সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০০:৫৩ এএম
ভারী
বৃষ্টিপাতে জলবন্দি কক্সবাজার শহর। বৃষ্টির পানিতে শুধু নিম্নাঞ্চলই নয়, তলিয়ে গেছে
শহরের অনেক উঁচু এলাকাও। তলিয়ে গেছে পর্যটন নগরীর কলাতলীর হোটেল-মোটেল এলাকাও। স্থানীয়দের
কাছে যা বড় বিস্ময়ের। কারণ, কক্সবাজার জেলা আগে কখনও এমন জলাবদ্ধতা দেখেনি। ১৫ সেপ্টেম্বর
প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ১২ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা
থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় কক্সবাজারে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৫০১ মিলিমিটার;
যা কক্সবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে রেকর্ড হয়েছিল ৪৩৭
মিলিমিটার বৃষ্টিপাত। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, কক্সবাজারের কলাতলী এলাকা গত তিন
মাসে কমপক্ষে চার দফায় জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে; যা এলাকাবাসীর কাছেও বিস্ময়ের। বিশ্বের
দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের পর্যটন জোন কলাতলীতে সচরাচর জলাবদ্ধতা দেখা যায়নি।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের জলাবদ্ধতার পেছনে স্থানীয় বাসিন্দা ও বিশেষজ্ঞরা গত সরকারের
সময়ে বাস্তবায়ন হওয়া ৫৮৬ কোটি টাকার দুই সড়ক প্রকল্পকে দায়ী করছেন। এ প্রসঙ্গে হোটেল-মোটেল
গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেছেন,
‘ভারী বর্ষণ হলে হোটেল-মোটেল জোনে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এর জন্য দায়ী চার লেনের সড়ক।
সড়কটি নির্মাণ করার সময় সেটিকে আগের চেয়ে অস্বাভাবিক উঁচু করা হয়েছে। অন্যদিকে নালার
অংশ ছোট করে ফেলার পাশাপাশি এর ওপরে স্ল্যাব দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। সড়কের পানি নালায়
নেমে যাওয়ার পথ রাখা হয়নি।’ ফলে স্বাভাবিকভাবেই বৃষ্টির পানি দ্রুত সাগর-নদীতে নেমে
যেতে পারছে না। এতে দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা।
বর্তমানে
কক্সবাজারের প্রধান সড়কটি আগের চেয়ে কমপক্ষে তিন ফুট উঁচু করা হয়েছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই
সড়কের অবস্থান থেকে নিচে নেমে গেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মার্কেট। সড়কের আশপাশের নালাগুলো
ময়লা-আবর্জনায় ভরে যাওয়া এবং সেগুলো পরিষ্কার না করায় শহরের দক্ষিণ এলাকার পানি নেমে
যেতে পারছে না উত্তরের বাঁকখালী নদীতে। আবার ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানিও নালায়
নেমে যেতে পারছে না। যার মাশুল গুনছেন শহরবাসী।
প্রতিবেদন
থেকে জানা যায়, কক্সবাজার সড়ক ও জনপদ বিভাগ শহরের লাবণী মোড় হয়ে কলাতলী-লিংক রোড চার
লেনের সড়কটি নির্মাণ করেছে। আর শহরের হলিডের মোড় থেকে বাজারঘাটা হয়ে লারপাড়া বাস টার্মিনাল
পর্যন্ত প্রধান সড়কটির সংস্কার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
৫৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প দুটি উদ্বোধন করা হয় ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর। দেশের আরও
অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের মতো এই প্রকল্প দুটিও উদ্বোধনের পর থেকেই শহরবাসীর দুর্ভোগের
শুরু।
পানির
অপর নাম যেমন জীবন, তেমনি পানি দুর্ভোগেরও অংশ। অপরিকল্পিত নগরায়ণে পানি নিষ্কাশনের
পথ রুদ্ধ হলে জনজীবনে যে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়, তার উদাহরণ রাজধানী, বন্দরনগরী, কক্সবাজারসহ
দেশের বিভিন্ন জেলা। গত এক দশকেরও বেশি সময়ে আমরা শুধু উন্নয়নের ছোঁয়ার কথা জেনেছি।
দেখেছি বাড়ির সামনেই তৈরি হয়েছে ঝাঁ-চকচকে রাস্তা, সেতু, উড়াল পথ। কিন্তু অধিকাংশ
উন্নয়নের ছোঁয়াতেই ছিল না পানি নিষ্কাশনের জন্য পরিকল্পিত ব্যবস্থা। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই
পথঘাট থইথই করে। ড্রেনের নোংরা পানিতে ভরে যায় নিচু বাড়িগুলো। বৃষ্টি থামলেও পানি
সহজে নামে না। আর নামবেই না কোথায়? তারও তো বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পথ চাই। পরিকল্পিতভাবে
সেই পথ নির্মাণ করা হয়নি।
আমরা
জানি, প্রতিটি সরকারেরই থাকে রাজনৈতিক কিছু প্রতিশ্রুতি। কিন্তু সেই রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি
যদি অপরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, তাতে শুধু রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় হয়। সাধারণের
উপকারের চেয়েও বেশি হয় অপকার। মাঝ থেকে প্রশ্রয় পায় অনিয়ম-দুর্নীতি। সঠিক ও দূরদর্শী
পরিকল্পনা ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নের কুফল আমরা দেখছি। এভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপব্যবহার
চলতে পারে না।
বৈষম্যবিরোধী
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের
উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে
প্রকল্পের সম্ভাব্যতা ও প্রাসঙ্গিকতা যাচাই করাকে অগ্রাধিকার দেবে। শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে
নয়, বরং পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য উপযোগী, মানুষের প্রকৃত কল্যাণে ব্যবহৃত হয়Ñ এমন উন্নয়ন
পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হবে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিবেচনায় আনা হবে স্থানীয় পরিবেশ-প্রতিবেশ।
প্রকল্প নির্ধারণের ক্ষেত্রে ওই এলাকার সার্বিক অবস্থা, অবকাঠামো নির্মাণে পরিবেশের
ওপর কী প্রভাব পড়বেÑ তাও যাচাই করতে হবে। আমরা সংস্কারের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো গুরুত্ব
দিয়ে ভাবতে বলি। যাতে যেকোনো নির্মাণের ক্ষেত্রে দেশের সামগ্রিক ভৌত অবকাঠামো সামনে
রেখে পরিকল্পনা সাজানো হয়। সারা দেশে উন্নয়ন বা যেকোনো কাজে পরিকল্পনাহীনতা দূর করার
বিষয়েও আমরা আলোচনার পথ উন্মুক্ত রাখার জন্য বলি। বিভিন্ন শহরের যে মাস্টারপ্ল্যান
রয়েছে, সেগুলো মেনেই যেন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়Ñ সেদিকেও মনোযোগ গভীর করা জরুরি।