প্রত্যাশা
এম আর খায়রুল উমাম
প্রকাশ : ০৭ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:২৭ এএম
এম আর খায়রুল উমাম
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের
বিজয়কে দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করে সারা দেশে আনন্দের বন্যা বইছে। কেউ কেউ
এ বিজয়কে নিজেদের অর্জন বিবেচনায় এমন সব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন, এমন সব কথা বলছেন,
এমন সব দাবি পূরণের লক্ষ্যে মাঠ গরম করছেন, দখল প্রক্রিয়ায় সক্রিয় হয়ে পড়ছেন যা কোনোভাবেই
কাম্য হতে পারে না। এই সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। স্বৈরাচারের অনেক দোসর পদত্যাগ করছেন,
পলাতক থেকে বাঁচার পথ খুঁজছেন, পালিয়ে বিদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন আর অনেকে রঙ পরিবর্তনের
প্রতিযোগিতায় নেমে পদপদবি ধরে রাখায় নিয়োজিত আছেন। উপদেষ্টা পরিষদ দায়িত্ব গ্রহণের
পর কেউ সময় দিতে রাজি আছেন বলেও বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এক জায়গায় বসে পরস্পরের
মত ও পথের সমন্বয়ের যে ন্যূনতম সময় প্রয়োজন ছিল তা-ও উপদেষ্টারা পেয়েছেন এমনটা এখনও
মনে হয় না। উপদেষ্টারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে জ্ঞানের আধার তাতে হয়তো অনেকেরই কোনো সন্দেহ
নেই, কিন্তু রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্ব পালন পারস্পরিক সমন্বয় ছাড়া কীভাবে সম্ভব, বোধগম্য
নয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়, ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্র্য’
খুবই প্রয়োজন।
কয়েক দিন আগে সমাজমাধ্যমে
কোনো একজন লিখেছেনÑএকদল পনের বছর খেয়েছে এবং একদল পনের বছর খায় নাই। দেশের সর্বত্র
এখন খাওয়া আর না-খাওয়ার এহেন অস্থিরতা চলমান। প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির উৎকট প্রকাশ ঘটছে।
সর্বত্র সবাই নিজ নিজ চাহিদা পূরণের জন্য ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা বোধ পর্যন্ত হারিয়ে
ফেলছেন। ছাত্র-জনতা এহেন বিবেচনাবোধহীন ক্ষমতালাভের জন্য রক্ত দিয়েছে তা বিশ্বাস করা
যায় না। তারা দেশ স্বৈরাচারমুক্ত করেছে ভবিষ্যতের একটা সুন্দর জীবনের আশায়। তাদের আবেগ,
তাদের চাওয়া, তাদের স্বপ্ন পূরণ করা খুব কঠিন কাজ। আর এ কঠিন কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন
৮৪ থেকে ২৫ বছর বয়সি স্বখ্যাত মানুষরা। বয়সের পার্থক্যের কারণে আবেগ, অনুভূতি, দায়িত্ব,
বিদ্যাবুদ্ধি ও জ্ঞানের সমন্বয়ের যে পরিবেশ প্রয়োজন, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য স্থাপনে
যে সময়ের প্রয়োজন তা দেওয়া বাঞ্ছরীয়। দেশ ও জাতির কল্যাণ বিবেচনায় খুব ছোট ছোট বিষয়গুলোতেও
দলবেঁধে রাস্তায় নেমে এসে জনজীবনে সংকট সৃষ্টি করে চলেছে নানা পক্ষ।
স্বৈরাচারের লাগামহীন
অত্যাচারের ভয়ে এতদিন যারা গর্তের মধ্যে লুকিয়ে নিজেদের রক্ষা করেছেন, আজ তাদের অনেকের
সগৌরবে বাইরে এসে চর দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। সব ক্ষেত্রে মানসিকতার কোনো পরিবর্তন
লক্ষ করা যাচ্ছে না। কয়েক দিন আগে টেলিভিশনে দেখছিলাম এক দোকানদার খরিদদারকে বলছেন,
আগে একদল চাঁদা তুলত আর এখন অন্য দলকে চাঁদা দিতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা বাজার মনিটরিং
করতে গেলে আলু ৪০ টাকায় নামছে আর তারা চলে এলে ৭০ টাকা হয়ে যাচ্ছে! সিন্ডিকেটের মালিক
পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু সমভাবে সিন্ডিকেট বহাল আছে বলেই বাজারে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
পরিবর্তন সাধারণ মানুষ চাইলেও সহজে আসবে এমন পরিবেশ-পরিস্থিতি এখনও দেখা যাচ্ছে না।
সময় যদিও একটা ব্যাপার তার পরও অনেকের মানসিকতার কারণে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কঠিন মনে
হচ্ছে। ২০ টাকার ফুল দিয়ে যেখানে আদর্শের পরিবর্তন হয়ে যায়, সেখানে রাষ্ট্র মেরামতের
কাজ চলছে বলে দলবাজদের থামিয়ে রাখা যাবে কি না সন্দেহ আছে।
স্বৈরাচারের সহযোগীদের
কাছে প্রচুর অর্থ। সে অর্থ যে সৎকাজে ব্যবহার হবে এটা কল্পনাতীত। দলকানা স্বৈরাচারের
সহযোগীরা বন্যায় লাখ লাখ মানুষের সহযোগিতায় পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে সেই অর্থ দিয়ে রাষ্ট্র
মেরামতে বাধা সৃষ্টি করবে, নিজেদের রক্ষা করবে, শিক্ষার্থী-জনতা সাধারণ মানুষের ভাগ্য
পরিবর্তনের যে সুযোগ সৃষ্টি করেছে তা ধ্বংস করতে ব্যবহার করবে। তাদের মধ্যে অনেকেই
আজ স্বৈরাচারের প্রবল প্রতাপে সহযোগী হতে বাধ্য হয়েছে বলে দাবি করলেও নিজেরাও যে ব্যক্তিস্বার্থে
ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, সিন্ডিকেট পরিচালনা করে দলবাজি করেছে, মোসাহেবি করেছে সে
সত্য মিথ্যা হয়ে যাবে না। কারণ দেশে এমন একটা পেশাজীবী পাওয়া যাবে না যারা রাজনৈতিক
মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণ করে অর্থবিত্তের মালিক হয়নি। তাই দেশের
সব শ্রেণি-পেশার মানুষের রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্তি বন্ধের উদ্যোগ জরুরি। শুধু ছাত্ররাজনীতি
নয়, পাশাপাশি শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, কৃষিবিদসহ সব পেশাজীবীর প্রত্যক্ষ
রাজনীতি বন্ধে নির্দেশ জারি জরুরি। দেশের সব পেশাজীবী সংগঠন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত
হওয়ার কারণে পেশার অধঃপতন লক্ষণীয়ভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
শিক্ষার্থী-জনতার
সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিকে নিজের অবস্থান
জানিয়েছেন, রাষ্ট্র মেরামতের কাজ শুরু করেছেন। সাধারণ মানুষ মনে করে রাষ্ট্র মেরামতের
কাজ প্রতিটি ক্ষেত্রে আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরের পরিকল্পনা গ্রহণ সামনে রেখে করা হলে তবে
তারা ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখাতে পারবে। সাধারণ মানুষ এ সরকারের কাছে সেই স্বপ্নের
একটা ছবি দেখতে চায়। তাই মানুষের আশা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যনিরাপত্তা, সাংবিধানিক
প্রতিষ্ঠান, আইন প্রশাসন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, পরিবেশ, অর্থনীতি ইত্যাদি
প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশবিদেশে থাকা সব শ্রেণি-পেশার বিশেষজ্ঞ নিয়ে রাষ্ট্র মেরামতের সুপারিশমালা
তৈরির উদ্যোগ গৃহীত হোক; তা হলেই সংস্কারের একটা সামগ্রিক গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হতে
পারে। তা হলেই অন্তত বিগত সরকারের মতো শিক্ষা কমিশন গঠন করে তাদের সুপারিশ দেখার আগেই
জেলায় জেলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা দিয়ে কমিশনকে অপমান করা হবে না,
শিক্ষাব্যবস্থায় স্বপ্নে পাওয়া কোনো কিছু বাস্তবায়ন বন্ধ হবে।
দেশের মানুষের মেধার চরম বিকাশের সুযোগ নিশ্চিতকরণের বৈশিষ্ট্যসহ মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের কর্তাব্যক্তিদের পদপদবি পাওয়ার পর বিশাল বহর নিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বিদেশে নিয়মিত যাওয়া বন্ধ হবে, দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কার হবে। সব ক্ষেত্রে বিদেশনির্ভরতা কমানোর সব জরুরি উদ্যোগ গৃহীত হবে। শিক্ষার্থী-জনতা সাধারণ মানুষের সামনে যে সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে তার প্রকৃত সুফল প্রতিজন নাগরিকের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে সরকার সব মত ও পথের বিশেষজ্ঞদের ব্যবহার করবেÑএটাই প্রত্যাশা।