× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শারদীয় দুর্গোৎসব

ভক্তিবাদ ও হুজুগ

রাজীব নন্দী

প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:১৯ এএম

রাজীব নন্দী

রাজীব নন্দী

বাঙালির ক্যালেন্ডারে ঘুরেফিরে শরৎ আসে, আকাশে ভাসে তুলার মতো মেঘ, কাশফুলের বনে লাগে দোলা। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। যার জন্য সারা বছরের অপেক্ষার পালা ফুরায়। ক্যালেন্ডারে শরৎ ঢুকতেই চারপাশে পূজা পূজা একটা আমেজ শুরু হয়। আমেজ বললে ভুল হবে, নতুন প্রজন্ম একে নাম দিয়েছে ‘পূজা ভাইব’! পূজা ভাইবের সঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে আসে বাঙালির নানাবিধ আহ্লাদ, আবদার, দাবি, যা আদতে হুজুগ ছাড়া কিছুই নয়। দুর্গাপূজা আয়োজনে ধীরে ধীরে হরেকরকম বদল এসেছে। পূজায় ভক্তিবাদের চেয়ে ‘ভক্তি বাদ’ হয়ে যাচ্ছে। এপার-ওপার বাংলার বাঙালির হালনাগাদ হুজুগ নিয়ে এ আলাপ। 

দুর্গাপূজা একটি শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠান। তাতে ধর্মীয় বিধিনিষেধ সাপেক্ষে কিছু মাঙ্গলিক কর্তব্য নির্দিষ্ট করা আছে। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের সনাতন বা হিন্দু শাস্ত্রে ধর্মীয় কঠোর বিধিনিষেধ না থাকায় ভূরাজনৈতিক ও সামাজিক বিন্যাসে দুর্গাপূজাও ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে উদ্‌যাপিত হয়। যেহেতু একক কোনো বিধান নেই, তাই কলকাতার পূজা, চট্টগ্রামের পূজা, আসামের পূজা, শিলিগুড়ির পূজা, আগরতলার পূজা, ঢাকা-বরিশালের পূজায়ও ব্যাপক মিল-অমিল রয়েছে। কালের বিবর্তনে পূজা তার আদি মাহাত্ম্য থেকে হুজুগমুখী হয়েছে বেশি। কেমন সেসব হুজুগ? আমি মনে করি, আমাদের আত্মমূল্যায়ন করা দরকার। হুজুক বা হুজুগ হলো বিশেষ্য পদ, যার অর্থ সাময়িক আনন্দ, উদ্দীপনা। এটি মূলত আচরণ ও ফ্যাশনের মাধ্যমে ছড়ায়। হুজুগে শব্দটি বিশেষণ পদ। সামান্য কোনো বিষয়ে ব্যাপক উত্তেজনা। আরবি হুজম বা হজ্জৎ থেকে আসা হুজুক বা হুজ্জুক বা হুজুগ শব্দের আক্ষরিক অর্থ গোলমাল।

বাঙালির অনেক জাতধর্মের মধ্যে হুজুগ একটি। হুজুগে বাঙালি প্রবাদটি তো আর এমনি এমনি তৈরি হয়নি। গড্ডলিকা প্রবাহ বা ভেড়ার পালে ভেসে যাওয়াকে রূপকার্থে হজুগ বলা হয়। যাদের বয়স চল্লিশ পেরোলেই চালশে, তারাই সর্বশেষ শৈশব-কৈশোরে বাঙালির পূজামণ্ডপের মাইকে সারা দিন শুনেছি রামপ্রসাদী শ্যামাসংগীত, মান্না কিংবা হেমন্ত। কিশোরকুমারও ছিল অনির্বায। কিন্তু গত ১৫ বছরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের কারণে দীর্ঘদিনের চিরচেনা সুরগুলো এখন আর শোনা যায় না। এমনকি মহালয়ার আগমনী সংগীতের সঙ্গে দেবী আবাহন, তা-ও হারিয়ে যাচ্ছে। চণ্ডীপাঠ তো মাইকেই শোনা যায় না। তাহলে সেখানে জায়গা নিয়েছে কী? এখন মাইকের সুরে ভেসে আসে ‘জামাই সেজে আমি হাজির হয়েছি’ কিংবা ‘ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শোনে না’ এ-জাতীয় গানগুলো। যে গানগুলোকে গণমাধ্যম ও যোগাযোগবিদ্যার ভাষায় বলা হয় জনসংস্কৃতি বা জনপ্রিয় সংস্কৃতি। বিশ্বায়নের ধাক্কায় বলিউড ও টালিউডের চলতি সিনেমার চালু গান এখন মণ্ডপে মণ্ডপে শব্দত্রাস। মাইকের ত্রাসে ‘শব্দই ব্রহ্ম’ তা হারিয়ে যাচ্ছে। 

মাইকের পর ফ্যাশনের দিকে চোখ দিলে দেখা যায়, প্রতি বছরই পূজা কেন্দ্র করে ফ্যাশনবাজারে চলে নিজেকে হালনাগদ প্রদর্শনের আরেকটি হুজুগ। সেখানেও প্রভাব বিস্তার করেছে বলিউড ও ঢালিউডের শাড়ি, চুড়ি, গয়না, পাঞ্জাবি। বাংলা ও হিন্দি সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকাদের মতো হতে চাওয়ার বাসনা থেকেই নিজেদের সাজাই আমরা। আরতিতেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ঢাকের তালে দেহ দুলিয়ে দুই হাতে ধুপধুনোর নৃত্য আর কই? মণ্ডপে যখন বেজে চলে ‘জামাই আমি হিট/সবার সাথে ফিট,/বলবে সবাই ছক বাজিতে জামাই ৪২০’! সেই আরতিতে থাকে না ভক্তি, থাকে না প্রেম, থাকে না শ্রদ্ধা। তাহলে থাকে কী? থাকে গতি, থাকে হুল্লোড়, থাকে উদ্দামতা। এই যে পূজার মতি ও গতি বদলে যাচ্ছে কিছুসংখ্যক পূজারীর আচার-আচরণে চোখের সামনে, সেটা অসহায় অপলক তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কীইবা করার আছে আমাদের?

দুর্গাপূজায় ষষ্ঠী থেকে নবমী চট্টগ্রামে নিরামিষ খায় বলে জানতাম। দশমীর দিন মাংস ভক্ষণ রেয়াজ আছে চট্টগ্রামে। কিন্তু সনাতন অর্থাৎ হিন্দুধর্মের যেহেতু একক ও কঠোর কোনো বিধিনিষেধ নেই তাই কে কখন কী খাবে বা না খাবে, তা কোথাও সুস্পষ্ট বর্ণনা নেই! দুর্গাপুজোর সঙ্গে সত্যিই কি ইলিশ মাছ, আরও বিশেষ করে পদ্মার ইলিশ খাওয়ার কোনো যোগ আছে? দুর্গাপূজার যে ধর্মীয় আচার, সেখানে কোথাও ইলিশ মাছ বা পদ্মার ইলিশের প্রসঙ্গ নেই। এটি মূলত পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালির একাংশের ‘হুজুগ’! বাঙালি নদীমাতৃক ও খাদ্যরসিক বলেই ইলিশ ডিপ্লোম্যাসি নিয়ে এ আলাপটি সম্প্রতি কলকাতা থেকে ভেসে এসেছে! বিজয়া দশমীর শেষলগ্নে সিঁদুরখেলার চল আজকাল খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দেবীর বিদায়ক্ষণে বিষাদের চেয়েও আনন্দ কেন হঠাৎ? সধবা মেয়েদের উচ্ছ্বাসে সোশ্যাল মিডিয়া ভরে উঠলেও বিধবা নারীরা কি এতে অংশ নিতে পারেন? কলকাতার বাংলা সিনেমার দেহবল্লরি নাচাগানায় আজ বাংলা সনাতনী তারুণ্যের শক্তি আর ভক্তির প্রকাশ। কান ঝালাপালা দশা, শব্দদূষণ। ঢাক ঢোল কাঁসা ধুপ ধুতি কিছুই তো নেই আজকালকার পূজায়। এর নাম দিয়েছি ‘মাতৃ আরাধনা’!

সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমরা জানি গণসমাজে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর কতগুলো যৌথ আচরণ আছে, যাকে বলে গণআচরণ। গণআচরণের কয়েকটি ধাপ আছে। যেমন গুজব, হুজুগ, উন্মাদনা আর গণবিকার। গণবিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, যার ইংরেজি মাস হিস্টিরিয়া। এ গণবিকার হলো এক ধরনের ভাবাবেগযুক্ত আচরণ যার মধ্যে বুদ্ধি বা যুক্তির সম্পর্ক নেই। এ আচরণ একসঙ্গে বহু লোকের মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যায়। ভাবাবেগে গা ভাসিয়ে দিয়ে মানুষ এ গণবিকারগ্রস্ততায় ভোগে। প্রবল উত্তেজনায় এ আচরণ করে আধুনিক ভোক্তাসমাজ। এটা গণআচরণেরই অংশ। দুর্গাপূজা এভাবেই লৌকিকতা ও ভক্তিবাদ হারিয়ে আদি ধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে হুজুগ পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। এরপর তা উন্মাদনা ও গণবিকারের দিকেও যেতে পারে।

বছরের আশ্বিন-কার্তিকের পঞ্চমী থেকে দশমী তিথির পাঁচ দিন ‘জগজ্জননী’ দুর্গা দেবী পিতৃগৃহ ঘুরে যান। পাঁচ দিনের শারদ উত্সব শেষ হয় বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে। এ দিনগুলোয় একসময় ছিল ভোরে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডী শ্লোকে ঘুম ভাঙা, পূজা মানে তো ঝরা শিউলি দেখে সাবধানে পা মাড়িয়ে মণ্ডপে যাওয়া, পূজা মানে ধুপের গন্ধ, ঢাকের তালে ধুনুচি নাচ, তাই না? একে বলি বটে আমরা দুর্গাপূজা, কিন্তু পুজোটা গৌণ হয়ে গেছে অনেক আগেই। প্রদর্শনবাদিতার কবলে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ জুড়ে কেবলই দেখানেপনা। যে উৎসব নিয়ে এত হইচই, কোটি টাকার ঝাড়বাতি জ্বলে ওঠা, পাড়ায় পাড়ায় কমিটি নিয়ে ঝগড়া, অন্য পাড়া মণ্ডপের থেকে দুই হাত লম্বা স্টেজ করার যে তাড়না; তা কি আদৌ উৎসব? সর্বজনীন নাম হলেও তা আজ পুরোটাই বাজার নিয়ন্ত্রিত আয়োজন। বাজার অর্থনীতির অনুপ্রবেশে পূজা আর পূজা নিয়ে চলে কোটি টাকার ব্যবসা। কোটি কোটি টাকার থিম, এ বিলাসের আয়োজন! দেখি পাড়ায় পাড়ায় বৈভব, জলুস, আধিপত্য, ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ। এর মধ্যে উৎসব কোথায়? ভক্তিবাদ থেকে ভক্তিই যদি বাদ যায়, এ যে ষোল আনা থেকে বারো আনাই মিছে!

  • সহযোগী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা