পুতিনের আগ্রাসন
ড. মইনুল হাসান
প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:২১ এএম
ড. মইনুল হাসান
১ জুন, ২০২৪। প্যারিসের
আকাশে সবে সূর্য উঠতে শুরু করেছে। শীত যাই যাই করেও যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই, সকালে বেশ ঠান্ডা
থাকে প্যারিতে। রাজপথে তখনও উপচে পড়া ভিড় জমে ওঠেনি। কোথাও কোলাহল নেই, চারদিকে
শান্ত পরিবেশ। ঘড়ির কাঁটা সকাল ৮টার ঘর ছুঁয়েছে মাত্র। আশপাশের ক্যাফে শপগুলোয়
পরিচারিকারা মুখে স্নিগ্ধ হাসির প্রলেপ মেখে ব্যস্ত হাতে কফি পরিবেশন করে যাচ্ছে।
মচমচে ক্রোয়াসাঁর সঙ্গে ধূমায়িত কফির কাপে বিলাসী চুমুক দিয়ে অনেকেই খবরের কাগজের
শিরোনামগুলোয় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন। দুটি-একটি যন্ত্রচালিত নৌযান সেন নদীর পানিতে
উঁচুনিচু ঢেউ তুলে চলাচল শুরু করেছে। কবোষ্ণ উজ্জ্বল প্রভাতে পৃথিবীর নানা প্রান্ত
থেকে নানা ভাষাভাষী দর্শনার্থীর ভিড় জমতে শুরু করেছে আইফেল টাওয়ারের পাদদেশে। হঠাৎ চারদিকে সচকিত করে অনেক
পুলিশের গাড়ি তীব্র শব্দে সাইরেন বাজিয়ে, নীল আলোর ঝলকানিতে আইফেল টাওয়ারের চারদিক ঘিরে ফেলেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় পথচারী, দর্শনার্থীরা
বিস্মিত, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অনেকটা বিমূঢ়। অনুমান করেছেন, খুব কাছেই কিছু একটা অঘটন
ঘটেছে। পুলিশ বাহিনীর সুসজ্জিত সদস্যরা তাদের আশ্বস্ত করে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দিল। চারদিকে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা।
কে বা কারা পাঁচটি কফিন
আইফেল টাওয়ারের নিচে রেখে গেছে। নীল, সাদা, লালÑতিন রঙা ফরাসি পতাকায় ঢাকা প্রতিটি
কফিনের ওপর ধাতব প্লেটে খোদাই করে লেখা ‘ইউক্রেন রণাঙ্গন থেকে ফেরত ফরাসি সেনা’। মৃতদেহহীন কফিনের উৎস অনুসন্ধানে গোয়েন্দা
পুলিশ তৎপর হয়ে ওঠে এবং প্যারিস নগরী ঘিরে চারদিকে কড়া প্রহরা মোতায়েন করে। গোয়েন্দারা খুব
দ্রুত কফিন বহনকারী গাড়িসহ তিন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। তিনজনই স্বীকার করেন কিছু অর্থের বিনিময়ে
তারা এ কাজটি করেছেন। পুলিশ নাটের গুরুকেও সন্দেহাতীতভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।
ক্রেমলিনের ভাড়া করা একজন চর ঘটনাটি ঘটিয়েছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনের পক্ষে
যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য প্রয়োজনে সরাসরি সেনা পাঠানোর কথা ঘোষণার পরপরই ঘটা করে
কফিন ঘটনা ঘটানো হয়। উদ্দেশ্য, প্রেসিডেন্টের এমন ঘোষণায় জনমতে নেতিবাচক প্রভাব
ফেলা।
এর আগে গত মে মাসের
মাঝামাঝি এক সকালে হলোকাস্ট স্মৃতিসৌধের দেয়ালে ৩৫টি রক্তরঙের হাতের ছাপ দেখতে
পাওয়া যায়। এ নিয়ে সংবাদ ও সমাজ মাধ্যমে বেশ শোরগোল ওঠে, জনমনে প্রশ্ন দেখা দেয়। ২০২৩ সালে
প্যারিসের ইহুদিদের সংবেদনশীল স্থাপনায় যত্রতত্র নাৎসি কায়দায় ডেভিড তারকা অঙ্কন
করা হয়। গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আন্তঃসম্প্রদায়
বিদ্বেষ, বিভেদ এবং সামাজিক সংহতির ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির হীন উদ্দেশ্যে এ ধরনের
ঘটনা ঘটানো হয়। প্রতিটি ঘটনার সঙ্গেই গোয়েন্দা পুলিশ রাশিয়ার সম্পৃক্ততার প্রমাণ
পেয়েছে। শুধু যে ফ্রান্সেই এমন সব ঘটনা ঘটেছে তা মোটেও নয়। ইউরোপের অন্য
দেশগুলোকেও এমন সব অনভিপ্রেত ঘটনার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। প্যারিসের কফিন ঘটনার
কয়েক দিন আগেই লন্ডনের অদূরে একটি গুদাম অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয়ে যায়। যুক্তরাজ্যের
গোয়েন্দারা এ নাশকতার জন্য রাশিয়াকে দায়ী করেন। জার্মানির পথে ঘাটে সরকারবিরোধী
মিথ্যা প্রচারণার স্টিকার্সের দেখা মেলে। গোয়েন্দারা তৎপর হলে এর হোতাকে
শনাক্ত করা সম্ভব হয়। ব্যক্তিটি জার্মানিতে অবস্থানকারী রাশিয়ার একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী।
এমন উস্কানিমূলক কাজের জন্য তিনিই অর্থ জুগিয়েছিলেন।
ইউক্রেন থেকে কৃষিজাত
পণ্যের আমদানির সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পোল্যান্ডের কৃষকদের খেপিয়ে তুলতে রুশ
চরদের তৎপরতার কথাও জানা যায়। এ ছাড়া অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস, সুইডেনের
ডানঘেঁষা রাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলনে সরকারবিরোধীদের উদ্দেশ্যমূলক প্রণোদনা প্রদানে রুশ এজেন্টরা
অত্যন্ত সক্রিয়। ইউক্রেনের প্রতি সহানুভূতিশীল ইউরোপীয় সরকার এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে
বিপাকে ফেলার জন্য হাজার হাজার প্রশিক্ষিত এবং সুদক্ষ সাইবার কর্মী ভীষণ সক্রিয়।
এসব সাইবার সৈনিক প্রতিনিয়ত নানা স্পর্শকাতর সামরিক এবং বেসামরিক অবকাঠামো, প্রতিষ্ঠান অচল করে দিতে সদাতৎপর। প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমের পোর্টাল, এমনকি সরকারি লোগো মুদ্রিত পোর্টাল নকল করে মিথ্যা সংবাদ সমাজমাধ্যম এবং
ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
কিছুদিন আগে ফরাসি রাজস্ব
বিভাগের নামে ইউক্রেন যুদ্ধে সহায়তা করতে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সরকার জনগণের ওপর
বাড়তি করের বোঝা চাপাতে যাচ্ছেÑএমন একটি ডাহা মিথ্যা খবর প্রকাশ করা হয়।
ফলে জনমনে অসন্তোষ বাড়ে। এমনিতেই মুদ্রাস্ফীতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে
ইউরোপের দেশগুলোয় জনঅসন্তোষ রয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন, উত্তপ্ত ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ইউরোপীয় রাজনীতির মাঠ অনেকটাই ইতোমধ্যে তুষ্টিবাদী
কট্টর ডানপন্থিদের দখলে চলে গেছে। অভিযোগ উঠেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) চরম ডানপন্থি কিছু
সংসদ সদস্যকে হাত করার জন্য রাশিয়া তাদের সরাসরি উৎকোচ প্রদান করেছে। পুতিনের সাইবার
এজেন্টরা এস্তোনিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, ককেশাস, মলদোভা, কাজাখস্তানের
অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাচ্ছে, জাতীয় সংহতিতে ফাটল ধরাতে নিরন্তর
প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। রাশিয়া ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ
নিয়ে প্রভাব বিস্তারেও চেষ্টা চালায়।
এ বছর ৭ মে ভ্লাদিমির পুতিন
পঞ্চম মেয়াদে নিজেকে ফের রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। আগামী অক্টোবরে পুতিন ৭২
বছর পূর্ণ করবেন। তিনি সেই ১৯৯৯ সাল থেকে ক্রেমলিন প্রাসাদে স্থায়ী আবাস গেড়েছেন। মানবাধিকারের
তোয়াক্কা না করে, দোর্দণ্ড প্রতাপে রাশিয়ার মসনদ নিজের দখলে রেখেছেন। সিকি শতাব্দী যাবৎ তার আমলে এ
দীর্ঘ সময়ে ইতোমধ্যে সাবেক হয়ে গেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, জর্জ বুশ
জুনিয়র, বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। বাইডেনও বিদায় নিতে যাচ্ছেন। বিগত ২৫ বছরে
পুতিন চারজন ফরাসি প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। গণতান্ত্রিক বিশ্বের বহু
রাষ্ট্রপ্রধান ইতিহাস হয়ে গেলেও পুতিন আজও রাশিয়ার ক্ষমতার মসনদ নিজের
দখলে রেখেছেন। নিপুণ দক্ষতায় নিজের চারদিকে একটি অভেদ্য ক্ষমতার বলয় তৈরি করতে
সক্ষম হয়েছেন। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার চর্চা সংকুচিত করে সেখানে দুর্নীতিবাজদের আশকারা
দিয়েছেন এবং স্বৈরাচার, কর্তৃত্ববাদের নিষ্ঠুর রাজত্ব গড়ে তুলেছেন।
নিন্দুকেরা বলে বেড়াচ্ছেন, পুতিন ‘সাংবিধানিক ক্যু’ ঘটিয়ে আশা
করেছেন জীবনের বাকি সময়টুকুও দেশটির শীর্ষ পদটি দখলে রাখবেন।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিনা উস্কানিতে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়েছেন পুতিন। এ যুদ্ধ দিনদিনই তীব্র হচ্ছে। তিনি একটি দীর্ঘস্থায়ী, বিশাল ব্যয়বহুল এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা করেছেন। ইউরোপের দরজায় আড়াই বছরের বেশি এমন ভয়াবহ এবং ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে দুই পক্ষেই বহু মানুষ হতাহত হচ্ছে। এ মুহূর্তে উত্তপ্ত পৃথিবী একটি পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকিতে ধুঁকছে। পুতিন আটকে গেছেন যুদ্ধের অভিশপ্ত এক চক্রব্যূহে। রুশ সাম্রাজ্য পুনঃপত্তনের স্বপ্নে বিভোর পুতিন অপপ্রচার, তথ্যপ্রযুক্তির সব উপায়-উপকরণ ব্যবহার করে এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে নাশকতা, উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যুদ্ধ সম্প্রসারিত করেছেন। উদ্দেশ্যে একটাইÑগণতন্ত্রকে অসার প্রমাণ করা। দেশে দেশে গণতান্ত্রিক সরকারগুলো দুর্বল করা। রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হলেও পরোক্ষভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে আরও অনেক দেশের সঙ্গে। পারমাণবিক অস্ত্রে হাতে রেখে, পর্দার আড়ালে পুতিনের ভয়ংকর খেলা।