
বাঙালি জীবনের যৌথ পরিবারের একাত্মতা আজ বিশ্বায়নের যুগে ভেঙে পড়েছে। পরিবার এখন
অনেক ক্ষুদ্রতম একক। বিচ্ছিন্ন হতে হতে মানুষ এখন তার পরিবার থেকে অনেক দূরে সরে আসছেন।
ফলে বিষণ্নতা, একাকিত্ব ও মানসিক সংকট তাদের ওপর তীব্রভাবে ভর করে। অথচ বাঙালি যৌথ
জীবনের প্রকৃত আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অনেকেই। দুর্গোৎসবে সেই আনন্দকে পুনর্মূল্যায়নের
সুযোগ করে নেওয়া যায়। কারণ এই উৎসবে আবার সেই আবহ তৈরি হয়। দুর্গাপুজোর মণ্ডপ থেকে
শুরু করে বাঙালি সব আয়োজনে এমন কিছু উপাদান আছে, যা সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালিকে সেই
যৌথ জীবনে আবার আবদ্ধ হতে উৎসাহিত করে। আর যৌথ পরিবার নাগরিক বাস্তবতায় নিশ্চিত করা
সম্ভব না হলেও অন্তত তাদের সেই সংযোগ-যোগাযোগ বাড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত হয়। এজন্য দুর্গোপুজো
আত্মীয়তার মর্মকথার গাঁথুনি। জাতীয়তাবাদী সংযোগ ও একাত্মতা গোটা বিশ্বেই আজ উবে গেছে।
কিন্তু প্রাচ্যে সামগ্রিক একতার বাণী এখনও টিকে রয়েছে। দুর্গাপূজার এই চেতনাকে তাই
আমাদের বিবেচনা করে দেখা জরুরি। এর যে বাণী ও সাংস্কৃতিক শক্তি রয়েছে তার ইতিবাচকতাকে
সবার মাঝে ছড়িয়ে বিভাজন দূর করার কাজটিও সচেতন সবাইকে করতে হবে। অন্তত যারা বিশ্বাস
করেন ধর্ম যার যার, উৎসব সবারÑ তারা সবাই চাইলে ধর্ম ও উৎসবকে আলাদা করে সাংস্কৃতিক
ঐক্য, সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতার বিষয়ে কাজ করতে পারেন।
শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালি জীবনের যৌথতাকে প্রতিষ্ঠিত করে। এই সমষ্টির মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা আমাদের সামনে উঠে আসে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় অংশটুকু বড় নয়, বরং সাংস্কৃতিক দিকটিই বড়। দুঃখজনক হলেও সত্য, মূলত রাজনৈতিক কারণে দুর্গোৎসবেও খণ্ডিত বিভাজন তৈরি হয়েছে। বিষয়টি সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প বলা হলেও এর পেছনে রাজনীতি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে দায়ী। কিন্তু উৎসবকে ঘিরে যে অস্থিতিশীলতা বা বিচ্ছিন্ন সংঘাতের ঘটনা ঘটে থাকে, তা বাহ্যিক এবং বাঙালি তা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিভিন্ন সময়ে অতিক্রম করে সৌহার্দ্যের পরিচয় দিয়েছে। দুর্গাপুজা আসলে বাঙালির পারিবারিক ঐক্য, সামাজিক একতা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সম্পর্কে এক শান্তির বার্তা দেওয়াই লক্ষ্য। তাই এই উৎসবকে সেই আঙ্গিকে দেখেই বিবেচনা করতে হবে। তাই হবে সবার জন্য মঙ্গল।