সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:২৭ এএম
‘আমদানি করা খেলনায়
বিষাক্ত ধাতু’ শিরোনামের প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ৪ অক্টোবর প্রকাশিত সংবাদটি আমাদের
উদ্বিগ্ন না করে পারে না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে শিশুদের জন্য আমদানি করা বিভিন্ন
খেলনায় বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ‘শিশুদের খেলনায় ভারী ধাতু’ শীর্ষক গবেষণায়
যে তথ্য উঠে এসেছে তা শিশুস্বাস্থ্য তো বটেই, সামগ্রিকভাবে জনস্বাস্থ্যের জন্যও উদ্বেগজনক।
৩ অক্টোবর রাজধানীর লালমাটিয়ায় সংবাদ সম্মেলনে গবেষণালব্ধ এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা
হয়। ‘এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন’ (এসডো) ও ব্যান টক্সিকস্,
ফিলিপাইন যৌথভাবে এ গবেষণা পরিচালনা করে। দেখা গেছে, রাসায়নিক পদার্থমুক্ত নয় আমদানি
করা কোনো খেলনাই এবং এর দোকানগুলোও।
গবেষকরা শিশুদের
১৫০টি খেলনার নমুনার ওপর পরীক্ষা করে দেখেছেন পারদ, সিসা, ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিকসহ এমন
অনেক ক্ষতিকর পদার্থ রয়েছে যা খেলনার মাধ্যমে শিশুদের শরীরে প্রবেশ করে স্বাস্থ্যঝুঁকির
কারণ হয়ে উঠছে। শিশুরা পুতুল বা যেকোনো ধরনের খেলনা পছন্দ করতেই পারে এবং এটাই তাদের
স্বভাবজাত। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, খেলনাসামগ্রীর মধ্যে পুতুল সব থেকে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকির
কারণ। এমনকি শিশুদের হাতে শিক্ষা উপকরণ হিসেবে প্লাস্টিকের বর্ণমালা থেকে শুরু করে
যেসব সামগ্রী তুলে দেওয়া হচ্ছে তা-ও স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক। এসব সামগ্রী থেকে শিশুর
স্নায়ু ও শ্বাসযন্ত্রের পাশাপাশি অন্যান্য অংশেও বড় ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। ভবিষ্যৎ
প্রজন্মকে অদৃশ্য হুমকি থেকে মুক্ত করতেই হবে।
জানা গেছে, চীনসহ
যেসব দেশ থেকে এ ক্ষতিকর খেলনাসামগ্রী আমদানি করা হয়, সেসব দেশের সরকার এসব খেলনা তাদের
শিশুদের ব্যবহার করতে দেয় না। অথচ তারা এগুলো রপ্তানি করছে! আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে
রাষ্ট্রীয়ভাবে আমদানি নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা
সৃষ্টির বহুমুখী জোরদার প্রয়াস চালানো জরুরি। তা ছাড়া যেসব খেলনায় এ ধরনের ক্ষতিকর
বিষাক্ত ধাতুর উপস্থিতি রয়েছে, সেসব আমদানি বন্ধ করা প্রয়োজন। শিক্ষাসামগ্রী হিসেবে
ব্যবহৃত প্লাস্টিকের উপকরণগুলো শিশুর স্কুলব্যাগ পর্যন্ত বিষিয়ে তুলছে এবং এর বিরূপ
প্রভাব শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য আরও ক্ষতির কারণ হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছেÑআমরা কোন পরিস্থিতিতে
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঠেলে দিচ্ছি। নিকট অতীতে ভিন্ন আরেকটি গবেষণায় জানা যায়, শিশুখাদ্যেও
তাদের প্রলুব্ধ করতে স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ খেলনা প্যাকেটে ভরে দেওয়া হচ্ছে।
আমরা দেখছি- চিপস, চকলেট, ওয়েফারসহ নানা ধরনের প্যাকেটজাত শিশুখাদ্যের মধ্যে এমন খেলনাগুলো
শিশুদের আকর্ষণ করতে দেওয়া হয়। বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির নানা রকমের শিশুখাদ্য রয়েছে
এবং বিক্রি বাড়াতে এসব শিশুখাদ্যের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে যে খেলনা দেওয়া হচ্ছে নানা মাধ্যমে
এর বিজ্ঞাপনও প্রচারিত হয়। দেশি-বিদেশি প্রায় সব শিশুখাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রেই এ ধরনের
ঘটনা ঘটছে।
শিশুদের অধিকাংশ
খেলনা তৈরি হয় প্লাস্টিক থেকে এবং এ খেলনাগুলো আকর্ষণীয় করতে যে ধরনের উপকরণ ব্যবহৃত
হয় তা বিষ বৈ কিছু নয়। আমরা জানি, এ প্রেক্ষাপটেই শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খেলনায়
রাসায়নিক পদার্থ নিষিদ্ধ করতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আইন প্রণয়নের পদক্ষেপ নেয়। শিশুদের মস্তিষ্ক
পূর্ণাঙ্গভাবে বিকাশের আগেই রাসায়নিক পদার্থ-সংমিশ্রিত নানা ধরনের খেলনার সংস্পর্শে
এসে তারা যে স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়ছে, এ নিয়ে উদাসীন থাকার অবকাশ আছে বলে আমরা মনে
করি না। নিউরোটরিক্স পদার্থ শিশুদের বিকাশমান মস্তিষ্কের জন্য মারাত্মক ধরনের ক্ষতিকর
তা-ও উঠে এসেছে ভিন্ন আরেকটি গবেষণায়। নিকট অতীতে সংবাদমাধ্যমে এ সম্পর্কে সতর্কবার্তা
প্রকাশিত-প্রচারিত হওয়ার পরও এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে না পাওয়ায় আমরা
বিস্মিত, যুগপৎ উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না।
আমরা জানি, আমাদের
বাজার ভেজাল খাদ্যপণ্যে সয়লাব। এখন দেখা যাচ্ছে শুধু খাদ্যপণ্যই নয়, শিশুদের ব্যবহার্য
জিনিসপত্র কিংবা খেলার সামগ্রীতে ক্ষতিকারক রাসায়নিকের উপস্থিতি রয়েছে এবং এ ব্যাপারে
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কোনো মহলেরই শিরঃপীড়া পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমরা মনে করি, এই উদাসীনতা
চরম আত্মঘাতের শামিল। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য চরম ঝুঁকির মুখে রেখে আমরা আরও কী
ভয়াবহ বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার পথ করে দিচ্ছি তা ভাবতে গেলে বিস্ময় জাগে।
আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে আর বসে থাকার সময় নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের ভবিষ্যৎ
প্রজন্মের বেড়ে ওঠার পথে অনেক প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতা বিদ্যমান। শিশুদের স্বাস্থ্যগত
দিক তো বটেই, মানসিক বিকাশের যথোপযুক্ত ব্যবস্থাও বহু ক্ষেত্রেই নেই। সার্বিক পরিস্থিতির
বিশ্লেষণে বলা যায়, আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে যে অবস্থায় রেখেছি এর ভবিষ্যৎ পরিণতি
অত্যন্ত ভয়ংকর।
রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা
কিংবা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপে ঘাটতির পাশাপাশি পারিবারিক ক্ষেত্রেও সচেতনতার যথেষ্ট অভাব
পরিলক্ষিত হয়। দেখা যাচ্ছে, শিশুর স্বাস্থ্য কিংবা মনোবিকাশের অন্তরায় এমন অনেক কিছু
ঘটছে পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমেই অজ্ঞানতা কিংবা অসচেতনতার কারণে। শিশুর খেলনা নিয়ে
গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে এরপর সরকারসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কোনো পক্ষেরই আর উদাসীন
থাকা কিংবা সময় ক্ষেপণের অবকাশ আছে বলে আমরা মনে করি না। শিশুস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ
খেলনাগুলো আমদানি বন্ধের পাশাপাশি শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে
পারে এর জন্য যূথবদ্ধভাবে প্রয়াস চালানো জরুরি। আজকের যে শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ, তার
স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ মানসিক বিকাশে পরিপূর্ণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেই হবে। আমরা মনে
করি, এসব ব্যাপারে শুধু সরকার কিংবা সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহলগুলোরই নয়, একইসঙ্গে
সমাজ ও পরিবারের প্রতিনিধিদেরও কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিষাক্ত ধাতু
কিংবা অন্য রাসায়নিক পদার্থমিশ্রিত খেলনা আমদানির পথ রুদ্ধ করতে হবে। যেসব শিশুর খেলনার
প্রতি অধিক আগ্রহ রয়েছে তাদের ব্যাপারে পারিবারিকভাবে অধিকতর সচেতন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করা বাঞ্ছনীয়। একইসঙ্গে নিরাপদ শিশুখাদ্যপণ্য নিশ্চিত করার ব্যাপারেও মনোযোগ
গভীর করতে হবে। যে খেলনা শিশুর আনন্দের সঙ্গী সেই খেলনা যেহেতু আত্মঘাতের কারণ হয়ে
দাঁড়িয়েছে, সেহেতু এসব সামগ্রী শিশুর নাগালের বাইরে যাতে থাকে এ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার
দায় কমবেশি সব পক্ষেরই।