কৃষি খাত
ড. মো: হুমায়ুন কবির
প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:০৭ এএম
ড. মো: হুমায়ুন কবির
১১টি জেলা, বিশেষ
করে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন এলাকা প্রবল বন্যায় কৃষিজমি,
বসতবাড়ি পানিতে ডুবে যায়। সাধারণত বন্যা হয় স্বাভাবিক বর্ষাকাল
অর্থাৎ আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে। কিন্তু এবারের বন্যা হয়েছে শরতের শুরুতে। তখন খাল, বিল,
ডোবা, নদী, পুকুর এমনিতেই পানিতে ভরা থাকে। এবার এই সময়ে অধিক বৃষ্টিপাত, সমুদ্রে
নিম্নচাপ, দুর্বল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা, নদী-খাল দখলের কারণে পানি নিষ্কাশন বাধাপ্রাপ্ত
হওয়া এবং তার ওপর ভারত বিনা নোটিসে ত্রিপুরার ডুম্বুর বাঁধ ও অন্যান্য বাঁধের কপাটগুলো
খুলে দেওয়ায় দ্রুত পানির প্রবাহ বেড়ে যায় এবং প্রবল বন্যা হয়ে লাখ লাথ পরিবারকে
পথে বসিয়ে দেয়। তবে এই বন্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশের জনগণের
অংশগ্রহণ রীতিমতো অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এবারের বন্যায় কৃষিতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
বন্যার্ত এলাকার কৃষিকাজ এখনও ঝুঁকিতে রয়েছে। এখন সবচেয়ে বড় কাজ হলো উক্ত এলাকার
কৃষক ভাইদেরকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা প্রদান করা।
১.
বসতবাড়িকেন্দ্রিক কৃষি সহায়তার অংশ হিসেবে তৈরি করা শাকসবজির চারা ও সবজি বীজ সরবরাহ
: বন্যার্ত এলাকায় পানি কমেছে আগেই। সব সময়ই বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে বসতবাড়ির
আশপাশের জায়গাগুলো আগে দৃশ্যমান হবে এবং সেখান থেকেই তারা যাতে তাদের কাজ শুরু করতে
পারে সেই দিকে লক্ষ রাখা জরুরি। এই সময়ে তাদেরকে সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তিগতভাবে
সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য ভাবনা এখনই রাখা বাঞ্ছনীয়। দুর্গতদের
যেহেতু চারা উৎপাদনের সুযোগ নাই, তাই বাইরে থেকে তৈরি সবজির চারা যেমনÑ লাউ, মিষ্টি
কুমড়া, করলা, বরবটি, শিম, টমেটো, কাঁচা মরিচ, চালকুমড়া, বেগুন, ঝিঙ্গা ইত্যাদি পলিব্যাগে
তৈরি করে তাদের সরবরাহ করে সহযোগিতা করতে হবে। সবজির চারাগুলো বসতবাড়ির আঙিনায় এবং
বসতবাড়ির আশপাশে সব উপযোগী জায়গায় লাগাবে। অবস্থাভেদে চারাগুলোকে সরাসরি মাটিতে
গর্ত করে, সিমেন্টের বস্তায়, পলিথিন ব্যাগে, প্লাস্টিকের ক্রেটে, মাটির চাড়িতে, কাঠের
বাক্সে, কাটা ড্রামে, পুরোনো টিনে অথবা কলার ভেলায় লাগানো যাবে। ভাসমান বেড প্রস্তুত
করেও সবজি লাগানো যেতে পারে।
কৃষক ভাইদের সরবরাহের লক্ষ্যে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব খামারে আমরা সবজি চারা উৎপাদন শুরু করেছি, যাতে বন্যার্তদের মাঝে অতিসত্বর বিতরণ করা যায়। একই কাজে আমরা সরকারি-বেসরকারি ও সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। সবজির চারার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের পাতাজাতীয় ও অন্যান্য সবজির বীজ সরবরাহ করতে হবে। এই সময় বসতবাড়িতে স্বল্পমেয়াদি লালশাক, পুঁইশাক, ডাঁটাশাক ইত্যাদি চাষ করা যেতে পারে। আমরা জানতে পেরেছি যে, সরকারি উদ্যোগের অংশ হিসেবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষকদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে। বন্যা-পরবর্তী করণীয় বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তথা কৃষি মন্ত্রণালয় ১২টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। বন্যাদুর্গত এলাকার কাছাকাছি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যানতত্ত্ব কেন্দ্রগুলো তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বীজ সরবরাহের পাশাপাশি চারা তৈরি করে বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করবেন বলে আমরা আশা করছি। এই কাজে আমরা বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান করছি। অনেকেই এই কাজে ইতোমধ্যে জড়িত হয়েছেন। যাদের সামর্থ্য আছে তারা দেরি না করে এখনই নিরাপদ কোনো জায়গায় পলিব্যাগে অথবা বীজতলায় বীজ লাগিয়ে দিন, যাতে সময় হলে চারা সরবরাহ করা যায়।
বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর
প্রয়োজনীয় ধান ও সবজি বীজ সহায়তা: এবারের বন্যায় পাকা আউশ ধান, নতুন করে রোপণ
করা আমন ধান, আমন ধানের বীজতলা, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির ক্ষেত, ফল গাছ, মশলা ও
তেলজাতীয় ফসল পানিতে ডুবে গেছে। পানি সরে যাওয়ার পর স্বল্প জীবনকালীন পাতাজাতীয়
সবজি যেমন লাল ঢাকা শাক পুঁইশাক উৎপাদন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বীজ সরবরাহ করতে
হবে। জমিগুলোতে আগাম রবি মৌসুমের শাকসবজি চাষের দিকে মনোযোগী হতে হবে। আগাম
শীতকালীন সবজি উৎপাদন বিষয়ে সরকারকে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। এই সময়ে জমি কর্দমাক্ত
থাকার কারণে কাদায় হয় এমন ফসল উৎপাদনের দিকে গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। এই
লক্ষ্যে বিনা চাষে লাগানোর উপযোগী মাসকালাই, খেসারি ও সরিষা লাগানোর দিকে নজর
দেয়া যায়। কম খরচে ও কম বিনিয়োগে এটা লাভজনক কৃষি উৎপাদন বাবস্থা।
ধান
হলো আমাদের প্রধান ফসল। এই সময় কৃষকদেরকে
জলামগ্নতা সহনশীল ধানের বীজ সরবরাহ করা প্রয়োজন । আমন ধানের চারা তৈরি করেও সরবরাহ
করা যায় । বন্যায় ক্ষতি মোকাবেলার জন্য এই সময়ে চাষের উপযোগী জাতের আমন ধানের
বীজের পর্যাপ্ত সংস্থান ও সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। ইতোমধ্যে কৃষি পুনর্বাসনে
সহায়তার অংশ হিসাবে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কেন্দ্রীয় খামারে ধানের
চারা তৈরীর উদ্যোগ নিয়েছে। ধানের
বীজতলা তৈরি করে সেখানে ধানের চারা উৎপাদনের কাজ পুরো দমে চলমান আছে । শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্র-ছাত্রী ও নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষক সমাজ এতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে
যাচ্ছে। একই ধরনের কার্যক্রম সরকারি, বেসরকারি, সামর্থ্যবান সবার কাছ থেকে আমরা
প্রত্যাশা করছি। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় এবং বন্যাপরবর্তী কার্যক্রম দক্ষতার
সঙ্গে মোকাবিলায় এনজিও গুলোকে এগিয়ে আসার আহবান জানান এবং এনজিওগুলোর স্থানীয় জ্ঞান
ও দক্ষতা কাজে লাগানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এই আহ্বানের সুফল দৃশ্যমান হয়।
বন্যায় রোপা আমনের বীজতলা পানিতে ডুবে যাওয়ার ফলে জমিতে লাগানো চারা নষ্ট হয়েছে, তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে বীজ না পাওয়ার সম্ভাবনা আছে অর্থাৎ বীজের সংকট হতে পারে। এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বন্যা আক্রান্ত হয় নাই এমন জমির আমন ধানের গাছ থেকে ২-৩ টি কুশি রেখে বাকি কুশি গুলি যত্ন সহকারে শিকড়সহ তুলে এনে বন্যা আক্রান্ত জমিতে লাগানো যেতে পারে। এতে মূল জমির ধানের ফলনে কোন তারতম্য হবে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে প্রয়োজনীয় সার ও অন্যান্য প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা নিতে হবে। চলমান ফসল আমনের পরই আসে বোরো ধানের চাষ। এখনি বোরো ফসল উৎপাদনের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
অর্থনৈতিক সহযোগিতা: বন্যার্ত মানুষেরা সহায় সম্বলহীন নিঃস্ব। তাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন। যে কোন কাজে টাকার প্রয়োজন। টাকা হলো মানসিক শক্তি। সহজে অর্থনৈতিক সংস্থান হলে আমাদের কৃষক ভাইয়েরা ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি খুঁজে পাবে। তাদের জরুরী প্রয়োজন মেটাবার জন্য দিতে হবে নগদ আর্থিক সহায়তা। এই বিষয়ে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। সরকার কিছু আর্থিক প্রণোদনা দিবে বলে আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু তা হয়তোবা পর্যাপ্ত হবেনা । বিভিন্ন এনজিও এ বিষয়ে কৃষকদেরকে সহায়তা করতে পারে। কৃষকদেরকে সুদ মুক্ত বা সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংকগুলোকে এই বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তাছাড়া মনে রাখতে হবে, বন্যা হয়েছে বা হয়ে গেছে এটাই শেষ নয়। ভাটির দেশ হিসেবে বন্যার ঝুঁকি আমাদের সামনে থাকছেই। শুধু ভাটির দেশই নয়, বন্যার আরও অনেক প্রাসঙ্গিক কারণ সামনে রয়েছে। তাই ভাবনা ও প্রস্তুতি সেই নিরিখেই নিতে হবে।
এই কথা অনস্বীকার্য যে, জলবায়ু
পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। এই ঝুঁকিতে
আমাদের কৃষকরা সরাসরি আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই উৎপাদনকারীদের স্বার্থ নিশ্চিতের
লক্ষ্যে শস্যবীমা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিতে হবে। বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কতা বিষয়ে
আমাদের আরও সজাগ হতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। পার্শ্ববর্তী
দেশ যাতে পানি অস্ত্র ব্যবহার করতে না পারে তার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের
প্রেক্ষাপটে বন্যার কারণগুলো স্পষ্টতই চিহ্নিত। যেহেতু কারণ চিহ্নিত সেহেতু
সতর্কতামূলক ব্যবস্থাদি আগাম গ্রহণের ভাবনা রাখতে হবে। প্রায় প্রতিবছরই দেশের কোনো
না কোনো অঞ্চলে বন্যা হয়। বন্যা মোকাবিলায় পৃথক একটি সেল গঠনের কথাও ভাবা যেতে
পারে।
ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন পানি বণ্টন ও বর্ষায় অন্যায়ভাবে যাতে বাংলাদেশে পানি ছেড়ে দিতে না পারে তার বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি আমাদের বন্যা-আক্রান্ত কোনো জমি পতিত রাখা যাবে না। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কোনো না কোনো ফসল লাগাতে হবে। এই কাজে সহযোগিতার জন্য আমরা আমাদের উৎপাদনকারী বা কৃষকদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। চলুন আমরা সবাই এই কাজে অংশগ্রহণ করে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষকে রক্ষা করতে সহযোগিতা করি।