পর্যবেক্ষণ
ড. ফরিদুল আলম
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:৫১ পিএম
জাতিসংঘের
৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ
ইউনূস। এমন একটি সময়ে এ সফর, যখন বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্ণ
করল। জাতিসংঘ অধিবেশনে মহাসচিবসহ কর্মকর্তারা বাংলাদেশের নতুন সরকারপ্রধানকে উষ্ণ অভিনন্দন
এবং শুভেচ্ছা জানান। এবারের সফরটি আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রুটিনমাফিক
যোগদানের উদ্দেশ্যে হলেও এর বাইরের কর্মসূচিগুলো বাংলাদেশের জন্য, বিশেষ করে নতুন সরকারের
জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য সময়ে আমরা দেখি জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগদানের উদ্দেশ্যে
নিউইয়র্কে অবস্থানরত রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানরা অধিবেশনের ফাঁকে সাইডলাইন বৈঠকে নিজেদের
মধ্যে কুশলাদি বিনিময় করেন, ক্ষেত্রবিশেষ দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশের
ক্ষেত্রেও আগের সময়ে এমন অনেক সাইডলাইন বৈঠক হয়েছে। তবে এবারের সফরে ড. ইউনূস খুব
গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে বিশ্বনেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা
করেছেন। এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রেই চলে আসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে তার
আনুষ্ঠানিক বৈঠকের বিষয়টি। সচরাচর জাতিসংঘের অধিবেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে
এ ধরনের দ্বিপক্ষীয় আলোচনার রেওয়াজ না থাকলেও বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের আহ্বানে সাড়া
দেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে প্রায় ৩০ বছর পর স্বল্পপরিসরে হলেও দুই নেতার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ
বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এ বৈঠকগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
এবং দেশের বিনির্মাণে এর ইতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান হবে আশা করা যায়। বাংলাদেশ এক নতুন
অধ্যায়ে পদার্পণ করেছে, যে অধ্যায় থেকে দেশের মানুষ আশা করে বৈষম্যের ছায়া সরে সাম্যের
আলোই শুধু ছড়াবে না, অনাচার-দুরাচারেরও নিরসন হবে।
ড.
ইউনূস একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, সেই সঙ্গে মার্কিন রাজনীতিতে অত্যন্ত
পরিচিত একজন। তাকে কাছে পেয়েই বুকে টেনে নিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করেন জো বাইডেন। বিষয়টি
কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে আটকে ছিল না, এখানে না-বলা অনেক কিছুই উচ্চারিত হলো!
বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যে টানাপড়েন, তা মার্কিন
সরকারকেও খুব ভাবিয়ে তুলেছিল। এ সম্পর্ক কীভাবে গভীর করা যায়, বিশেষ করে দুই দেশের
মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্কের বাইরেও যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিক
নীতি এ অঞ্চলে অনেকটা হোঁচট খাচ্ছিল বাংলাদেশের কারণে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক
নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অস্বস্তি না থাকলেও চীনের সঙ্গে ক্রমাগতভাবে কৌশলগত সম্পর্কে জড়িয়ে
পড়া, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে ছিল। এটা একটা বাস্তবতা। তা ছাড়া এর বাইরে
প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র, সুশাসন এবং মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের
পক্ষ থেকে বারবার যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পরামর্শ এড়িয়ে চলা, নির্বাচন একপক্ষীয় করে ফেলা,
ইত্যাকার বিষয় যুক্তরাষ্ট্রকে চরম মাত্রায় বিষিয়ে তোলে বাংলাদেশের ওপর। এসব বিবেচনায়
বলার অপেক্ষা রাখে না, পূর্ববর্তী সরকারের পতনে যুক্তরাষ্ট্রের আহ্লাদিত হওয়ার সঙ্গত
কারণ থাকবে। সেই সঙ্গে তাদের পছন্দের একজন ব্যক্তি রাষ্ট্র সংস্কারের প্রত্যয় নিয়ে
সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন। সেদিক বিবেচনায়ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কাঠামো আরও মেরামত
করার সুযোগ থাকে। আশা করা যাচ্ছে, নতুন প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের গতি সেদিকেই গড়াচ্ছে।
বাইডেন ড. ইউনূসকে যে আশ্বাস-প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা এরই স্পষ্ট ইঙ্গিতবহ।
জো
বাইডেন ড. ইউনূসের কাছ থেকে বাংলাদেশের বর্তমান সংস্কার প্রক্রিয়া এবং সরকারের ভাবনা
সম্পর্কে অবহিত হলেন। এর পরই তিনি এক কথায় জানিয়ে দিলেন বাংলাদেশ সরকার গৃহীত সব কাজের
প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সমর্থন অব্যাহত থাকবে। স্বল্পপরিসরের আলোচনায় বিস্তারিত
বিষয় উঠে না এলেও ধারণা করা যায়, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের
কাছে একগুচ্ছ দাবি আকারে একটি প্যাকেজ পেশ করা হতে পারে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে
দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়া। কিছুদিন আগে
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এবং মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ও মার্কিন
অর্থ দপ্তরের একটি উচ্চ পর্যায়ের সফরে সরকারের উন্নয়ন কাজের সহায়তা হিসেবে ২০০ মিলিয়ন
ডলারের অতিরিক্ত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় বাবদ আরও ১৯৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রাপ্তির বিষয়
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা হয়েছে আন্তর্জাতিক
মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধানের। আইএমএফ বাংলাদেশকে তাদের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুত ঋণসহায়তা
বৃদ্ধির অঙ্গীকার করেছে।
বিশ্বনেতৃবৃন্দের
মধ্যে ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে কানাডা, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নেপাল ও পাকিস্তানের
প্রধানমন্ত্রীর। সাক্ষাৎ হয়েছে কুয়েতের যুবরাজের সঙ্গেও। সবার সঙ্গে বৈঠকে ড. ইউনূস
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিষয়টি অবহিত করেন। বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে আইএমএফ ছাড়াও
জাতিসংঘ মহাসচিব এবং জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। তার
কর্মব্যস্ত সময়ের মধ্যে তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থীসংক্রান্ত বাংলাদেশের আয়োজনে একটি বৈঠকে
যোগ দেন। এ আয়োজনটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বিভন্ন দেশের
প্রতিনিধি তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা,
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী উজরা জেয়া আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর
সঙ্গে এ নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার পরামর্শ দেন। মিয়ানমার যেহেতু আসিয়ানভুক্ত দেশ এবং আসিয়ানের
অন্য দেশগুলোও এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী, সে বিবেচনায় এটি একটি কার্যকর উদ্যোগ হতে পারে
বলে তিনি মনে করেন। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের তৃতীয় দেশে পুনর্বাসিত করার বিষয়টিও গুরুত্ব
পেয়েছে। একই দিনে তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি উৎসবে যোগ দিয়ে আগত বিশ্বনেতৃবৃন্দকে
স্বাগত জানান। এ সময় তিনি এ দীর্ঘ ৫০ বছর সময়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে এতদিনের
ভূমিকা তুলে ধরেন। তার আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পায় জাতিসংঘ শান্তিমিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের
বিষয়টি এবং আগামী দিনগুলোয় বিশ্বশান্তি রক্ষায় জাতিসংঘের যেকোনো উদ্যোগে বাংলাদেশের
সমর্থনের দিকটি পুনর্ব্যক্ত করেন।
সফরের
প্রথম দিন ড. ইউনূস আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টে যোগ দেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট
বিল ক্লিনটনের উদ্যোগে ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তার
বক্তব্য দেন। এ সময় তিনি হল ভর্তি দর্শকের সামনে মার্কিন জনগণের কল্যাণে তার অনুসৃত
গ্রামীণ ব্যাংক কীভাবে ভূমিকা পালন করছে তার বিবরণ দেন। সেই সঙ্গে আরকানসাস অঙ্গরাজ্যের
গভর্নর থাকাকালে বিল ক্লিনটন এবং হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে কীভাবে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠল
এবং আজ পর্যন্ত তা চলমান রয়েছে এর বর্ণনা দেন। একই সঙ্গে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৩টি
অঙ্গরাজ্যে ১৫০ কোটি ডলারের গ্রামীণ আমেরিকান কার্যক্রমের কথা তিনি তুলে ধরে জানান,
আগামী ১৫ বছরের মধ্যে তা ৪০০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে। এ অনুষ্ঠানে তিনি সাম্প্রতিক সময়ে
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কেও কথা বলেন এবং এ আন্দোলন সংগঠিত হয়ে একটি পরিকল্পিত
প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হয় বলে অবগত করেন।
ভারতের
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ড. ইউনূসের সাক্ষাৎ না হলেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র
উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। এ সাক্ষাতে দুই দেশের পক্ষ
থেকেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে একমত প্রকাশ করা হয়। তবে উল্লেখ্য,
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠকে পাকিস্তানের পক্ষ
থেকে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অচলাবস্থার কথা উল্লেখ করে এটি পুনরুজ্জীবিত
করার উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এর আগেও আমরা দেখেছি সরকার পরিবর্তনের পর থেকে
বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে এ বিষয়ে তৎপর হতে এবং এও জানা গেছে যে,
পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে
বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকে সরকারের অনুসৃত নীতি বাস্তবায়নে সহযোগিতার আশ্বাস
পাওয়া গেছে। এ সফরে বহু কাঙ্ক্ষিত আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ড. ইউনূসের পক্ষ থেকে
কিছুটা ধারণা পাওয়া গেছে। আইএমএফপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকে তিনি সরকারের চলমান সংস্কারের
নিমিত্ত ছয়টি কমিশন গঠনের বিষয়ে জানিয়ে অবহিত করেন যে, এ সংস্কার প্রক্রিয়া কার্যকর
হলে এবং এ নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা সাপেক্ষে আগামী নির্বাচন আয়োজন করা হবে।
সবশেষে বিশ্বশান্তি এবং নিরাপত্তার লক্ষ্যে ১৯৪৫ সালে যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, নানা বৈশ্বিক সংঘাতে জাতিসংঘের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকলেও এ বিশ্বফোরামটি বিশ্বনেতৃবর্গের একটি মিলনক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত। ওখানে এবারের সম্মেলনে বৈশ্বিক নানা বিষয়ের মধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার সংকটসহ নানাবিধ বিষয় নিয়ে যেমন আলোচনা হয়েছে, সদস্য দেশগুলো এর বাইরে বিভিন্ন দেশ এবং ফোরামের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কটাও ঝালাই করে নিতে সচেষ্ট থেকেছে। বিশেষ করে এবারের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের মাধ্যমে নতুন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অল্প সময়ের মধ্যে অনেক বিশ্বনেতা এবং সংস্থার প্রধানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তার সরকারের ধারণা আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন। এর ফলে আগামী দিনের সরকার পরিচালনায় এটি অনেক সহায়ক হবে বলে মনে করি। ৫৩ বছরের বাংলাদেশকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিয়ে যেতে না পারার দায় রাজনীতিকরা এড়াতে পারেন না। স্বাধীনতা-উত্তর প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক সরকারের আমলেই কমবেশি অনাচার-দুরাচার হয়েছে। এর যেন পুনরাবৃত্তি না হয় শুভবোধসম্পন্ন সবার প্রত্যাশা তা-ই।