জনপ্রশাসন
ড. কাজী এস এম খসরুল আলম কুদ্দুসী
প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:২২ এএম
আপডেট : ১২ অক্টোবর ২০২৪ ১৫:৩০ পিএম
ড. কাজী এস এম খসরুল আলম কুদ্দুসী
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে বলা হয় বাংলাদেশ সচিবালয়ের নিউক্লিয়াস কিংবা প্রাণভোমরা। তবে দেশের প্রেক্ষাপটে জনপ্রশাসনে কর্মরতরা বরাবরই এক ধরনের ক্ষমতাবলয় সৃষ্টি করে ফেলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি সংযোগের কারণে তারা জনপ্রশাসনিক ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতে শুরু করেন। অভিযোগ রয়েছে, বিগত নির্বাচনেও প্রশাসনের কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে সক্রিয় ছিলেন এবং চলতি বছর জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়ে নির্বাচন কমিশন এ বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছিল। ফলে আমরা দেখেছি, জনপ্রশাসনিক কাঠামোতে রাজনীতি ও দলীয়করণের নেতিবাচক প্রভাব কতটা ভয়াবহ হতে পারে।
বিশেষত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়
থাকার সময় জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের
ক্ষমতাবলয়কেও পোক্ত করতে মদদ দিয়েছে। এর ফলে জনপ্রশাসন জনগণের সেবার তুলনায় ব্যক্তিস্বার্থসিদ্ধি
ও দুর্নীতির কবলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের কারণে দেশের মানুষের মধ্যে দেখা
দিয়েছে ব্যাপক কৌতূহল। গত আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর প্রশাসনে রদবদলের যে
প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা এখনও শেষ হয়নি। এরই মধ্যে পদোন্নতি ও
পদায়ন ঘিরে বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে নানা বিতর্ক।
জনপ্রশাসনের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও গৃহীত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন নিয়েও জনমনে
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, জেলা প্রশাসক বদলাতে গিয়ে
বিপুল অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়েছে।
৬ অক্টোবর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর অনলাইন সংস্করণে বলা হয়, জনপ্রশাসনের সিনিয়র
সচিব, জেলা প্রশাসকসহ সারা দেশে জনপ্রশাসনের ৬৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। ৪ অক্টোবর
প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর অন্য এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ডিসি
নিয়োগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ তদন্তে
সরকার ডাক,
টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা, আইন
উপদেষ্টা এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। ইতোমধ্যে
রদবদল ফাঁদে স্থবির হয়ে পড়েছে প্রশাসন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পদচ্যুতির পর অন্তর্বর্তী
সরকার ক্ষমতায় আসায় জনপ্রশাসনে বড় রদবদলের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু এখনও প্রশাসনে
পূর্ববর্তী সরকারের পদায়ন করা কর্মকর্তা রয়ে গেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার তো সবাইকে সরিয়ে
দিতে পারবে না। কারণ বিষয়টি বাস্তবসম্মত হবে না। তবে জনপ্রশাসনের স্থবির অবস্থা সহজেই
দূর করা যেত। এক্ষেত্রে সম্ভবত সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা কিংবা আগে থেকেই পর্যাপ্ত
হোমওয়ার্ক করা হয়নি। ফলে জনপ্রশাসন সংস্কারে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে তার কার্যক্রম
নিয়ে এখনও আমরা সুস্পষ্ট ধারণা পাইনি। তবে অন্তর্বর্তী সরকার জনপ্রশাসনের ক্ষমতাবলয়
ভেঙে দিতে পেরেছে, এমনটি ঠিক আছে। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা এবং হোমওয়ার্কের মাধ্যমে জনপ্রশাসনের
স্থবিরতা দূর করার আরও ভালো উদ্যোগ নেওয়া যেত।
জনপ্রশাসনের স্থবিরতা, দুর্নীতি, বদলি, পদায়ন-পদোন্নতি নিয়ে সংবাদপত্র যা খবর উপস্থাপন
করছে তা পিলে চমকানো। সংবাদপত্রের ভাষায়ও মনে হচ্ছে এসব তথ্যসূত্রের প্রামাণ্যতা সম্পর্কে
তারা যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। অর্থাৎ প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর ‘সবার চোখ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের
দিকে’ প্রতিবেদনের শিরোনামটিকে যথার্থ বলা যায়। যদিও ইতোমধ্যে জনপ্রশাসন সচিব নিজেও
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, দুর্নীতির এত খবর দেখে তারা স্তম্ভিত। কিন্তু জনপ্রশাসনে
স্বচ্ছতা-জবাবদিহি না থাকলে এমনটি হওয়াই সংগত। বিশেষত জনপ্রশাসনে রাজনৈতিক প্রভাববলয়
থাকায় কর্মকর্তারা তাদের প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব হারিয়েছেন। একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা
কিংবা আমলার ব্যক্তিত্ব জনসেবায় নিয়োজিত হলে জাতি উপকৃত হয়, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে
নানা উদ্ভাবন দেখা যায়। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ভেতরেই যখন নানা অস্থিতিশীলতা,
পিরামিড স্ট্রাকচার উল্টে যায়, তখন জনপ্রশাসন তার সুষ্ঠু কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারে
না। আর জনপ্রশাসনের নাগরিক সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হয়, যা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনীতি,
আর্থসামাজিক ব্যবস্থা, নিরাপত্তা থেকে শুরু করে কর্মসংস্থানেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
সম্প্রতি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আওয়ামী
লীগের মদদপুষ্ট অনেকেই এখনও প্রশাসনে রয়ে গেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভবত তাদের অনেককেই
সরাতে চাননি বাস্তবতার নিরিখে। কারণ জনপ্রশাসনের ওপরের পর্যায়ে ব্যাপক রদবদলে চেইন
অব কমান্ড ভেঙে পড়ে। আর এমনটি হলে জনপ্রশাসনের অনেক কাজ থেমে যাবে। সাময়িক সময়ের জন্যও
যদি তা হয় তাহলেও অনেক ক্ষতি হবে। তাই বাস্তবতাকে বুঝতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্য সমালোচনার
সুষ্ঠু জায়গাটিও চিহ্নিত করতে হবে। কারণ সমালোচনাকেও আমরা এক ধরনের পরামর্শ হিসেবেই
বিবেচনা করব।
সচেতন একটি মহলের দাবি, জনপ্রশাসনে ‘ডিপ স্টেট’ অবস্থা কিংবা পূর্বতন সরকারের একটি
অংশ নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছে এবং সুযোগ বুঝে তার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে,
অস্থিতিশীলতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এমন অজুহাত দিয়ে আসলে পার পাওয়া যাবে না। জুলাইয়ে
যে গণঅভ্যুত্থান আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তার মূল চেতনাই ছিল রাষ্ট্রের মধ্যকার সব দুর্নীতি-অনিয়ম-বৈষম্য
হটিয়ে সংস্কার। আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু দায়িত্ব নিয়েছে
এবং তারাও যেহেতু সংস্কারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, তাই তাদেরকে কাজ করতে হবে। সুষ্ঠু
একটি সমাধানের মাধ্যমে একটি পেশাদার মঞ্চ গড়ার কাজটি তাদের করতেই হবে। এক্ষেত্রে আমি
মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু ভুল হয়ে হয়েছে। কারণ দায়িত্ব গ্রহণের
পর জনপ্রশাসনে স্বচ্ছতা ও কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত কিছু পদক্ষেপ
নেওয়া যেত। বিশেষত জনপ্রশাসনে সচিব নিয়োগের কাজটি আরও দ্রুত করা গেলে কিছু কাজ এগিয়ে
যেত। তা ছাড়া দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই অনেকের পদায়ন দেওয়া হয়েছে। পদায়ন, চাকরিতে কিছু
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এসবই করার পেছনে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণও দেখানো হয়েছে। তবে এ সিদ্ধান্তগুলো
আরও কিছুদিন পরে বাস্তবায়ন করলেও ক্ষতিবৃদ্ধি হতো না। শুরুর দিকে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত
পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে টিকে গেছে আর জনপ্রশাসনে রদবদলের কারণে স্থবিরতা আরও বেড়েছে।
পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নতুন দিগন্তের
প্রত্যাশা পাওয়া যাচ্ছে। আবার সরকারেরই কিছু ভুল সিদ্ধান্তের ফলে মাথাভারী প্রশাসন
তাদের গায়ে কালো দাগ হয়ে পড়ছে। জনপ্রশাসনে সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকা একটি বড় দুর্বলতা,
যা সামনে আরও খারাপ আকার ধারণ করতে পারে। জনপ্রশাসনের ক্ষেত্রেই একটি ভিন্ন পর্যবেক্ষণের
কথা না বললেই নয়। জুলাই ও আগস্টে এত তরুণ আন্দোলন করল, ঝরে গেল এত তাজা প্রাণ, নির্যাতনের
ক্ষত বইয়ে বেড়ানো এত আহতের আর্তনাদের মাঝে আমরা জনপ্রশাসনিক কার্যক্রম কী দেখতে পাচ্ছি?
অন্তত সংবাদপত্রে জনপ্রশাসনের যে সিদ্ধান্তগুলো পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর অধিকাংশই বিগত
পনেরো বছর বা এক দশকে বৈষম্যের শিকার হওয়া মানুষদের পুনর্বাসন সংশ্লিষ্ট। হ্যাঁ, এই
বৈষম্যগুলোও দেখা জরুরি। কিন্তু এই আন্দোলন যারা করেছে তাদের জন্য জনপ্রশাসনিক সিদ্ধান্ত
সর্বাগ্রে প্রাধান্য পাওয়া উচিত। আবার অনেক রাজনৈতিক পক্ষও এখন এমনভাবে জনপ্রশাসন নিয়ে
কথা বলছে, যাতে মনে হয় এই আন্দোলনটিকে তারা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে হটিয়ে নিজেদের
করে নিতে চাইছে। এমন প্রবণতা ভালো নয় এবং অন্যায়। কারণ অনেকের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা
আবার সংস্কারের দিকে হাঁটতে পারছি। কিন্তু সেক্ষেত্রে যাদের অংশীজন ভাবা হয়, তাদের
প্রাপ্য সম্মান, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের বিষয়টিকেও সামলাতে হবে। জনপ্রশাসনের দিকে
দেশের সাধারণ মানুষের নজর বেশি থাকে, কারণ এই শাখাটিই জনসেবার সঙ্গে মাঠপর্যায়ে বেশি
যুক্ত থাকে। জনপ্রশাসনে খালি পদ পূরণের জন্য দ্রুত কার্যক্রম নেওয়া, পিরামিড স্ট্রাকচারকে
আবার ফিরিয়ে আনা, প্রশাসনে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করা জরুরি।
ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মানুষের ভোটাধিকার হরণ এমনকি ভোট দেওয়ায় মানুষের আগ্রহ নষ্ট করে দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ দায়ী। তারা নিঃসন্দেহে বড় দল এবং দেশের জন্য তাদের অনেক অবদানও রয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ অসংখ্য ভুল করেছে; যা দেশের আমলাতন্ত্রকে ক্রনি ক্যাপিটালিজমের অংশ বানিয়ে ফেলেছে। আর তাদের এ কাজে সহায়তা করেছে প্রশাসন। তাই জনপ্রশাসনকে রাজনৈতিক বলয় থেকে বের করে আনা জরুরি। জনপ্রশাসনে বৈষম্য দূর করতে হলে এই বলয়কে আগে ভাঙতে হবে। তবেই অর্জিত হবে কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের লক্ষ্য।