× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ও আজকের বাস্তবতা

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২২ ১১:২৭ এএম

অলঙ্করণ : জয়ন্ত জন

অলঙ্করণ : জয়ন্ত জন

বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খৃষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।’ একটি জাতির স্বাধীনতা অর্জিত হয় গোটা জাতির আকাক্সক্ষায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। গোটা জাতির আত্মত্যাগে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। শুধু বিশেষ গোষ্ঠীর অবদানে নয়, এককভাবে কেউ এই অর্জনের দাবিদার হতে পারে না। তবে যেহেতু এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, তাই প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের। সেই নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ অভিন্ন সত্তা। ৭ মার্চ ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার সামনে ঘোষণা করলেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। 

২৬ মার্চ ১৯৭১-এর প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাওযায় আহ্বান জানান। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ, তাই সংবিধান প্রণয়নকারীরা প্রস্তাবনায় জনগণের কথাই বলেছেন। এহেন সুস্পষ্ট লেখার পর কীভাবে যে অন্য ঘোষকের কথা আসে, তা বোধগম্য হয় না। প্রস্তাবনার পরের অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শে এই সংবিধানের মূলনীতি হবে। বাংলায় মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, আদিবাসী সবাই মিলে এই যুদ্ধে অংশগ্রহন করে। এখানে কোনো ধর্মীয় সংকট ছিল না। শত শত সাঁওতাল আদিবাসী তীর ধনুক নিয়ে রংপুর ক্যান্টমেন্ট ঘেরাও করে আত্মাহুতি দিয়েছেন। এটি এরকম শত ঘটনায় একটি। তাই আমাদের সংবিধান যারা কাটাছেঁড়া করেছেন, তাদের এই অনুভূতি কাজ করা উচিত ছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা কথাটার মর্যাদা রক্ষা খুব প্রয়োজন ছিল। ১৯৭২-এর ৪ নভেম্বর যেদিন গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধান গৃহীত হয়, সেদিন বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয় রাষ্ট্র এটুকু নিশ্চয়তা দেবে যে যার যার ধর্ম সে স্বাধীনভাবে পালন করবে। ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক সংগঠন থাকবে না এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না। ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর প্রথম আঘাত হানেন জেনারেল জিয়া। তিনি এই জায়গায় বসিয়ে দেন আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ^াস। প্রত্যেক মুসলমানের অগাধ বিশ^াস রয়েছে আল্লাহর ওপর। এটি সংবিধান লেখার প্রয়োজন ছিল না। এরপর জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযোজন করলেন। ১৫তম সংশোধনীতে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনস্থাপন করা হলো। তবে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রয়ে গেল। এই সংশোধনীতে অবশ্য সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান থেকে বিরত থাকা হবে। 

বাংলাদেশের সংগ্রামী গণপরিষদ জাতিকে বিজয় অর্জনের এগারো মাসের মাথায় একটি আদর্শ সংসদীয় গণতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সংবিধান উপহার দিয়েছিল। পৃথিবীর কোনো প্রকৃত সংসদীয় পদ্ধতির সরকারে সংসদ সদস্য নন এমন কেউ মন্ত্রী থাকতে পারেন না। যদি মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন তাহলে ছয় মাসের ভেতর তাকে নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে। যুক্তরাজ্যের এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী মি. হ্যারন্ড উইলসন তার প্রিয় মি. প্যাটরিক গডর্ন ওয়াকারকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন, কিন্তু উপনির্বাচনে জিতিয়ে আনতে না পারায় মন্ত্রী রাখতে পারেননি। বাংলাদেশের মূল সংবিধানের ৫৬ (৪) অনুচ্ছেদে এরূপ বিধান ছিল। ৫৮ (খ)-তে পরিষ্কার বলা হয়েছে, সংসদ সদস্য না হলে মন্ত্রী থাকতে পারবেন না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বলা হয়েছে যে মন্ত্রিসভার মোট সংখ্যার একদশমাংশ মন্ত্রী সংসদ সদস্য নন, এমন ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া যায়। সংবিধানে যত রকম সংশোধন করা হয়, যোগসূত্র হিসেবে তার উল্লেখ থাকতে হবে। কিন্তু এই অনুচ্ছেদে এরকম কোনো যোগসূত্রের উল্লেখ নেই। বোঝা যাচ্ছে না যে সংশোধন প্রক্রিয়ার কোনো চোরাবালিতে এটি তলিয়ে গেছে।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রয়োজন শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা। সে কথা মনে রেখেই মূল সংবিধানের ৯৪ (৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারক বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন ৯৫ (১) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারপতিকে নিয়োগ দান করিবেন।’ এর দ্বারা এটাই অনুধাবন করতে হয় যে মাননীয় বিচারপতিদের দায়বদ্ধতা সংবিধানের নিকট। তবে সামরিক অভ্যুত্থান সফল হলে এর কার্যকারিতা থাকবে না, এ ফরমান করে গেছেন পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মুনির। তিনি এই রুলিং দিয়ে জেনারেল আইয়ুব সরকারকে বৈধ করেছিলেন। সেই ট্রাডিশন এখনও চলছে। ১৯৭২ সনের ৪ নভেম্বর ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত আবহে গণপরিষদের সদস্যরা এই সংবিধান গ্রহণ করেন। এই গণপরিষদের সকল সদস্য বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই সংবিধান বাঙালি জাতির নিকট অতি পবিত্র। কালের প্রবাহে হয়তো কিছু সংশোধন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তবে সেটি সামনে চলার জন্য, পেছনে টানার জন্য নয়। কিন্তু এক্ষত্রে সব সময় তেমনটা ঘটেনি। তার একটা বড় দৃষ্টান্ত ধর্মনিরপেক্ষতাকে গায়েব করে দেওয়া।

অবশ্য এত কিছু সরানোর পরও সংবিধানে এখনও অনেক কিছু রয়েছে যা পালন করলে জনগণের প্রভূত কল্যাণ সাধিত হতে পারে। যেমন সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে স্থানীয় সরকারের বিধানের কথা। এখানে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে। (২) এই সংবিধান ও অন্য কোন আইন সাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা যেরূপ নির্ধারণ করিবেন, এই অনুচ্ছেদের (১) দফায় উল্লিখিত প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান যথোপযুক্ত প্রশাসনিক একাংশের মধ্যে সেইরূপ দায়িত্ব পালন করিবেন এবং অনুরূপ আইনে নিম্নলিখিত বিষয় সংক্রান্ত দায়িত্ব অন্তর্ভুক্ত হইতে পারিবে (ক) প্রশাসন ও সরকারী কর্মচারীদের কার্য (খ) জনশৃঙ্খলা রক্ষা (গ) জনসাধারণের কার্য ও অর্থনেতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন (৬০) এই সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের বিধানাবলিকে পূর্ণ কার্যকারিতার উদ্দেশ্যে সংসদ আইনের দ্বারা উক্ত অনুচ্ছেদে উল্লিখিত স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের স্থানীয় প্রয়োজনে কর আরোপের ক্ষমতা প্রদানসহ বাজেট প্রস্তুত করেন ও নিজস্ব তহবিল রক্ষণাবেক্ষণ ক্ষমতা প্রদান করিবেন।’

৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ অক্ষত থাকার পর ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো রূপ লাভ করতে পারেনি। এর অন্যতম প্রধান কারণ আমলাতান্ত্রিক বাধা। কেননা অর্ধশতাব্দীর অধিক সময় এসব প্রতিষ্ঠান যে পরিচয়ে থাকুক না কেন, তা সম্পূর্ণরূপে আমলাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল বা আছে। সরকার উপজেলা পরিষদ পুনরায় চালু করেছে। এরশাদের আমলে উপজেলা চালু থাকলেও বিএনপি আমলে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। অবশ্য বিএনপির সেই আদেশকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত বৈধতা প্রদান করেন। পরে আবার চালু হয়েছে। কিন্তু উপজেলা নির্বাহী অফিসার যিনি সরকারি আমলা, তার মর্যাদা রক্ষার জন্য উপজেলা প্রশাসনকে পরিষদ থেকে পৃথক করা হয়েছে। এই শাখা উপজেলা প্রশাসন নামে পরিচিত। জেলা পরিষদের কী অবস্থা, তা তো দেখাই যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর বাকশাল পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা হয়েছিল। জেলার প্রধানের পদবি দেওয়া হয়েছিল জেলা গভর্নর, যিনি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হবেন। থানাতেও অনুরূপ প্রস্তাব ছিল। বলা হবে থানা প্রশাসক। সংবিধানের ৫৯ এবং ৬০ অনুচ্ছেদ পড়লে বোঝা যায়, উন্নত বিশে^ যে রকম শক্তিশালী এবং মর্যাদাপূর্ণ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু আছে, সেরকম এখানে করা হবে, অন্তত সংবিধান তাই বলে। আমলাতন্ত্র এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দর্শনের সংমিশ্রণে আমরা পাচ্ছি রূপান্তরিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। অতএব সংবিধানে লেখা থাকলেও তা কপালে জোটে না, এটা তার বড় প্রমাণ।

৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গত ১০ বছরের অধিক সময় ধরে ৪ নভেম্বর সংবিধান দিবস পালন করে আসছে এই প্রত্যাশায় যে, ৭২-এর সংবিধান অক্ষত অবস্থায় চালু হবে। সব প্রত্যাশা পূরণ হবে এমন নয়, তবে নির্মূল কমিটি কৃতজ্ঞতাভরে স্বীকার করে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি পূরণ হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছা এবং সাহসিকতার জন্য। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিচার করেছে, রায় দিয়েছে, কিন্তু কোর্টের কার্যক্রম শুরু হয়েছে তো তারই নেওয়া পদক্ষেপের কারণে। এরপর রায় কার্যকর করার কথায় আসা যাক। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির আহ্বানও শেখ হাসিনা প্রত্যাখ্যান করেন, এরা দুজনেরই দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ড কার্যকর না করার আহ্বান করেছিলেন। বান কি মুনের কথায় মনে পড়ে যায়, ৭১ সালের জাতিসংঘের মহাসচিব আরেক এশিয়ান বার্মার উথান্টের কথা। পাকিস্তান বাংলাদেশে গণহত্যা চালাচ্ছে, আর তিনি ব্যস্ত মানবিক ত্রাণ নিয়ে। অর্থাৎ দুই মহাসচিবই ছিলেন খুনির পক্ষে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি শুধু যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছে তাই নয়, একটি শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ে উঠুক এটাও তাদের কাম্য। শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই প্রোথিত হয়েছে জাতির অন্তরে। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। আমরা যেন মুক্তিযুদ্ধেও অঙ্গীকার ভুলে না যাই। 


লেখক : মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা । ব্যাংক, শেয়ারবাজার ও বীমা খাত বিশ্লেষক 


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা