সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:৩০ এএম
সেই কবে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার ‘ছাড়পত্র’ কবিতায় লিখেছিলেন,
‘...এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;/জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে/চলে
যেতে হবে আমাদের।/চলে যাবÑ তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/এ
বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমিÑ/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার…।’ কিন্তু
পৃথিবীর অনেক দেশে-সমাজেই শিশুর বাসযোগ্য জমিনের পরিসর বাড়েনি আজও। আমরাও যে এর বাইরে
নই, এরই ফের সাক্ষ্য মিলেছে ২৫ সেপ্টেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে। ২৪ সেপ্টেম্বর
ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম সংবাদ সম্মলনে কন্যাশিশুর
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণমূলক যে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেছে তাতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়,
সমাজে অন্ধকার এখনও অনেক গাঢ়!
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের তথ্যানুযায়ী গত জানুয়ারি থেকে
আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে ২২৪ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হওয়ার পাশাপাশি ধর্ষণচেষ্টার শিকার
হয়েছে ৩২ জন। একক ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পাশাপাশি প্রেমের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে
৩৫টি। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে ১৩৩ জন এবং ধর্ষণের পর হত্যার শিকার
হয়েছে ৮১ কন্যাশিশু। এখানেই শেষ নয়। অপহরণ ও পাচার হয়েছে আরও ১৯ জন এবং একই সময়ে অন্তত
১০ জন কন্যাশিশু গৃহশ্রমিক বহুমাত্রিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। জাতীয় কনাশিশু অ্যাডভোকেসি
ফোরামের উপস্থাপিত তথ্য আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই ইতঃপূর্বে
আমরা বলেছিলাম, দেশের নাগরিক সমাজের নিরাপত্তা বিশ্লেষণে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা,
জীবনধারণে সমাজের দায়বদ্ধতা এবং রাষ্ট্রের করণীয় খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বয়সগত বৈশিষ্ট্য
বিবেচনায় শিশুরা পরনির্ভরশীল এবং জীবন ও স্বাধীনতায় কেউ বিরুদ্ধাচরণ করলে প্রতিবাদ
কিংবা প্রতিরোধের সক্ষমতা তাদের যথেষ্ট নয়। নির্যাতন, হত্যা, নিপীড়নসহ শিশুকেন্দ্রিক
প্রায় সব সহিংসতার পেছনে মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করে শিশুর বয়স, সক্ষমতার প্রশ্ন, সরলতার
গতিময়তা ও অল্পতে ভীত হওয়ার আশঙ্কা।
সাম্প্রতিক সময়ে শিশু হত্যা-নিপীড়ন, ধর্ষণ ও বহুমাত্রিক নির্যাতনের
হার কীভাবে বেড়েছে উপস্থাপিত তথ্যটি এরই চিত্র। শিশু হত্যাসহ সব নির্যাতন বন্ধে সব
দেশেই আইনি কাঠামো বিদ্যমান এবং বৈশ্বিক সংস্থাগুলো চাপ প্রযোগ ও প্রতিবেদন প্রকাশ
করে চলমান অবস্থা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট দেশকে সতর্ক করে এবং ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী করে
তোলে। নারী-শিশু নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধে আমাদের দেশের আইনি কাঠামো কোনোভাবেই দুর্বল
নয় বটে, কিন্তু তারপরও অন্ধকার দূর হচ্ছে না। আমাদের সমাজে শিশু বিশেষ করে কন্যাশিশুরা
অনেক ক্ষেত্রে সার্বিক দুরবস্থার পশ্চাতে বহুবিধ কারণ ও প্রেক্ষাপট চলমান। আমাদের শিশুরা
বেড়ে ওঠার সঠিক পরিবেশ ও সমর্থন পরিবার ও সমাজ থেকে কতটা নায্যতার ভিত্তিতে পায়, তা
বিতর্কিত ভূমিকায় আলোচিত।
শিশু হত্যা-ধর্ষণসহ তাদের নিরাপত্তাহানিজনিত যেসব কারণ বিদ্যমান এর
নিরসনে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি ত্বরিত আইনি পদক্ষেপের কোনো বিকল্প নেই।
এ রকম অন্ধকার জিইয়ে রেখে বিকাশমান সমাজের স্বপ্ন দেখা অলীক কল্পনা মাত্র। পরিণত বয়সের
মানুষ তো বটেই, একজন শিশু কতটা বৈরী পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়
তা খুব সহজেই অনুমেয়। আমরা মনে করি, এই কদর্যতার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার
পাশাপাশি আইনানুগ প্রতিকার-প্রতিবিধানের ব্যবস্থা জোরদার করা বাঞ্ছনীয়। এ ধরনের সংবাদ
কোনোভাবেই স্বস্তি দেয় না এবং এও সত্য, অনেক ঘটনা সংবাদমাধ্যমে উঠেও আসে না। বিদ্যমান
বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন দাঁড়ায়, ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের বিভীষিকা
আর কত। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারে পথ সুগম করার দাবি অনেক পুরোনো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও
সত্য, অতীতে আমরা লক্ষ করেছি, আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রাথমিক পর্যায় থেকে ভুক্তভোগীকে
যে প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে এগোতে হয়, এই প্রেক্ষাপটে একপর্যায়ে অনেকেই
শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচারের প্রত্যাশাই ছেড়ে দেন।
আমরা মনে করি, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংস করে এবং সামাজিক অবক্ষয়ের
কারণ হয়ে দাঁড়ায় এমন সবকিছুর পথ রুদ্ধ করতে না পারলে জিইয়ে থাকা অন্ধকার দূর করা কঠিন।
বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দূরীভূত হবে, তাও আমাদের
খুব স্বাভাবিক প্রত্যাশা। এই সঙ্গে আমাদের প্রত্যাশা যেকোনো অপরাধের দৃষ্টান্তযোগ্য
বিচারে যেন আর সময়ক্ষেপণ করা না হয়। সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নৈতিকতা ধ্বংসের যে
চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে শিশু ধর্ষণ ও হত্যার বিষয়টিও এর বাইরে নয়। ধর্ষণ হলো সমাজের
সেই গুরুতর ব্যাধি, যা বিকারগ্রস্ত কতিপয় লোককে গোটা সমাজের জন্য হুমকি হিসেবে দাঁড়
করিয়ে রাখে। এদের মূলোৎপাটন করতেই হবে।