সাক্ষাৎকার
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবু তোহার কবিতায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের হৃদয়বিদারক ও প্রাণবন্ত বর্ণনা উঠে এসেছে। কবিতাগুলো বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। আগামী ১৫ অক্টোবর গাজা যুদ্ধের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে তার লেখা ‘ফরেস্ট অব দ্য নয়েজ’ নামে কাব্যগ্রন্থ বের হবে। এই এক বছরের অভিজ্ঞতার বিষয়ে সম্প্রতি আলজাজিরার সংবাদদাতা নিক হেলডেন জুমে মোসাব আবু তোহার একটি সাক্ষাৎকার নেন। সাক্ষাৎকারটির আংশিক অনুবাদ করেছেন আমিরুল আবেদিন
নিক হেলডেন : ‘আপনি যদি গাজায় বসবাস করেন, আপনাকে একাধিকবার মরতে হবে’Ñনিজের ‘ফরেস্ট অব
দ্য নয়েজ’ নামক কাব্য সংকলনে এভাবে শুরু করেছেন কেন?
আবু তোহা : এখানে আসলে অনেক ধাপ আছে। গাজায় যেকোনো সময় আপনি
বিমান হামলায় মরে যেতে পারেন। ভাগ্যই আপনাকে এখানে বাঁচিয়ে রাখবে। আপনার পরিবারের সবার
কি বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা আছে? এখানে বেঁচে থাকাই মৃত্যুর সমান। মরে না গেলেও আশাহত
হওয়াও তো মৃত্যুর শামিল। প্রতিটি রাতই আমাদের জন্য একটি নতুন জীবন।
এটি ভেবে আপনাকে ঘুমাতে যেতে হবে যে, সম্ভবত এবার আপনার ও আপনার পরিবারের মরার
পালা। এভাবে প্রতি রাতেই নিজেকে মৃতদের তালিকায় শামিল করে নিতে হবেÑ যা
বারবার মরে যাওয়ার সমতুল্য।
নিক হেলডেন : গত বছরের শেষ দিকে গাজা ছেড়ে সপরিবারে মিসর যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে
গেলেন। কেমন কাটছে জীবন?
আবু তোহা : এটাকে নতুন জীবন কীভাবে বলি। এই যে অনেক প্রিয় মানুষ এখনও গাজায় আছেন।
আমার মনে হচ্ছে তাদের মধ্যেই আমার একটা অংশ ফেলে এসেছি। আমার জন্য একটাই স্বস্তি যে,
আমার তিন সন্তান এখানে খেতে পাচ্ছে। গাজায় থাকলে শুধু পানির জন্য লাইনে দাঁড়াতে হতো
চার ঘণ্টা। এখনও আমার অন্য বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের করতে হচ্ছে।
এখানে (নিউইয়র্কে) আমি দোকানে যেতে পারছি এবং তাদের আইসক্রিম কিনে দিতে পারছিÑ এটিই
বিশেষ কিছু। এই যুদ্ধের ভয়াবহ প্রভাব আমার সন্তানদের মনে পড়েছে। আমার চার বছর বয়সি ছোট ছেলে জানে যুদ্ধ মানে কী। সে জানে যুদ্ধবিমান মানে
কী, বোমা মানে কী। বিমান হামলা, বিস্ফোরণ, ড্রোন কিংবা এফ-১৬ মানে
কী, তা-ও সে জানে। গাজার শিশুরা এখন আর আঁকাআঁকি, রং করা কিংবা বাইসাইকেল
চালানো শিখছে না। সুন্দরভাবে জীবনধারণ করা শিখছে নাÑতারা শিখছে বাঁচার জন্য লড়াই করতে।
নিক হেলডেন : গাজায় এই এক বছরের বাঁচার বর্ণনা আপনার নতুন কবিতায় আসছে। এ বিষয়ে
কী বলবেন?
আবু তোহা : একদিন গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলার সময় বোমা থেকে
বাঁচার জন্য আমার মেয়ে মরিয়া হয়ে ওঠে। ওই
সময় আমার ছয় বছর বয়সি ছেলে কম্বলকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে
বোনকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। বোনকে বাঁচাতে এ ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার।
ঘটনাটি ‘ফরেস্ট অব নয়েজ’ বইয়ের একটি কবিতায় উঠে এসেছে। গাজায় বেঁচে থাকার এ সংগ্রাম এবং সেই চেষ্টায় বারবার হেরে
যাওয়ার গল্প আমার কবিতার মূল প্রতিপাদ্য। ইসরায়েলি বিমান
হামলার পর ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে এক তরুণীর মৃত্যু হয়। নিজের বিছানাই পরিণত
হয় তার সমাধিতে। এ পর্যন্ত গাজায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শতসহস্র বাড়িঘর। বেশিরভাগ
সময় এসব বাড়িঘরের ভেতরে থাকা মানুষ ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ছেন। আর তা একেবারে সাধারণ
ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসরায়েলি বিমান হামলার সময় গাজার একজন বাসিন্দার উচিত, বোমা
বিস্ফোরণের সময় বাতি নেভানো থেকে শুরু করে জানালা থেকে দূরে থাকা, ব্যাগে
প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেওয়া,
বারান্দায় থাকা। তাদের উচিত ফুলের
টব থেকে এক মুঠো মাটি নেওয়া পর্যন্ত বাস্তব ও অবাস্তব সব ধরনের কাজের তালিকা করা।
ফিলিস্তিনে চলমান বাস্তুচ্যুতি এবং যার যার ভূখণ্ডকে আঁকড়ে রাখার প্রতীক এই মাটি।
নিক হেলডেন : সেই ২০১৪ সাল থেকে কবিতা লিখছেন। মুক্তছন্দে লিখতেন। এখন আপনার কবিতার
যাত্রা ও গাজার অবস্থাকে মিলিয়ে কী বলবেন?
আবু তোহা : তখনকার লেখাগুলোকে কবিতা বলতাম না। আমার পরিবারের
কেউ সাহিত্যিক ছিলেন না। আমি যা দেখেছি এবং যা অনুভব করেছি, তা-ই লিখেছি।
তাই প্রাতিষ্ঠানিক অনেক কিছুই আমার জানা ছিল না। আমি একটি
শরণার্থী শিবিরে জন্মেছি। মা-বাবাও শরণার্থী শিবিরে জন্মেছেন। দাদা-দাদিও তা-ই। আমি
শিকড় ভুলে যেতে পারি না। ২৭ বছর বয়স হওয়ার আগে পর্যন্ত কখনও গাজা ছেড়ে যাইনি। বাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে এবং ইসরায়েলি সেনারা একবার অপহরণ করেছে। ‘ফরেস্ট
অব নয়েজ’ বইয়ে ‘অন ইউর নি’ নামের একটি কবিতায় আমার অপহরণের
ভয়াবহ ঘটনা তুলে ধরেছি। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে গাজা থেকে
পালানোর সময় গত বছরের নভেম্বরে ইসরায়েলি সেনারা আমাকে বন্দুক দেখিয়ে নিয়ে যায়।
নিক হেলডেন : আটক হওয়ার সময়কার অভিজ্ঞতাটি যদি জানান।
আবু তোহা : আমি
ওদের একটা কথাই শুনেছি, ‘হাঁটু গেড়ে বসো। তারা
আমার মুখ ও পেটে লাথি মারে। পায়ে তীব্র
যন্ত্রণায় চিৎকার করার আগে পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টা হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে বাধ্য করা হয়।
তুলে নেওয়ার আগে হাতকড়া পরিয়ে চোখ বাঁধা হয়। জানতাম না যে, আমাকে ইসরায়েলে নিয়ে
যাওয়া হয়েছে। আর সেটি ছিল আমার জীবনে প্রথম ইসরায়েলে যাওয়া। আমি প্রায় ৫০ ঘণ্টা
পর ছাড়া পাই। এরপর আমার পরিবারকে খুঁজে বের করার জন্য বের হতে হয়।
নিক হেলডেন : গাজার জনজীবন সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে কী জানাতে চান?
আবু তোহা : আমি চাই, গাজার বাইরে জন্ম নেওয়া প্রত্যেকে কল্পনা করুক যে তারা ফিলিস্তিনে জন্ম নিলে
কেমন হতো; শরণার্থী শিবিরে জন্ম নিলে এবং দখলদারি ও অবরোধের মধ্যেই পুরোটা জীবন কাটিয়ে
দিতে কেমন লাগত।
সর্বশেষ ইসরায়েলি আগ্রাসনের এক বছর পূর্ণ হয়েছে ৭ অক্টোবর।
এ আগ্রাসন বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। তবে ফিলিস্তিনিদের ওপর গত
৭৫ বছর ধরে চলা নিপীড়নের ভোগান্তি এখনও আঁচ করতে পারেননি অনেকেই।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলা নিদারুণ এ যন্ত্রণার বর্ণনা আমার ‘ফরেস্ট অব নয়েজ’ বইয়ে আনার চেষ্টা করেছি। তুলে এনেছি আমার দাদা-দাদিদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনাও। একটি বিষয় আমার জন্য সত্যিকার
অর্থে যন্ত্রণাদায়ক;
যা বিশ্বের মানুষকে জানা উচিত। তা হলো আমরা যখন বেঁচে থাকি, তখন
আমাদের এ বিষয়টি বিশ্বের মানুষকে বোঝাতে লড়াই ও সংগ্রাম করতে হয়। সংগ্রাম কবতে হয়
এটা বোঝাতে যে, আমরা মানুষ,
আমাদেরও অস্তিত্ব আছে। আবার আমাদের যখন মেরে ফেলা হয়, তখনও
নিহত বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না আমাদের।