× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি মেনে নিতে পারি দুই কারণে

আনু মুহাম্মদ

প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২২ ১২:৫১ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

গত জুন মাসে পাইপলাইনে সরবরাহ করা প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের পাইকারি দাম ৯ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়িয়ে ১১ টাকা ৯১ পয়সা করা হয়। এর ফলে খুচরা পর্যায়ে সেই মূল্য সমন্বয় করে যানবাহনে ব্যবহারের সিএনজি বাদে সব পর্যায়েই গ্যাসের খরচ বেড়ে যায়। এর বিরূপ প্রভাব আমাদের এখনও নানাভাবে বিড়ম্বনার কারণ হিসেবে জিইয়ে আছে। এর আগে সরকারের নির্দেশে বিইআরসি যখন গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছিল তখন আমরা বলেছিলামÑএটি গণশুনানিতে প্রদত্ত তথ্য, যুক্তি এবং প্রাপ্ত ফলাফলের পরিপন্থি। ওই দামবদ্ধির পর প্রধানমন্ত্রীর জ¦ালানি উপদেষ্টা বলেছিলেন, দেশে গ্যাস সংকটের কারণে তেলনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, সেজন্য দাম বাড়াতে হয়েছে। এই বক্তব্য সঠিক ছিল না। কারণ প্রথমত, গ্যাস সংকটের জন্য নয় বরং রাষ্ট্রীয় কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সরবরাহ না করে বেশি ব্যয়বহুল বিভিন্ন বেসরকারি বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের গ্যাস সরবরাহের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। আমরা জানি, সম্প্রতি বিশ^বাজারে তেলের দাম কমছে। কিন্তু বাংলাদেশে তা কমানো হয়নি। তেলের দামের ক্ষেত্রে সরকারের ‘সমন্বয়’ আর ‘যৌক্তিকীকরণের’ কথা শোনা যায় না। অথচ তেলের দাম যৌক্তিকভাবে সমন্বয় করলে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ও অনেক কমত। 

২২ নভেম্বর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়াতে না বাড়াতেই খুচরায় দামবৃদ্ধির তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে এও বলা হয়েছে, সরকার বলছে ভোক্তাপর্যায়ে এখনই দাম বাড়ানো হবে না। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ২১ নভেম্বর ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দেয়। ইউনিটপ্রতি ৫ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ২০ পয়সা করা হয়। এই বৃদ্ধির হার প্রায় ২০ শতাংশ। এবার আরেক দফা পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পর বিতরণকারী কোম্পানিগুলো খুচরা পর্যায়েও দাম বাড়ানোর তৎপরতা শুরু করেছেÑএই খবরও মিলেছে সংবাদমাধ্যমে। ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি নামে একটি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে গ্রাহকপর্যায়ে দামবৃদ্ধির আবেদন করেছে। আমরা জানি, দেশে জনজীবন নানামুখী চাপে আছে। বৈশি^ক মন্দার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে। আমাদের দেশেও খাদ্যসংকটের আশঙ্কা রয়েছে এমনটি সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে এবং মানুষকে ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আমরা জানি, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিসহ নানা কারণে জনজীবন স্বাভাবিকভাবে চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু এই বাস্তবতা কতখানি আমলে রাখা হচ্ছে এবং সরকারের দায়িত্বশীলরা এই বিষয়গুলো কোনো না কোনোভাবে স্বীকার করলেও কার্যত জনগণকে চাপমুক্ত রাখতে কিংবা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে কতটা জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছেন, এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। 

নিকট অতিতে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী সত্যকথাই বলেছিলেন। তিনি স্পষ্ট করেছিলেন, ভবিষ্যতে বেশি ব্যয়বহুল পথে তারা যাবেন বলেই আগে থেকেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। সরকার তার মহাপরিকল্পনা (পিএসএমপি ২০১৬) অনুযায়ী দেশের গ্যাস অনুসন্ধান স্থগিত করে যখন এলএনজি-কয়লা আমদানির পথ ধরেছিল এবং ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে যাচ্ছিল তখন অনেক বিশেষজ্ঞই বলেছিলেন, পথটি সঠিক নয়। ‘তেল-গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’ কম দামে পরিবেশসম্মতভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিকল্প মহাপরিকল্পনা উপস্থিত করা সত্ত্বেও তাতে কান না দিয়ে সরকার তার মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুৎ খাতকে ক্রমাগত কিছু দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর অতি মুনাফার ব্যবসার খাতে পরিণত করছে। তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়েই বারবার বাড়ানো হচ্ছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম। বারবার গ্যাস-বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি অর্থনীতির জন্য বোঝা হচ্ছে, সকল পর্যায়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়াচ্ছে। সর্বশেষ এই দামবৃদ্ধিতে সকল পর্যায়ে আরেক দফা উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, বাড়বে বাসা ভাড়াসহ অন্য সব দ্রব্যসামগ্রীর দাম, বাড়বে শিল্পকৃষি পণ্যের দাম, কমবে দেশের অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা ক্ষমতা। 

চাতুরী করতে সরকার বিশ্বব্যাংকওয়ালাদের কাছ থেকে দুটো শব্দ শিখেছে, একটি হলো দাম সমন্বয় আরেকটি দাম যৌক্তিকীকরণ। অতিতে আমরা দেখেছি, সরকারের দায়িত্বশীলরা প্রায়ই বেশ ‘জিতে গেলাম’ ভাব নিয়ে বলে থাকেন আমরা তো দাম বাড়াইনি, সমন্বয় করেছি বা যৌক্তিক করেছি মাত্র। এদের কথাবার্তা শুনে আর কাজ দেখে মনে হয় সমন্বয় আর যৌক্তিকীকরণের সমার্থক শব্দ দামবৃদ্ধি। তথ্য কিংবা যুক্তি যাই বলুক দাম বাড়ানোই সরকারের কাজ। সর্বজনের অর্থের অপচয় করে বানানো হয়েছে বিইআরসি। সেখানে গণশুনানিতে যুক্তি তথ্যে নিকট অতীতে প্রমাণিত হয়েছিল বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নয় বরং কমানো উচিত এবং তা সম্ভব। কিন্তু সরকারের আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া, দাম বাড়াতেই হবে! এখন খুচরা পর্যায়েও দাম বাড়ানোর যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে এই প্রেক্ষাপটে পরিষ্কার করেই বলতে চাই, সংকটকালে জনগণের ওপর আর চাপ বাড়াবেন না। 

কিছুদিন আগে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয় বিশ্ববাজারে দামবৃদ্ধিও অজুহাত দেখিয়ে। আগামী বছরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম আরও কমবে এমনটিই বলা হয়েছে ইআইএর প্রক্ষেপণে। প্রশ্ন হচ্ছে, দাম বাড়লে ‘সমন্বয়’ হয়, কমলে হবে না কেন? প্রথমদিকে বাংলাদেশে লাফিয়ে লাফিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে। উচ্চব্যয়ের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুতের বোঝা সৃষ্টির কারণে। যেহেতু আমদানিকৃত তেলের দাম কমেছে সেহেতু এখানেও উৎপাদন ব্যয় অনেক কমানো সম্ভব। কিছুদিন আগে সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহলের তরফে বলা হয়েছিল, আগের বছরগুলোর লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার জন্য তেলের দাম কমানো হয়নি। প্রথমত, যে বছরগুলোতে লোকসান দেখানো হয়েছে সেখানেও অনেক বছরে সরকারের আদায়কৃত শুল্ক হিসাব করলে লোকসান থাকে না। দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতার পর এতদিনে কোনো রিফাইনারি করা হয়নি। সেজন্য পরিশোধিত তেল আমদানি করতে গিয়ে অনেক বেশি অর্থব্যয় করতে হয়। তৃতীয়ত, তেলের দাম না কমিয়ে সরকার সেই আয় অন্য ক্ষেত্রে গর্ত ভরাট করছে। সরকার তেলের দাম কমিয়ে তা কার্যকর করলে বিনিয়োগ, উৎপাদনশীলতা, পরিবহন ও জীবনযাত্রায় ইতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান হতো। আমরা অতীতেও দেখেছি, তেলের দাম হ্রাস পাওয়ার সুফল অর্থনীতিতে দেওয়ার সুযোগ সরকার গ্রহণ করেনি। সরকারের কোষাগারে যে আয় বেড়েছিল, সেই আয় কোন কোন খাতে ব্যয় হলো তা জানার অধিকার দেশের জনগণ রাখে।  

বারবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে এই যুক্তিতে যে, এই বর্ধিত আয় দিয়ে ‘গ্যাস উন্নয়ন তহবিল’ বাড়বে এবং তা দিয়ে দেশের জাতীয় সংস্থাকে বিকশিত করা হবে, জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানো হবে। অথচ জনগণের ওপর বাড়তি বোঝা চাপিয়ে যে ‘গ্যাস উন্নয়ন তহবিল’ করা হলো, সেই টাকার হিসাব জনগণ চাইতেই পারে। ইতোমধ্যে জনগণের দেওয়া বর্ধিত অর্থে ‘গ্যাস উন্নয়ন তহবিল’ নামক ফান্ডে বহু হাজার কোটি টাকা জমা হয়েছে এমন কথাও অতীতে শোনা গেছে। প্রতি বছর গ্যাস খাত থেকে সরকার রাজস্ব পায় ৫ হাজার কোটি টাকা, উন্নয়ন তহবিলে আসে সুদসহ ১ হাজার কোটি টাকা। পেট্রোবাংলাসহ বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে এফডিআর হিসেবে অলস পড়ে থাকে। অথচ টাকার অভাবের কথা বলে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির বদলে তা সংকোচনেরই ভূমিকা নিতেই দেখা গেছে। বাপেক্সকে বাদ দিয়ে দ্বিগুণ খরচে বিদেশি কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার অভিযোগও নতুন নয়। বাপেক্সকে যেন বানানো হচ্ছে সাবকন্ট্রাক্টর। বিদেশি কোম্পানিকে আরও গ্যাসক্ষেত্র দেওয়া হবে এমন কথাও শোনা যায়। যদি তাই হয় তাহলে তাদের কাছ থেকে উচ্চদামে গ্যাস কেনা হবে, আর বাপেক্স কম পয়সায় তাদের সব কাজ করে দেবে। 

শুধু বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি কেন আমরা তেল-গ্যাসের দামবৃদ্ধিও মেনে নিতে পারি দুই কারণে। এক. যদি চুরি, দুর্নীতি বা জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি ছাড়া যৌক্তিকভাবে উৎপাদন খরচ বাড়ে, দুই. যদি বর্ধিত দাম থেকে প্রাপ্ত অর্থ জাতীয় সক্ষমতা এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আরও টেকসই আকারে আমাদের কাছে ফেরত আসে। বর্ধিত দাম দিতে নাগরিক হিসেবে আমরা রাজি হতে পারি যদি দেখি তা দিয়ে জাতীয় সক্ষম একটি ভিত্তি নির্মাণ করা হচ্ছে যার ফলে দীর্ঘমেয়াদে দেশের মানুষই লাভবান হবে। কিন্তু যদি দেখি এই দুটোর একটিও নয়, যদি আমরা দেখি দাম বাড়ানো হচ্ছে জনগণ ও অর্থনীতিকে বিপদগ্রস্ত করে মহলবিশেষের পকেট ভরার জন্য এবং দীর্ঘমেয়াদে এই খাত আরও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, তাহলে দামবৃদ্ধি কেন আমরা মানব? এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেব না কেনো? আর যেখানে সুলভ, নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথ আছে সেখানে পরিবেশধ্বংসী, ঝুঁকিপূর্ণ, ব্যয়বহুল পথে দেশ কেন যাবে?   

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা