সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:৫৪ পিএম
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৭৯তম অধিবেশনের বক্তৃতায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে ভাষণ দিয়েছেন তাতে তার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের নতুন ভূমিকা বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপনের পাশাপাশি আমাদের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের নানা দিক তুলে ধরে ভবিষ্যতের পরিকল্পনাও উপস্থাপন করেছেন। আমরা মনে করি, তার এই ভাষণ নতুন আঙ্গিকে বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপিত করেছে। আমাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সমস্যাগুলো নিরসনের প্রস্তাবের পাশাপাশি আরও কিছু দূরদর্শী পরিকল্পনা উপস্থাপিত হয়েছে তার ভাষণের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি উদারনীতি, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর মানুষের গভীর বিশ্বাসের যে বিষয়গুলো উপস্থাপন করেছেন এর সবই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল অনুষঙ্গ।
চলমান বৈশ্বিক সংকট নিরসনের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে এর বাস্তবায়নের ওপরও তিনি জোর দেন। বাংলাদেশের তারুণ্য মানুষের স্বাধীনতা-অধিকার-মর্যাদা সমুন্নত রাখার যে অভিপ্রায়ের প্রকাশ ঘটিয়েছে তা যে মোটেও কোনো উচ্চাভিলাষ নয়, বরং বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার এবং শান্তি, সমৃদ্ধি ও ন্যায়বিচারের পথ সুগম করার নজির সৃষ্টি করেছে- তাও তিনি বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করেন। আমরা জানি, বর্তমান বিশ্ব একটি গ্লোবাল ভিলেজ অর্থাৎ বিশ্ব গ্রামের সেতুবন্ধ আরও জোরদার করার প্রয়াসে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে পরিকল্পনা ও দেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে সংস্কার কার্যক্রমের বিষয়গুলো বিশ্বমঞ্চে তিনি অকপটে তুলে ধরেছেন। উন্নয়নশীল দেশ থেকে পাচারকৃত সম্পদ ফেরাতে সহায়তা বাড়ানোর ওপরও তিনি জোর দিয়েছেন। আমাদের জন্য অন্যতম সংকট রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যাপারেও বিশ্বমঞ্চে বিষয়টির সামগ্রিক দিক আলোচনা করে প্রধান উপদেষ্টা আমাদের নিরাপত্তাঝুঁকির কারণগুলোও তুলে ধরেছেন। তাদের প্রত্যাবাসনে চেয়েছেন আন্তর্জাতিক সহায়তা। একই সঙ্গে জলবায়ু সংকট মোকাবিলা ও অর্থনীতি সুসংহতকরণে তিনি যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তাও বিশ্বমঞ্চে সমাদৃত হয়েছে। এক কথায় পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘে তিনি তার ভাষণের মধ্য দিয়ে শুধু নতুন বাংলাদেশকেই তুলে ধরেননি ভবিষ্যতের বাংলাদেশ বিনির্মাণের পাশাপাশি সংস্কার ও অবাধ নির্বাচনের লক্ষ্যে পথরেখার বিষয়েও উদারভাবে কথা বলেছেন।
আমরা দেখছি- ফিলিস্তিন সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিশ্বের আরও বিভিন্ন দেশে মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য চরম অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হচ্ছে। ন্যায়বিচার ও মানুষের অধিকার নিশ্চিতের ওপর তিনি যে গুরুত্বারোপ করেছেন তা বর্তমান সময়ের আলোকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্রের নতুন যাত্রায় বিশ্বকে পাশে চায় বাংলাদেশ- এও তার উন্মুক্ত আহ্বান। তরুণদের জন্য করণীয় সম্পর্কে তিনি যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন তাও সময়ের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলেই আমরা মনে করি। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বমঞ্চে তার যে খোলাখুলি বক্তব্য তা নিঃসন্দেহে একটি নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। বর্তমান বাংলাদেশ ৫৩ বছরের বদলে যাওয়া বাংলাদেশের বর্ধিত রূপ। এখানে দাঁড়িয়েই ভবিষ্যতের বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে পরিকল্পনা অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারের মাধ্যমে রয়েছে আমরা বরাবরই এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে আসছি। আমরা মনে করি, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সমতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে আত্মপ্রকাশের যে অভিপ্রায় রয়েছে তা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা আরও ব্যাপক ও গভীরতর করার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না।
নতুন যাত্রাপথে বাংলাদেশের পাশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বকে পাশে চেয়েছেন। নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে নতুনভাবে বিশ্বসম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত হওয়ার তার যে আহ্বান, তাতে যে অভূতপূর্ব সাড়া মিলেছে- তাও সংবাদমাধ্যমের খবরে স্পষ্ট। জাতিসংঘ এমন একটি বিশ্বমঞ্চ, যে মঞ্চ থেকে বহুমুখী কার্যক্রম বিশ্বের মানুষের শান্তি ও কল্যাণের জন্য পরিচালিত হচ্ছে। ভজাতিসংঘের সঙ্গে আমাদের ৫০ বছরের সম্পর্কের মাত্রা এখন নানা কারণেই অনেক বেশি গভীর। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা বিশ্ব-আসরে প্রশংসিত। ৭৯তম অধিবেশনে যোগদান করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অনেক বিশ্বনেতা ও প্রতিষ্ঠান প্রধানের সঙ্গে খোলামেলা যে আলোচনা করেছেন তা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট ইতিবাচক প্রভাব রাখবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। আমরা মনে করি, নতুন প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক সম্পর্ক উন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন ধারায় যে কার্যক্রম শুরু করেছে তাও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। স্মরণীয় প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে এই মুহূর্তে বহুপাক্ষিক সম্পৃক্ততা বাড়ানোর বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে উপলব্ধি করেছে তাও যথার্থ বলেই আমাদের মনে হয়।
জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারত্বের বিষয়টি কেবল পেছনে ফিরে দেখার আনুষ্ঠানিক পর্ব নয়। বরং বিশ্বমঞ্চে আরও টেকসই ও প্রভাবশালী বাংলাদেশকে তুলে ধরার যে সুবর্ণ সময়ের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে, তা আমাদের জন্য একটি বড় সুযোগ। অতীতে যেসব সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে সেসব সুযোগকে আবারও কাজে লাগিয়ে কার্যকরভাবে ব্যবহার করার কৌশল নির্ধারণ করাই মুখ্য বিষয়। সম্পর্কের ভিত্তি আরও মজবুত হোক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।