পর্যবেক্ষণ
খুশি কবির
প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:২৯ এএম
খুশি কবির
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন এক পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ছোট
দাবি-দাওয়ার আন্দোলন বড়পর্যায়ে চলে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিগত ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা
আওয়ামী লীগ সরকারকে সরে যেতে হয়েছে। ওই আন্দোলনে ছাত্ররা ছিল প্রধান ভূমিকায়। আন্দোলনে
স্পষ্ট রূপরেখাও ছিল না যে সরকারের দায়িত্ব কে নেবে। ঊনসত্তরের
গণঅভ্যুত্থান,
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলন
এগুলোর রূপরেখা ছিল যে কীভাবে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হবে।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী দায়িত্ব নেয়।
তাদের লক্ষ্য ছিল পরে একটি জাতীয় নির্বাচন দেওয়া। সেই অন্তর্বর্তী সময়ে
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিলেন। ছাত্রদের সঙ্গে
শিক্ষকদের একটা সম্পর্ক ছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরও একটা সুনির্দিষ্ট
নেতৃত্ব ছিল। এরশাদের পতনের পরও প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ দায়িত্ব
নিয়েছিলেন,
একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। সংগতই নেতৃত্বের কোনো শূন্যস্থান ছিল না, যা এই গণঅভ্যুত্থানে ছিল। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ৮ আগস্ট রাতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। তখন
নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশ মাঠপর্যায়ে থাকার কথা বললেও তাদের সেভাবে দেখা যায়নি। দেশের অনেক স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে অরাজকতা দেখা
দিলেও সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
যেকোনো আন্দোলনের পর অ্যানার্কি বা অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক,
যদি না এটা নিয়ন্ত্রণ করার সুস্পষ্ট একটা ব্যবস্থা থাকে।
শিক্ষার্থীরা ওই আন্দোলনের কৃতিত্বের দাবিদার। অবশ্যই তারা
আন্দোলন না করলে এ অবস্থাতে আসত না। একটা সরকার ১৫ বছরের বেশি জোর
করে ক্ষমতায় থাকবে,
কোনো বিরোধী দল থাকবে না, সরকারের
জবাবদিহি থাকবে নাÑ এমনটি গণতন্ত্রের জন্য
সুষ্ঠু অবস্থা হতে পারে না। মূলত শিক্ষাঙ্গনের দিকে তাকালেই আমরা দেশের গণতান্ত্রিক
রাজনৈতিক বৈষম্যের বড় প্রতিফলন দেখতে পাব। আমরা দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পার্টিজান হয়ে
গিয়েছিলেন। এমনটি শুধু আওয়ামী লীগের আমলেই নয়, যে রাজনৈতিক দলের সরকারই ছিল, সেই দলের শিক্ষকরাই সব সুবিধা পেয়েছেন। অন্য কোনো পক্ষ পাননি। বিএনপির আমলেও এমনটি ছিল। তবে বিগত আওয়ামী
লীগ সরকারের আমলে বেশি ছিল, কারণ
তারা সময় বেশি পেয়েছিল। বিএনপি পাঁচ বছর পেয়েছিল, আওয়ামী
লীগ ১৫ বছর পেয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পর সংগত কারণেই বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকদের শিক্ষার্থীরা
জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন। এমনটি কাম্য নয়। এ নিয়ে উদ্বেগ
প্রকাশ করে আমরা বিবৃতিও দিয়েছি। শিক্ষার্থীরা যেন পড়াশোনায় ফিরে আসতে পারেন
এবং পাশাপাশি তারা দেশের পট সম্পর্কে সজাগও থাকেনÑএমন সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিও বিভিন্ন মহলের। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা তেমনটি
সব ক্ষেত্রে প্রত্যাশানুযায়ী দেখতে পাচ্ছি না।
একটি গণঅভ্যুত্থানে
নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের একাংশ নিজেই জড়িয়ে পড়েছেন নানা বিতর্কিত ঘটনায়। আমরা দেখেছি,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজির খবর সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। দেশের
সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামে এক
মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে হত্যা করেছেন। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে
শিক্ষাঙ্গনটির সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
ওই ঘটনাতেও একজন সমন্বয়কও জড়িত রয়েছেন বলে জানা গেছে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত
ঘটনা আরও ঘটেছে। যিনি ওই মামলার বাদী তিনি নিজেও আওয়ামী সরকার আমলে শিক্ষার্থীদের ওপর
হামলার আসামি ছিলেন বলে জানা গেছে। অথচ অভিযুক্ত সমন্বয়ক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে
অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন বলেও জানা গেছে। কিন্তু আইনের চোখে তিনি এখন একজন অপরাধী।
এমনটি হওয়ার পেছনের কারণ কি? এর মূল কারণ এখনও শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে
ওঠেনি। সারা দেশে শিক্ষার্থীরা এখন নানাক্ষেত্রে অবদান রাখার চেষ্টা করছেন। ফলে দেশের
নানা ঘটনায় তারা সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে তা বিতর্কও তৈরি করছে। তাই শিক্ষাঙ্গনে
সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।
অন্তর্বর্তী সরকার যেন দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
যেন ফিরে যেতে পারে একটা সুষ্ঠু পরিবেশে, তা নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া
এবং করণীয় সবকিছু করা দরকার। এখন যে যে মূল বিষয়গুলো দরকার, একটা
হলোÑ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা, যেটা এখনও পুরোপুরি
আসেনি। দ্বিতীয় হলো,
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাব্যবস্থাকে সঠিক জায়গায় নিয়ে আসা, কিন্তু
সেটা এখনও আসেনি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং সংখ্যালঘু জাতিসত্তাকে ঘিরেও
সম্প্রতি যে ধরনের নেতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাও শঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে। কেউ
কারও সঙ্গে একমত না-ই হতে পারে। এটা ধর্মভিত্তিক, জাতিগত,
ভিন্ন চিন্তাধারার,
ভিন্ন অবস্থানের কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমের হতে পারে। আবার হতে পারে তারা জাতিগতভাবে বাঙালি না, কিন্তু
তাতে কি। মূল বিষয় হচ্ছে যে, আমাদের
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চারটি মূলনীতি পেয়েছি সংবিধানে।
এই মূলনীতি ভুলে যাওয়া, অবহেলা করা কোনোক্রমেই চলবে না। অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের চার
মূলনীতির বিরাট একটা স্তম্ভ এবং গণতন্ত্র আরেকটা। গণতন্ত্র মানে যারা আসছেন ক্ষমতায় তাদের কাছেই সবাই জবাবদিহি করবে, সেটা
নয়। জনগণের কাছে স্পষ্টভাবে সবকিছু স্বচ্ছ করা, জবাবদিহি নিশ্চিত করাই হলো মূল বিষয়।
জননিরাপত্তা নিশ্চিত
করা অত্যন্ত জরুরি। আমরা দেখছি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনও নানা কারণে যথাযথভাবে
আইনপ্রয়োগ করতে পারছে না। নানা সংকটের কারণে তাদের সক্রিয় করাও সম্ভব হয়নি। ফলে মব
জাস্টিস, নারী নির্যাতন কিংবা নানা ধরনের অপরাধ বেড়েই চলেছে। বিশেষত মব জাস্টিস এবং
গুপ্তহত্যা বিগত কয়েক দিনে বেড়েছে। সম্প্রতি পুলিশে সংস্কার শুরু হওয়ার আশ্বাস মিলেছে।
কিন্তু তা আরও আগে শুরু করা জরুরি ছিল। জননিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির
মুখে পড়ে নারীরা। আমরা জানি দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী নিরাপত্তা সব সময় ঝুঁকিতে।
জননিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে মানবাধিকার ঝুঁকির মুখে থাকবেই। নারী শিক্ষার্থীরা
অস্থিতিশীল বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে শঙ্কিত। সড়কে বিশৃঙ্খলার কারণে তারা গণপরিবহনে চলাচল
করতে ভয় পাচ্ছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কার্যকর না থাকায়
অনেক ভুক্তভোগী হেনস্থার অভিযোগও করতে পারছে না। তা ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থার জটিলতার কারণে
নতুন বছরের শিক্ষার্থীদেরও সংকটে পড়তে হবে। আন্দোলনের কারণে শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপক
ক্ষতি হয়েছে। তা পুষিয়ে নিতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। একটা গোটা
বছর শিক্ষার্থীরা পাঠদান থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এসব কিছুর বিরূপ
প্রভাব তাদের ওপর পড়তে বাধ্য। জননিরাপত্তা ও শিক্ষাব্যবস্থা এই দুটো ক্ষেত্রে সরকারের
দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
আমরা দেখছি, যারা
ক্ষমতায় আসছেন তারা একটা শিক্ষাপদ্ধতি দিচ্ছে। নতুন কেউ এলে আরেকটি হয়তো আসবে। কবি সুফিয়া কামাল,
কবি গোলাম মোস্তফা, কবি শামসুর রাহমান, রবি
ঠাকুরের কবিতা বাদ দিয়েছিল কয়েক বছর আগে একটি রাজনৈতিক সরকার। তারপর
আন্দোলন হয়। এমনটা তো বারবার হয়, তারপর আন্দোলন হয়, তারপর
অন্তর্ভুক্তি হয়Ñএসব তো শিক্ষার্থীদের সমস্যায় ফেলছে। এটার সমাধানে বিজ্ঞানভিত্তিক
দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাচ্চাদের জন্য কী দরকারÑ তাদের গড়ে তোলার জন্য, তাদের
শিক্ষা দেওয়ার জন্য,
জ্ঞান দেওয়ার জন্য, এটা খুবই প্রয়োজন। হুট করে
আগের সরকার এটা করেছে বলে এই সরকার এটা গ্রহণ করবে নাÑ
এই ধরনের নীতি কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়, বাস্তবসম্মতও নয়। অন্তর্বর্তী
সরকারের কাছে অন্যতম চ্যালেঞ্জের একটি হলো, পুলিশের
দায়িত্বশীল অনেকের বিতর্কিত চরিত্রের পরিবর্তন। পুলিশে বড়ধরনের
সংস্কার জরুরি। গণহারে পুলিশ আগের মতোই মামলা করছে। সাধারণ জনগণের
ধারণা হলো,
এই মামলাগুলো আপাতত আসামিদের আটকানোর জন্য দেওয়া হচ্ছে। পরে
সময়-সুযোগ বুঝে প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতে মামলা করা হবে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, একজন
ব্যক্তির বিপক্ষে করা একটি ভুল বা দুর্বল মামলা, সেই ব্যক্তির বিপক্ষে
প্রকৃত মামলা দুর্বল করে দিতে পারে। সাধারণ জনগণ এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দিন শেষে
মামলার প্রক্রিয়া এবং গুণমান (মেরিট) নিয়ে প্রশ্ন উঠবে এবং আদতে দোষী ব্যক্তির
খালাস পাওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি হবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী-সম্পর্কিত আরেকটি বিষয় হলো মব জাস্টিসকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার ব্যর্থতা। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও সতর্কতা খুব প্রয়োজন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য কর্তৃত্বমূলক শাসনের অবসান। ইতোমধ্যে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক সমন্বয়ক তাদের সমন্বয়ক পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন শুধু এই শঙ্কা থেকেই। কিন্তু এখনও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বয়ক পদ রয়েছে এবং এ নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। সব মিলিয়ে জটিলতার অনেক বৃত্ত রয়ে গেছে যা ভেদ করতে হবে। সাম্যের আলো ছড়িয়ে বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে হবে। সবার অধিকার সমান তা মনে রাখতে হবে। স্থিতিশীলতা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা এখনও বিদ্যমান।