সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:৫৪ পিএম
আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎসের অন্যতম রেমিট্যান্স কিংবা প্রবাসী আয়। ২৬ সেপ্টেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ রেমিট্যান্স নিয়ে বিশেষ আয়োজনে যে চিত্র উঠে এসেছে তা আশাব্যঞ্জক। বলা হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। আমরা জানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিম্নগামী হচ্ছিল নিকট অতীতের ধারাবাহিকতায়। কিন্তু স্বস্তির বার্তা হলো, দীর্ঘ সময় ধরে ধারাবাহিক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিম্নগামিতা থেমেছে প্রবাসী আয় বৃদ্ধির কারণে। ডলার সংকটও কাটতে শুরু করেছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রবাসী আয় আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদদের কিছু সুপারিশ রয়েছে যা প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর বিশেষ আয়োজনে উপস্থাপিতও হয়েছে। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টদের অভিমত, বর্তমানে প্রবাসীরা যে পরিমাণ অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন এর অন্তত ৯০ শতাংশ বৈধ পথে আনতে পারলে রেমিট্যান্স প্রবাহে জোয়ার সৃষ্টি হবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার ও রিজার্ভ চিত্র আরও উজ্জ্বল হবে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের সূত্র উল্লেখ করে আরও বলা হয়েছে, হুন্ডি ও অন্যান্য মাধ্যমে রেমিট্যান্সের বড় অঙ্কই হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, যার বার্ষিক মোট পরিমাণ প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার।
গাণিতিক
হিসেবে প্রবাসীদের দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের অর্ধেকই দেখা যাচ্ছে পাচার অর্থাৎ হাতছাড়া
হয়ে যাচ্ছে। প্রবাসী আয় হুন্ডিচক্রের গ্রাসমুক্ত করতেই হবে এই তাগিদ গত মার্চ মাসে
প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনেই দেওয়া হয়েছিল। একসময় আমাদের শ্রমবাজার মূলত মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক
সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা অনেক ছড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, মালয়েশিয়া
এবং আরও অনেক দেশেই শ্রমবাজার বর্তমানে বিস্তৃত হলেও দেশের রেমিট্যান্স বা প্রবাসী
আয়ের প্রধান উৎসগুলোতে শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে হুন্ডিচক্রÑ এই তথ্যও ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল।
আমাদের জনশক্তি রপ্তানি যে হারে বেড়েছে, সে হারে বাড়েনি প্রবাসী আয়। আমরা জানি, সরকার
প্রবাসী আয় বাড়াতে নানারকম প্রণোদনা দিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি
বিশেষায়িত কয়েকটি ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ দেশের টালমাটাল অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে
নিঃসন্দেহে সুখকর বার্তা। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা ২ হাজার
১৬১ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন, যা ছিল এ যাবৎকালের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
বিশ্বব্যাংক-নোমার্ডের প্রতিবেদনে নিকট অতীতেই আমরা জেনেছিলাম, আন্তর্জাতিক মুদ্রা
তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তাবলি পালনের কারণে আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেল প্রবাসীদের
আস্থা ফেরায় আয় বৃদ্ধিতে প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে।
আমাদের
এও অজানা নয়, অতিরিক্ত প্রণোদনা দেওয়ার ফলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রায় শুরু থেকেই ব্যাংকিং
চ্যানেলে প্রবাসীদের আয় বাড়তে শুরু করলেও মধ্যে আবার কিছুটা ভাটাও পরিলক্ষিত হয়। এই
প্রেক্ষাপট সৃষ্টির পেছনে শুধু বৈশ্বিক সংকটই দায়ী ছিল না, অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও কম
নেতিবাচকতার সৃষ্টি করেনি। এই প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা
কিছু পরামর্শ উপস্থাপন করেছিলেন এবং একই সঙ্গে তারা এই প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেছিলেন,
সার্বিক ব্যবস্থাপনা যদি সুচারু করা যায় তাহলে এর সুফল দৃশ্যমান হতে বাধ্য। তাদের অভিমতের
সঙ্গে সহমত পোষণ করে এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা বলেছিলাম, যেসব উপসর্গ বৈদেশিক মুদ্রা
অর্জনের প্রতিবন্ধক হিসেবে বিদ্যমান, সেগুলোর দ্রুত নিরসন ঘটিয়ে সেবার পথ সুগম করতে
হবে।
শেখ
হাসিনা সরকারের পতনের পর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত রেমিট্যান্সে জোয়ার সৃষ্টির
বার্তাও উঠে এসেছে বিশেষ আয়োজনেই। জানা গেছে, সেপ্টেম্বরের প্রথম তিন সপ্তাহে রেমিট্যান্স
এসেছে ১৬৩ কোটি ৪২ লাখ ডলার অর্থাৎ দৈনিক গড়ে এসেছে প্রায় ৭ কোটি ৭৮ লাখ ২০ হাজার ডলার।
রেমিট্যান্স প্রবাহ বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, সৌদি আরব থেকে গত ২৫ মাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স
এসেছে। রেমিট্যান্স আসার ক্ষেত্রে বিকাশ অন্যতম বড় ভূমিকা পালন করছে। এই মাধ্যমটি সেবার
মান যেভাবে সুবিন্যাস্ত করেছে, সেভাবে দেশের ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম প্রবাসীদের জন্য
আরও অনুপ্রেরণামূলক করার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে হবে। সচেতনতা সৃষ্টির
পাশাপাশি প্রবাসীদের বৈধ পথে তাদের আয় দেশে পাঠাতে উৎসাহিত করার ব্যবস্থাও সরকারি পর্যায়েই
নিতে হবে। প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে হুন্ডি এবং অন্য কিছু মাধ্যম যে অভিঘাত ফেলছে, এর
নিরসনে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রবাসী আয় হুন্ডিচক্রের গ্রাসমুক্ত করতে পারলে এর
আরও ইতিবাচক প্রভাব যে অর্থনীতিতে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ছুটির
দিনেও যেন প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেন সেই ব্যবস্থা রাখার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের
তরফেই উঠে এসেছে। তারা প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স
আনার পথও বাতলে দিয়েছেন। আমরা মনে করি, তাদের সুপারিশগুলো আমলে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। একজন
প্রবাসী রেমিট্যান্স পাঠানোর পর তা উত্তোলন করতে গিয়ে গ্রহীতা যদি উন্নতমানের সেবা
পান, তাহলে বৈধ পথে প্রবাসী আয় প্রেরণকারীর সংখ্যাও বাড়তে থাকবে। আমাদের দূতাবাসগুলোকে
নতুন নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধানেও মনোযোগ বাড়াতে হবে। তা ছাড়া দক্ষ কর্মী বিদেশে পাঠানোর
পরিসর বাড়াতে হবে। কারণ, বিশ্বের শ্রমবাজারে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। দূতাবাসগুলোকে
গভীরভাবে নজর রাখতে হবে, প্রবাসীরা যাতে কোনো কারণে হেনস্থার শিকার না হন। একই সঙ্গে
কর্মসন্ধানী মানুষদের বিদেশে যেতে বৈধ পথ অবলম্বন করতে হবে। অবৈধ পথে বিদেশ পাড়ি দেওয়ার
বহুমাত্রিক ঝুঁকি কতটা প্রকট, এর নজির তো কম নেই। অভিবাসীদের একটি বড় অংশ মূলত নিম্নবিত্ত
ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। তাদের অনেকেরই সচেতনতার অভাবের পাশাপাশি দেশে বৈধভাবে
আয় পাঠানোর ব্যাপারেও অজ্ঞতা রয়েছে। তা ছাড়া যে মাধ্যমে তারা মুনাফা বেশি পান, সেদিকেই
ধাবিত হবেনÑ এটাই স্বাভাবিক। আমাদের অভ্যন্তরীণ কিছু ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে হুন্ডি
ব্যবসায়ীরা সুযোগটি নিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর আরও গভীর করতে হবে,
যাতে ব্যাংক বা বৈধ মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে তুলনামূলক কম খরচে ও যথাযথ মুদ্রার বিনিময়
প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে প্রবাসীরা তাদের আয় পাঠাতে পারেন।
পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের
যূথবদ্ধ প্রয়াসে সৃষ্ট নতুন প্রেক্ষাপটে দূরদর্শী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে চ্যালেঞ্জ জয়ের
পথ মসৃণ করতে হবে। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সুশাসন। আমরা জানি, বিগত সরকারের আমলে আর্থিক
খাতে বিশৃঙ্খলা চরম পর্যায়ে পৌঁছে ছিল এবং অন্তর্বর্তী সরকার শৃঙ্খলা ফেরাতে ইতোমধ্যে
নানারকম কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে বাস্তবায়নে মনোযোগ দিয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, হুন্ডির
পথ রুদ্ধ করে রেমিট্যান্সে জোয়ার সৃষ্টির সব রকম পদক্ষেপ নেওয়া হবে, সময়ক্ষেপণ না করে।