সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:২৫ এএম
মূল্যস্ফীতির টানা অভিঘাতে দেশের সাধারণ মানুষের ফিরে ফিরে নাভিশ্বাস
উঠছে। কখনও এই পণ্য, কখনও ওই পণ্যÑ এমনকি শাকসবজিতেও মূল্যস্ফীতির অভিঘাতের ছায়া বিস্তৃত।
ইতোমধ্যে পুষ্টির আধার হিসেবে বিবেচিত ডিম কিংবা আমিষজাতীয় পণ্যেও দফায় দফায় অভিঘাত
লাগছে এবং তা কতটা বিস্তৃত ফের এরই সাক্ষ্য বহন করছে ১১ অক্টোবর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ
প্রকাশিত প্রতিবেদনে। ‘পুষ্টির আধার ডিম, তবু জোটে না সবার পাতে’ শিরোনামে প্রকাশিত
প্রতিবেদনে যে তথ্য উঠে এসেছে তা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। কারণ, নিম্ন কিংবা
নিম্ন মধ্যবিত্তের পক্ষে পুষ্টিজাতীয় খাদ্যপণ্য ক্রয় করা সাধ্যের বাইরে। পুষ্টির তালিকায়
অতি প্রয়োজনীয় ডিমও বারবার চলে যাচ্ছে ক্রয়সাধ্যের বাইরে। প্রবাদ আছে, ধলা কিংবা কালা
যাই হোক না কেন উপকারী উপাদান চাই। এই প্রবাদটি দেশে ডিমের ক্ষেত্রে বলা যায়, বহুল
প্রযোজ্য হয়ে উঠেছে। সাদা কিংবা লাল ডিমে পুষ্টি উপাদান সমান থাকলেও এ নিয়েও দামের
ক্ষেত্রে পুষ্টির পার্থক্যের অজুহাত দাঁড় করিয়ে ভোক্তার পকেট কাটা হচ্ছে।
বাজারে সরকারের কঠোর তদারকি-নজরদারির কথা বারবার বলা হচ্ছে বটে, কিন্তু
কার্যত এর সুফল কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় এখনও দৃশ্যমান হচ্ছে না। ডিমও নিত্যচাহিদা পণ্যের
বাইরে নয়। আমরা জানি, গরিবের পুষ্টির চাহিদা আমিষের ক্ষেত্রে তেলাপিয়া, পাঙাশ মাছের
পাশাপাশি ব্রয়লার মুরগি ও ডিম একসময় ক্রয়সাধ্যের মধ্যে থাকলেও ক্রমাগত চাহিদা বৃদ্ধির
নিরিখে এও চলে যায় সাধ্যের বাইরে। এমন প্রেক্ষাপটে অতীতের মতোই প্রশ্ন উঠেছে পুষ্টি
তো দূরের কথা, জীবনধারণের জন্য যেকোনো খাদ্যপণ্যই কি সাধারণ মানুষের পক্ষে স্পর্শ
করা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে? ‘ডিমে পুষ্টি ডিমে শক্তি, ডিমে আছে রোগমুক্তি’ এই প্রতিপাদ্য
ধারণ করে ১১ অক্টোবর বিশ্বের সঙ্গে দেশেও পালিত হয়েছে বিশ্ব ডিম দিবস। প্রতিপাদ্যের
মুখ্য উপাদান হিসেবে ডিমের পুষ্টিকে প্রাধান্য দেওয়া হলেও উচ্চ মূল্যের কারণে ডিম কিনে
খাওয়া মোট জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশের পক্ষে দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা দেখছি, ১৮০
টাকা ডজন কিংবা কোথাও আরও বেশি দামে ডিম বিক্রি হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে ডিম কিনে খাওয়ার
হার যেমন কমছে, তেমনি পুষ্টির চাহিদা মেটানোও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের
হিসাবে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ডিমের উৎপাদন ছিল প্রায় ১১ বিলিয়ন; যা এক দশকের ব্যবধানে
প্রায় ২৩ দশমিক ৭৫ বিলিয়নে পৌঁছেছে।
ডিম ক্রেতাদের ক্রয়সাধ্যের মধ্যে আনার লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের
সচিবের যে প্রতিক্রিয়া প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ উঠে এসেছেÑ তা অনেকটাই দায়সারা গোছের।
আমরা দেখেছি, ইতোমধ্যে ডিম নিয়ে বাজারে তুঘলকি কাণ্ড কম ঘটেনি। কিন্তু যারা ডিম নিয়ে
কারসাজি করে নিজেদের পকেট ভারী করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিবিধানের
নজির প্রায় বিরল বলা চলে। ‘শুভংকরের ফাঁকি’ বলে শব্দযুগল আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত।
প্রাচীন বাংলার খ্যাতিমান এক গণিতজ্ঞ শুভংকর, যিনি রচনা করেছিলেন শুভংকরী নামক পাটিগণিতের।
মুখে মুখেই জটিল সব অঙ্ক তিনি করে ফেলতে পারতেনÑ যা মানসাঙ্ক নামে পরিচিত। হিসাবনিকাশের
মারপ্যাঁচে কিংবা সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের
নিজেদের উদরপূর্তির অপকৌশল সমাজে যেন ‘শুভংকরের ফাঁকি’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আমরা
দেখছি, খাদ্যপণ্য নিয়ে দফায় দফায় নানারকম কারসাজি হলেও এর কোনো প্র্রতিবিধান নিশ্চিত
করা যাচ্ছে না। আমরা মনে করি, অসাধু ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফার কালো হাত ভেঙে দেওয়া যাচ্ছে
না বলেই বাজারে ফিরে ফিরে মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন ঘটছে। আমাদের স্মরণে আছে, গত বছর ডিমের
বাজারে যখন অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছিল, তখন ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয় এবং লক্ষণীয়Ñ
তখনও অসাধু ব্যবসায়ীদের আমদানির ক্ষেত্রে নানারকম অজুহাত দাঁড় করাতে শোনা গিয়েছিল।
এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা বলেছিলাম, আমদানিকারক, উৎপাদকসহ বাজার তদারকির সংশ্লিষ্ট
দায়িত্বশীল পক্ষগুলোর পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ভোক্তার বিড়ম্বনা লাঘবে কোনো ভূমিকা তো
রাখেইনি, উপরন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজির কৌশল ক্রমেই ধরন পাল্টাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে
ভোক্তা আরও বেশি নাকাল।
ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক সরকারের টানা প্রায় ১৬ বছরে সরকারের দায়িত্বশীলদের
মুখে বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতার কারণগুলো বারবার বিশ্লেষণ করা হলেও এর কোনো সুফল
ভোক্তারা পায়নি। ডিমসহ কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া হলেও এ নিয়েও কত রকম কারসাজি
দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিলÑ তা আমাদের অজানা নয়। দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি কারও নেই,
বাজার নিজেকে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করে; এ নিয়ে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা যায়, ক্ষমতাচ্যুত
সরকারের কোনো কোনো দায়িত্বশীলের এমন বক্তব্য আমাদের বিস্মিত করেছিল। আমরা দেখেছি, ক্ষমতার
ছায়ায় অসাধু কিংবা অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কী রকম কাদাচার-অনাচার ঘটিয়েও পার
পেয়ে গেছে। বিদায়ি সরকারের তরফে বাজার নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ-আয়োজন দৃশ্যত কম না হলেও সেসবও
ছিল ‘শুভংকরের ফাঁকি’। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সৃষ্ট নতুন প্রেক্ষাপটে আমরা
অসাধু ব্যবসায়ী কিংবা সিন্ডিকেটের প্রলম্বিত অশুভ ছায়া কোনোভাবেই প্রত্যাশা করি না।
আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, এই প্রেক্ষাপটে বাজার
ব্যবস্থার সংস্কার নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ দাবির অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় খাদ্য তালিকায় পুষ্টির উপাদান জরুরি বিষয়
হিসেবে গণ্য। কিন্তু আমরা দেখছি, জনস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর উপাদান যেভাবে মূল্যস্ফীতির
অভিঘাতে সাধারণ মানুষের ক্রয়সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে, তাতে পুষ্টিজনিত হুমকি ক্রমেই
বাড়ছে। আমরা জানি, ডিমের বাজার হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তারাই
বাজারে ডিম নিয়ে ঘুরেফিরে কারসাজি চালাচ্ছে। আমরা আশা করি, অন্যান্য প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের
মতো ডিমসহ জনস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর উপাদানগুলোর দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের উদ্যোগ
যেন ‘অশ্বডিম্ব’ প্রসব করার মতো প্রহসন না হয়। সত্যিকার অর্থেই আমরা ডিমসহ প্রয়োজনীয়
নিত্যপণ্যের দামের ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকর প্রতিবিধান প্রত্যাশা করি। মূল্যস্ফীতি
নিয়ন্ত্রণে সরকারের বহুমুখী উদ্যোগের কথা সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে আমরা জানি বটে, কিন্তু
কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় এর প্রতিফলন দেখছি না। আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার বাজারের
অনাচার-দুরাচার-কদাচারের ছায়া অপসারণের পাশাপাশি স্বেচ্ছাচারী কিংবা অসাধু ব্যবসায়ীদের
অতিমুনাফা লোটার পথ রুদ্ধ করতে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে। সাধারণ খাদ্যপণ্য তো বটেই, পুষ্টিজনিত
খাদ্যপণ্যের দামও বৃহৎ জনস্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ডিমও এর বাইরে নয়।