যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সফর
ড. ফরিদুল আলম
প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:২৯ এএম
ড. ফরিদুল আলম
১৪ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর তিন দিনের সফর করে গেলেন
মার্কিন প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের এক প্রতিনিধিদল। সফরটির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক
গুরুত্ব যথেষ্ট। সফরের শুরুতে নেতৃত্ব দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দপ্তরের সহকারী
আন্ডার-সেক্রেটারী বরেন্ট নেইম্যান। একই দিন দিল্লি সফর শেষ করে ঢাকা আসেন
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড
লু। বোঝাই যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক ভাবনার পাশাপাশি অর্থনৈতিক
সংস্কারের কর্মসূচি নিয়ে মার্কিন সরকারের আগ্রহ রয়েছে। এর আগে ডোনাল্ড লু সর্বশেষ বাংলাদেশ
সফর করে গিয়েছিলেন গত মে মাসে। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এটা ছিল তার প্রথম
বাংলাদেশ সফর। লু এর আগে যতবারই বাংলাদেশে এসেছেন তার সফর নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে
বিশেষ আলোচনা ছিল। এর বিশেষ কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের
দৃষ্টিভঙ্গি এবং দুই সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কোন মাত্রায় এবং কীভাবে নির্ধারিত হবে
এসব কিছুতেই লুর ভূমিকা মুখ্য ছিল।
এদিক বিবেচনায় লুর সে সময়ের সফর নিয়ে তৎকালীন
সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের
ব্যঙ্গাত্মকভাবে মন্তব্য করে বলেছিলেন, ‘লু সফরে আসছেন, বিএনপি আবারও চাঙা হয়ে
উঠছে। তারা ক্ষমতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেছে।’ অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে দলটির
মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এর জবাবে বলেছিলেন, ‘লুর সফর নিয়ে আমরা
ইন্টারেস্টেড নই, আমাদের ভরসা জনগণের ওপর।’ সে সময়ের সফর নিয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন
দূতাবাসের তরফ থেকে জানানো হয়েছিল যে, সফরটি নিয়ে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই, বরং
দেশের সুশীলসমাজ ও সরকারি পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লু আলোচনা
করবেন।
সে সময়ের সফরটি নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি
থেকে আরও কিছু পাল্টাপাল্টি মন্তব্য শোনা গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ নেতা আ ফ ম
বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছিলেন, ‘ডোনাল্ড লুর আগমন নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে বিএনপি, এর
সঙ্গে ষড়যন্ত্রের গন্ধ আছে কি না তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না।’ অন্যদিকে বিএনপি নেতা
আসাদুজ্জামান রিপন বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শগুলো মানেনি
সরকার। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র যদি আড়ালে কোনো কিছু করার চেষ্টা করে সেটা সরকারের
জন্য মঙ্গলজনক হবে না।’ এর মধ্যে নদীতে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে সরকার
পরিবর্তন হয়েছে। সেই সঙ্গে এও সত্য যে, বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশের সঙ্গে
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অবনতি হয়েছিল।
এক যুগের বেশি সময় ধরে দেশটি থেকে বাংলাদেশের
জন্য জিএসপি সুবিধা বাতিল হওয়ার পর কয়েক বছর ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর
কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞার পথ ধরে গত বছর বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের
পরিবর্তিত ভিসানীতিÑএ সবকিছুর মূলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বক্তব্য ছিল
বাংলাদেশে নির্বাচন, সুশাসন এবং গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে
যুক্তরাষ্ট্র সরকার যথেষ্ট সন্তুষ্ট নয়। দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে
সম্পর্ক সামনে নিয়ে যেতে হলে বাংলাদেশকে এ বিষয়গুলোর ওপর নজর দিতে হবে। এ নিয়ে গত
দুই বছর সময়ের মধ্যে ডোনাল্ড লু এর আগে অন্তত তিনবার বাংলাদেশ সফর করে সরকারের
কাছে মার্কিন সরকারের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। এর বাইরেও বাংলাদেশে
নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এবং মার্কিন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের
প্রতিনিধিদলের সফরের মধ্য দিয়েও বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়। এত কিছুর পরও বাংলাদেশের সে
সময়ের সরকারের তরফে মার্কিন সরকারের উদ্বেগগুলো নিরসনে কোনো কার্যকর ভূমিকা নেওয়া
হয়নি, উপরন্তু একতরফাভাবে এ বছরের জানুয়ারিতে আরেকটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে
আরেকবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দেশে এবং
বিদেশে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তরফে এতদিন ধরে
খুব একটা বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এ সময়ের মধ্যে নতুন সরকারের সামনে যে
চ্যালেঞ্জগুলো প্রকাশ্যে আসে তা হচ্ছেÑআর্থিক সংস্কার, যার মধ্য দিয়ে সরকার ঘোষিত
রাষ্ট্র সংস্কারের পথে অগ্রসর হওয়া। রাষ্ট্র সংস্কারের ভাবনাগুলো সামনে আসতেই দেখা
যায় বিগত বছরগুলোয় দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় এক চরম নৈরাজ্য হয়েছে। বড় অঙ্কের
বৈদেশিক দেনার পাশাপাশি রিজার্ভের স্বল্পতা, মুদ্রাস্ফীতি, মুদ্রা পাচার এবং
দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের আর্থিক খাতে যে দৈন্যদশা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে বের হওয়া
না গেলে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা কষ্টসাধ্য হবে। বাধাগ্রস্ত হবে রাষ্ট্র সংস্কার
প্রক্রিয়া। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে মার্কিন অর্থ দপ্তরের সহকারী আন্ডার-সেক্রেটারি
জেনারেলের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের সফরটি আমাদের আর্থিক খাত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দিক
থেকে একটা ধারণা নেওয়ার চেষ্টা হিসাবে দেখা যায়।
এ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার
সাক্ষাতের বাইরেও অর্থ ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টার আলাদা বৈঠকের মাধ্যমে বাংলাদেশ
সরকারের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি উত্তরণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কারিগরি সহায়তা
চাওয়া হয়। তাৎক্ষণিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএআইডির পক্ষ থেকে বাংলাদেশে
গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের জন্য ২০০ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সেই সঙ্গে এ দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরিয়ে
আনতে কীভাবে বাংলাদেশকে সাহায্য করা যায় সে বিষয়েও যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদলের
পক্ষ থেকে সরকারকে আশ্বস্ত করা হয়। অতীতেও আমরা দেখেছি, বিভিন্ন দেশ থেকে দুর্নীতির
মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। সে ক্ষেত্রে যে বিশাল অঙ্কের অর্থ
পাচার হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এটা যদি দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়,
দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ গতি সঞ্চার হবে এর মধ্য দিয়ে।
ইতোমধ্যে আমরা দেখছি বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে
কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী ভারতের সম্পর্কের ধরন কী হবে এ বিষয়গুলো নিয়ে দুই দেশের
সরকারি পর্যায়ে আলোচনা চলছে। ধারণা করা যাচ্ছে, আগামী সপ্তাহে জাতিসংঘের সাধারণ
পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের ফাঁকে বাংলাদেশ এবং ভারতের দুই সরকারপ্রধানের মধ্যে
সাইডলাইন বৈঠক হতে পারে। আর এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে যদি কোনো
ধরনের টানাপড়েন থেকেও থাকে, তা নিরসন হতে পারে। তবে এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা
প্রয়োজন যে, মার্কিন প্রতিনিধিদলটি সরাসরি ওয়াশিংটন থেকে বাংলাদেশে এলেও ডোনাল্ড
লু এ দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন দিল্লি থেকে, অর্থাৎ এর আগে থেকেই তিনি দিল্লি সফরে
ছিলেন।
দিল্লির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্কের
জায়গাটি মসৃণ করার ক্ষেত্রে লু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন বলে ধারণা করা যায়।
তিনি ঢাকায় দুই দিন অবস্থান করে আবারও দিল্লি ফিরে যাওয়াটাও বিশেষ গুরুত্ব বহন
করে। এও ধারণা করা যায় যে, বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের ফলে ইতঃপূর্বেকার
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের যে টানাপড়েন ছিল, তা
নিরসন করতে নতুন সরকারের সঙ্গে তারা নিবিড়ভাবে কাজ করতে চাইছে। সেই সঙ্গে এ অঞ্চলে
চীনের প্রভাব মোকাবিলায় এবং ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল বাস্তবায়নে ভারতের সঙ্গে
বাংলাদেশকেও তারা পেতে চাইছে, সে ক্ষেত্রে হাসিনা-পরবর্তী ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার
সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে তারা একটা স্পষ্ট ধারণায় আসতে চাইছে। লুর বাংলাদেশ সফর শেষ
করে আবারও ভারতে ফিরে যাওয়া থেকে এটাই ধারণা করা যায় যে, তিনি দুই দেশের মধ্যকার
দূরত্ব নিরসনে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে চাইছেন।
এদিকে মার্কিন প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফর নিয়ে
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। মুখপাত্র ম্যাথু
মিলার বলেছেন, ‘বাংলাদেশে আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা
করতেই মার্কিন প্রতিনিধিদল সফর করেছে।’ তিনি এও যোগ করেন যে, ‘বাংলাদেশে অর্থনৈতিক
প্রবৃদ্ধি, আর্থিক স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন এবং সহযোগিতা বৃদ্ধি করতেই ডোলান্ড লু
প্রধান উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টাসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ
ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।’ এর মধ্য দিয়ে মোটামুটিভাবে যে ধারণা পাওয়া যায়,
তা হচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে
অন্তর্বর্তী যে সরকার বর্তমানে দায়িত্বে রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তরফ থেকে সে
সরকারকে সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়া এ মুহূর্তে তাদের প্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে
দেশটির অর্থনৈতিক সংস্কার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, একইভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ
করে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদলের সফরের পরপরই বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকেও নতুন সরকারকে আরও ২ বিলিয়ন ডলায় ঋণ সহায়তার আশ্বাস। এটা এ সফরের একটা অর্জন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আলোচনায় রয়েছে আইএমএফসহ আরও কিছু আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা থেকে ঋণ এবং অনুদান সহায়তা পাওয়ার বিষয়। সবকিছু মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আস্থা এবং বিশ্বাসের জায়গাটি ফিরে পাওয়া আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।